ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুজিববর্ষে মাদকদ্রব্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যা করণীয়

মো. তাজুল ইসলাম

প্রকাশিত : ১০:৫২ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সোমবার | আপডেট: ১০:৫৪ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সোমবার

মো. তাজুল ইসলাম

মো. তাজুল ইসলাম

সচেতনতা বাড়াতে হলে নিজে আইন-কানুন জানা ও মানা জরুরি। ঠিক সেরকম একটি বিষয়ে আজ লিখব যাতে মাদক আইন নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ে। মাদকদ্রব্য, বাল্যবিবাহ, দুর্নীতি বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যার মধ্য অন্যতম। মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত অপরাধ ও তার অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা সারাদেশ ব্যাপী সবচেয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়। কোনভাবে যখন মাদকদ্রব্য অপরাধ সমূহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হচ্ছিল না ঠিক তখনি মাদক সক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমান সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে। যার ফলশ্রুতিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন ২০১৮ প্রণয়ণ হয়। 

এই আইনটি অত্যন্ত সূদুরপ্রসারী এবং যুগোপযোগী করে নীতি নির্ধারকরা প্রস্তুত করেছেন বলে মনে হয়। সমসাময়িক আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হতে পারে এমন কোন সংজ্ঞা, উপাদান ও আলোচনা নেই যা এই আইনে অন্তর্ভূক্ত করা হয় নাই। ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনটি বর্তমানে অপরাধের ধরণ ও ঘটনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিলো না। যেহেতু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ রহিত করা হয় সেকারণে মাদক দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিধান বিষয় সংবলিত একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়।

মাদক আইনটি আরো গতিশীল ও সময়োপযোগী করতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন, ২০২০’ এর খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর করা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আইনে বলা হয়েছে- সরকার সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করবে এবং প্রত্যেক ট্রাইব্যুনালে অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগ করবে। তবে কোনো জেলায় অতিরিক্ত জেজা জজ না থাকলে ওই জেলায় দায়রা জজ নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে ট্রাইব্যুনালে স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দিয়ে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের মামলা নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে।

যদি প্রশাসনিক কারণে অদ্যাবধি মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন বা জেলা বা দায়রা জজকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই ট্রাইব্যুনালে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি বলে খসড়া আইনে বলা হয় তবে তা কতটুকু বাস্তব সম্মত তা পরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও আলোচনার দাবী রাখে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে অসংখ্য মাদক অপরাধ সংক্রান্ত মামলা হলেও তা বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়। ফলে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। প্রকৃত আসামিকে সাজা দেওয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। আইনের ৫৫টি ধারার মধ্যে ২২টি ধারায় সংশোধন আনা হচ্ছে, উক্ত সংশোধন করা হলে এই আইনের অধীন মাদকদ্রব্য অপরাধগুলো অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে বিচার সম্পন্ন হবে। সংশ্লিষ্ট দায়রা জজ, মহানগর দায়রা জজ তাদের এখতিয়ার সম্পন্ন এলাকার জন্য কেবল মাদকদ্রব্য অপরাধের বিচারের জন্য এক বা একাধিক আদালত নির্দিষ্ট করতে পারবেন। ফলে মাদক অপরাধের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। এখন বিশেষ আদালত গঠিত হবে। এতে বিচারপ্রাপ্তি আরও সহজ করবে। ‘দুই বছরের সাজা হলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করবেন। যেখানে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট আছে সেখানে দায়রা জজ বিচার করবেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এ ৩৮টি সংজ্ঞা রয়েছে, যার মধ্যে ১৮টি নতুন সংজ্ঞা। মাদকসংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের অপরাধের ধরণ বিবেচনা করে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য সেবন করে কেউ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জনগণের শান্তি নষ্ট করলে বা একই অপরাধ তিনবার করলে, তার সাজা হবে। আইনে না থাকলেও নতুন যেকোনো ধরনের মাদকদ্রব্য আবিষ্কৃত হলেই তা আইনের আওতায় আসবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে মাদকের সব অপরাধের বিচার ভ্রাম্যমাণ আদালতে হতো না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ আইনে অপরাধের লঘু-গুরু বিভাজন ও পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে দণ্ডের পুনর্বিন্যাসসহ সব ধরনের মাদকের ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের এখতিয়ার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সিসা বারের অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রম নৈতিক অবক্ষয়সহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সে জন্য আইনে অ্যালকোহল ব্যতীত অন্যান্য মাদকদ্রব্য বা মাদকদ্রব্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

যেমন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০, দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে কার্যকরী থাকলেও সীসা বা ইয়াবা মাদকের শ্রেনীতে অন্তর্ভূক্ত ছিল না। ফলে ইয়াবা এবং সীসা নতুন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ তে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কিন্তু ডোপ টেষ্টে কেউ পজেটিভ হলে তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যাবতীয় মাদকদ্রব্য মাদক হিসাবে এই আইনে মাদকদ্রব্য হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ঐ আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলাসমূহ বর্তমানে আদালতে ও ট্রাইব্যুনালে চলমান ও বিচারাধীন থাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ সেই অর্থে এখনও কার্যকর। কিন্তু বিশ্ব পরিবর্তন এবং বিবর্তনের সাথে সাথে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার আবির্ভাবে উন্নত ও অভিনব শ্রেণীর মাদকের উদ্ভাবন হয়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন মাদক শ্রেণীর কেস মামলার বিচার পরিচালনা ও অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ষষ্ঠ অধ্যায় এ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন ও অপরাধের বিচার এর সময়ে নতুন সংযোজন হিসাবে অডিও এবং ভিডিও যা ক্যামেরায় গৃহীত ছবি, রেকর্ডকৃত কথাবার্তা, ইত্যাদির সাক্ষ্য মূল্য বিচার আমলে গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রিক ডিভাইসের সাক্ষ্য হিসাবে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ৫৬ ধারায় বলা আছে, ৫৬। Evidence Act, 1872 (Act No.I of 1872) তে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি বা তদন্তকারী সংস্থার কোনো সদস্য বা অন্য কোনো ব্যক্তি কোনো মাদকদ্রব্য অপরাধ বা ক্ষতি সংঘটন বা সংঘটনের প্রস্তুতি গ্রহণ বা উহা সংঘটনে সহায়তা সংক্রান্ত কোনো ঘটনার ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণ বা গ্রহণ করিলে বা কোনো কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনা টেপ রেকর্ড বা ডিস্কে ধারণ করিলে উক্ত ভিডিও, স্থিরচিত্র, টেপ বা ডিস্ক উক্ত অপরাধ বা ক্ষতি সংশ্লিষ্ট মামলা বিচারের সময় সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হইবে। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধের বিচারের দায়িত্ব আইন না পড়া ও কম জানা মোবাইল কোর্টের ম্যাজিষ্ট্রেটদের প্রদান করা হয়েছে। যারা মোবাইল কোর্টে মাদকের রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া সাজা প্রদান করে ইতোমধ্যে সমালোচিত হয়েছে। মাদকদ্রব্য অপরাধসমূহের বিচারে প্রমানিত হলে শুধু শাস্তি নয় বরং মাদকসেবীদের পুনর্বাসন ও নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন একটি যুগান্তকারী ধারা নতুন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এ সংযোজন করা হয়েছে যা ৬১(১) ধারায় বর্ণিত হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ সালে প্রণীত আইনের ৫৭ ধারার বিধান হলো মোবাইল কোর্টে মাদকদ্রব্য অপরাধসমূহের বিচারের ব্যবস্থা। জনগণ বুঝতে পেরেছে মোবাইল কোর্টে ন্যায় বিচার হচ্ছে না। ন্যায়বিচার ছাড়া সমাজে শান্তি আসবে না। মোবাইল কোর্টের তাৎক্ষণিক বিচারের দর্শন আসলে ভীতি ছড়ানোর দর্শন। ভয় দেখানোর যন্ত্রগুলো জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা আত্মঘাতী। (প্রথম আলো ৪ নভেম্বর ২০১৯) বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান নারী নির্যাতন, ধর্ষণের হার কোনভাবেই কমেনি। মোবাইল কোর্টে মাদকদ্রব্য অপরাধসমূহের বিচারের ব্যবস্থা করার বিধান একদিকে যেমন মাদকদ্রব্য অপরাধসমূহের বিচারের শাস্তির মাত্রা যেমন কম করা হয়েছে তেমনি মাদকদ্রব্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমকে দুটি সমান্তরাল বিচারের মুখোমুখি করে মাদকের বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স নীতি জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার নিয়েছে তা হালকা ও গুরুত্বহীন করা হয়েছে। সেকারণে মাদকদ্রব্য অপরাধকে জঘন্য ও গর্হিত অপরাধ ভেবে মোবাইল কোর্টে বিচারের ব্যবস্থা না করে সরকারের উচিত অতি সত্বর মাদক আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের ভার উপযুক্ত আদালতে ও ট্রাইব্যুনালে প্রদান করা। তা না হলে মাকদদ্রব্য অপরাধের গুরুত্ব ও গভীরতা বিবেচনায় মোবাইল কোর্টে ০১/০২ মাসের শাস্তি ও শুধু টাকা জরিমানার বিচার হাস্যকরে পরিণত হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর অন্যান্য অতিব জনগুরুত্বপূর্ণ নতুন নতুন বিষয় সংযোজন ও তার বিচার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সেক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখা দিবে এবং অপরাধীরা অপরাধ করে পার পাবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এ ও ১৯৯০ সালের মাদক আইনের ৭৫ শতাংশ পরিবর্তন করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ করা হয়। মাদক অপরাধের তাৎক্ষণিক শাস্তি নিশ্চিত করতে কিছু অপরাধ ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় আনা হয়েছে। পুরোনো আইনে হেরোইন, পেথেডিন, মরফিন, কোকেনসহ আরও কিছু মাদকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এই সময়ের মধ্যে মাদকের তালিকায় যুক্ত হয়েছে ইয়াবা। ইয়াবা কেনাবেচায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ তে ০৫ গ্রামের অধিক নিষিদ্ধ ইয়াবা বা এ্যামফিটামিন উৎপাদন, চোরাচালান, বিতরণ অথবা ব্যবহার করিলে তাকে সর্বোচচ মৃত্যদণ্ড এবং সর্বনিম্ন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। 

(Narcotics Control Act 2018, introducing provisions of death sentence as maximum punishment for anyone involved in producing, smuggling, distributing or using over 5 grams of banned drug yaba or amphetamines.) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এ যদি কেউ ২৫ গ্রামের অধিক নিষিদ্ধ ‘এ শ্রেণীর মাদক হেরোইন বা কোকেইন উৎপাদন, চোরাচালান, বিতরণ অথবা ব্যবহার করিলে তাকে সর্বোচচ মৃত্যদণ্ড এবং সর্বনিম্ন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর ৪৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে পারবে। (৪) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, এ ধারার অধীন ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংশ্লিষ্ট জেলার যেকোনো অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে তাহার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে। পেনাল কোডের অপরাধ কোন কোন আদালত বিচার করতে পারে তা আমাদের সকলের জানা। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর আপরাধে বিচারের জন্য ট্রাইবুনালে স্থাপনের কথা বলা হলেও এখনও পর্যন্ত কোন ট্রাইবুনাল স্থাপন করা হয়নি। এমনকি ট্রাইবুনালের অবর্তমানে ট্রাইবুনালের দায়িত্ব পালনের জন্য কোন অতিরিক্ত জেলা জজ বা দয়রা জজকেও সরকার এখন পর্যন্ত দায়িত্ব প্রদান করেনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সেটি মহামান্য হাইকোর্ট এর আদেশে নিরসন হয়েছে। এবং হাইকোর্ট বলেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর ৪৪(১) ধারা অনুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়া পর্যন্ত ফৌজদারী কার্যবিধির ৫ (২) ধারা অনুযায়ী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মাদকের মামলা চলবে।

নতুন মাদক আইনে শিশুর বিচার ব্যবস্থা, মাদক ব্যবসার অর্থযোগানদাতা ও পৃষ্টপোষক, অডিও ও ভিডিও ইলেকট্রিক ডিভাইসের সাক্ষ্যকে গ্রহণের বিধান, মাদকসেবীদের পুনর্বাসন এবং পুনরায় মাদক অপরাধীর দ্বিগুণ শাস্তি ইত্যাদি সংযুক্ত করা হয়েছে। একারণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনটি একটি যুগান্তকারী ও সময়োপযোগী আইন তা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। তবে সম্প্রতি ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন, ২০২০’ খসড়া আইনে বলা হয়েছে- ট্রাইব্যুনাল নয়, মাদক মামলার বিচারে গঠন করা হবে বিশেষ আদালত। অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং নতুনভাবে সৃষ্ট মাদকের আগ্রাসন রোধে ট্রাইব্যুনালের পরিবর্তে বিশেষ আদালত গঠন করে মাদক ব্যবসায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। আগে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করার কথা ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক কারণে সেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সম্ভব হয়নি। এখন ১ লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি মামলা রয়েছে। মাদকের জন্য এখতিয়ারসম্পন্ন বিশেষ আদালত গঠন করছি। যেখানে ৬ মাসের কারাদণ্ড আছে, মৃত্যুদণ্ডও আছে। যে আদালতের যতটুকু ক্ষমতা সে আদালত ততটুকু বিচার করবেন। ক্ষমতাটুকু জেলা জজের কাছে দিয়ে দিচ্ছি, তিনি তার প্রয়োজন অনুযায়ী আদালত গঠন করে দেবেন। ‘শুধু মাদকের জন্য জেলা ও দায়রা জজ কোর্টগুলোকে ডেডিকেটেড করে দেবেন। স্পেশাল এখতিয়ার সম্পন্ন স্পেশাল আলাদত, প্রত্যেক জেলা ও মহানগরে। ট্রাইব্যুনাল থেকে জনস্বার্থে সরকার সরে আসছে। প্রশাসনিক জটিলতা কী- ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য যে পরিমাণ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রয়োজন তার কিছুটা সঙ্কট ছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল মাদকের মামলাগুলোকে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে অপরাধীকে ধরা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ছয় মাসের জেল হবে সেটাও একজন জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বিচারে যাচ্ছে। যেখানে হত্যা মামলার মতো মামলাগুলো হ্যাম্পারড হতে পারে। কারও ছয় মাসের জেল হলো, জরিমানা হলো, সঙ্গে সঙ্গে তার আপিলের অথরিটি হাইকোর্ট। পঞ্চগড় বা টেকনাফের আসামিকে জেল দিয়ে আপিল করতে তাকে ঢাকা আসতে হবে। এসব প্রশাসনিক বিষয়গুলোকে বিবেচনায় এনে সরকার চিন্তা করেছে যদি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করা হয় তবে যে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিপক্ষে জজকোর্টে আপিল করতে পারছে। ভূমি ট্রাইব্যুনালে লাখ লাখ মামলা বিচারাধীন আছে। সেটাও একইভাবে সংশোধন করা হবে। যেটি নতুন পদসৃষ্টি বা নতুন জজ নিয়োগ না দিয়ে একই বিচারকের উপর একাধিক মামলা বিচারের দায়-দায়িত্ব দিয়ে মামলা জট কতটুকু কমানো যায় সেটিই এখন দেখার বিষয়।

মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার ও প্রচারণা করতে হবে মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গীর্জার ফাদারদের মাধ্যমে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে মাদক সেবনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সকল সরকার, রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের দেশ ও সমাজের স্বার্থে একই প্লাটফর্মে থেকে কাজ করতে হবে। তাহলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সহজ ও টেকসই হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন এবং তিনি মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মাদক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ধারাবহিকতায় তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যাতে করে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাদক মুক্ত দেশ হিসাবে রোল মডেল হতে পারে।

লেখক: মো. তাজুল ইসলাম, বিচারক, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস। ই-মেইল: tajul_jdjbd71@yahoo.com

এসি