ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চোখে পানি নিয়ে দিল্লি ছাড়ছে মুসলিমরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:১৩ এএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ শুক্রবার

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও নাগরিক পঞ্জিকা নিয়ে উত্তাল ভারতে এখন পর্যন্ত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা অন্তত আড়ইশ। যাদের মধ্যে ৭০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতাল সূত্রে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে। 

চলমান এ হামলার আবারও হওয়ার আশঙ্কায় ভারতের কয়েকটি স্থান থেকে চোখে পানি নিয়ে ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে মুসলিমরা। বৃহস্পতিবার পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই ঘরবাড়ি ছেড়ে গাটি বস্তা নিয়ে অনত্র পালাচ্ছেন এসব মুসলিমরা। তাদের মধ্যে কয়েকজন হিন্দুও রয়েছেন। 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, উত্তর-পূর্ব দিল্লির খাজুরি খাস শহরে প্রথম এ অবস্থা দেখা যায়। এ শহরের চার নম্বর গলির মুখটায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন ৬৫ বছর বয়সী মহম্মদ তাহির। কাঁদছিলেন পাশে দাঁড়ানো তার দুই পুত্রবধূও। গলির মুখ থেকে তাদের বাড়িটা ছিল চার-পাঁচেক বাড়ির পরেই। হামলাকারীদের ছোঁড়া আগুনে গোটা বাড়িটাই এখন ছাই হয়ে গিয়েছে।

গত মঙ্গলবার গভীর রাতে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে দিতে হাজারখানেক যুবক ঢুকেছিল তাহিরদের গলিতে। তাদের হাতে ছিল বন্দুক, ধারালো অস্ত্রশস্ত্র। গলিতে ঢুকেই তারা মারধর শুরু করল সেখানকার বাসিন্দাদের। ঘরে ঘরে ঢুকে লুটপাট চালায়। তারপর প্রতিটা বাড়িতে আগুন লাগাতে থাকে। লোকজন যে বাড়িগুলোর ভিতরে রয়েছেন, তার পরোয়াই করেনি তারা।

এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে কথা গুলো বলছিলেন ভুক্তভোগী মুসলিম তাহির। বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলছে দেখে প্রাণে বাঁচতে আর কয়েক জন প্রতিবেশীর ন্যায় তিনিও তার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে উঠে যান ছাদে। তার পর এক এক করে সেই ছাদ থেকে পাশের বাড়ির ছাদে ঝাঁপ দেন। এভাবে হামলাকারীদের থেকে বাঁচতে অন্যান্যদের নিয়ে ছাদ টপকে টপকে প্রাণে বাঁচেন তাহিররা।

অনেক কষ্টে বানিয়েছিলেন বাড়িটা। তাই বুধবার বিকেলে দুই পুত্রবধূকে নিয়ে বাড়িটা দেখতে এসেছিলেন তাহির। গিয়ে দেখেন, গোটা বাড়িটাই ছাই হয়ে রয়েছে। পাশের বাড়িটারও একই দশা। তার পরেরটাও। যা দেখার পর আর চোখের জল চেপে রাখতে পারেননি তারা। গলির মুখে এসে কাঁদতে কাঁদতে বার বার পিছনে ফিরে ছাই হয়ে যাওয়া বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। দুই পুত্রবধূকে নিয়ে চার নম্বর গলির মুখেই বসে পড়েছিলেন তাহির।

ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাহির বলেন, ‘ওরা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল। আমরা প্রাণভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করলাম। আমার স্ত্রী পঙ্গু হওয়ায় সে পারল না। আমার দুই ছেলেও গুরুতর আহত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কিছুই আমরা খাইনি।’

অগ্নিসংযোগের হাত থেকে রেহাই পায়নি গলির হিন্দু বাসিন্দাদের ঘরবাড়িও। খাজুরি খাসের চার নম্বর গলিতে যত মুসলিম পরিবার থাকতেন, মঙ্গলবার গভীর রাতের ভয়াবহ ঘটনার পর তারা সকলেই সেখান থেকে অন্যত্র পালিয়ে যান। 

এই অবস্থা শুধু খাজুরি খাসের নয়, একই অবস্থা মৌজপুর বাবরপুর ও ভাগীরথী বিহারের গলিগুলোর। কোনও মুসলিম পরিবার আর সেখানে নেই।
 
স্থানীয়রা জানান, ‘এমন ভয়াবহ ঘটনা এর আগে দেখিনি। ওদের সকলের হাতে ছিল বন্দুক, লাঠি, ধারালো অস্ত্রশস্ত্র। ওরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিচ্ছিল। ওই ধ্বনি দিতে দিতেই গলির একের পর এক ঘরবাড়িতে ওরা আগুন লাগাতে শুরু করে। এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।’

খাজুরি খাসের আর এক বাসিন্দা সিতারা বললেন, ‘ওই সময় নিজেকে সামনে দিয়ে বাচ্চাটাকে আড়াল করেছিলাম। বাঁচিয়েছি ঠিকই, কিন্তু এখন ভাবছি, ওকে কী খাওয়াব, পরাব?’

খাজুরি খাসের চার নম্বর গলির হিন্দু বাসিন্দারা কিন্তু ওই সময় তাঁদের মুসলিম পড়শিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। মুসলিমদের ঘরবাড়িগুলো যখন পুড়ছে, তখন তারা নিজেদের বাড়ি থেকে বালতির পর বালতি পানি ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি, জানালেন চার নম্বর গলির এক হিন্দু বাসিন্দা। যিনি কিছুতেই তার নাম জানাতে চাইলেন না। ভয়ে, যদি এর পর তার উপরেও চড়াও হয় দুষ্কৃতীরা।

গলিতেই থাকতেন দিনমজুর মহম্মদ আরিফ। বিজয় পার্ক এলাকায় দিনদু’য়েক আগে একটি কাজ পেয়েছিলেন আরিফ। জানালেন, এই ঘটনার পর তিনি প্রাণে বাঁচায় চলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

গলিতে গলিতে ঢুঁ মেরে দেখা যায়, গত রোববার থেকে টানা হামলার ঘটনার পর খাজুরি খাস, মৌজপুর বাবরপুর, ভাগীরথী বিহারের মুসলিম এলাকাগুলো খাঁ খাঁ করছে। বাড়িগুলি ছাই, তাই আক্ষরিক অর্থেই, শ্মশানের চেহারা নিয়েছে এলাকাগুলো। 

এদিকে, ভারতের এ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কর্পোরেশন-ওআইসি। তবে তা ভালভাবে নেয়নি ভারত সরকার। ওআইসির মন্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মন্তব্য করেছে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। 

আনন্দবাজার অবলম্বনে

এআই/