ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

করোনাতঙ্কে ছড়াচ্ছে ভুয়া স্বাস্থ্য পরামর্শ, এড়িয়ে চলুন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:০২ পিএম, ৮ মার্চ ২০২০ রবিবার

করোনাতঙ্কে ছড়াচ্ছে ভুয়া স্বাস্থ্য পরামর্শ

করোনাতঙ্কে ছড়াচ্ছে ভুয়া স্বাস্থ্য পরামর্শ

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের নানা দেশে। এর কোনও প্রতিষেধক বের হয়নি এখন পর্যন্ত। তবে দুর্ভাগ্যবশত: করোনাভাইরাস ঠেকাতে দেয়া হচ্ছে নানা ধরণের স্বাস্থ্য পরামর্শ, যেগুলোর অধিকাংশই হয় অপ্রয়োজনীয়, নয়তো বিপজ্জনক।

কিন্তু অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া এসব পরামর্শ সম্পর্কে কী বলছেন বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা? আসুন জেনে নিই-

রসুন
ফেসবুকে এমন অসংখ্য পোস্ট দেখা গেছে, যেখানে লেখা- যদি রসুন খাওয়া যায় তাহলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, "যদিও রসুন একটা স্বাস্থ্যকর খাবার এবং এটাতে এন্টিমাইক্রোবিয়াল আছে।" কিন্তু এমন কোনও তথ্য প্রমাণ নেই যে, রসুন নতুন করে আঘাত হানা করোনাভাইরাস থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রতিকারক ব্যবস্থা মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু এর মাধ্যমেও ক্ষতি হতে পারে।

যেমনটি দেখা গেছে, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে- করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে একজন নারী দেড় কেজি কাঁচা রসুন খেয়েছে। এতে করে তার গলায় ভয়াবহ প্রদাহ শুরু হয়। পরে ওই নারীকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়।

আমরা জানি- ফল, সবজি, এবং পানি খেলে স্বাস্থ্য ভাল থাকে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনও খাদ্য দিয়ে যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে, এর পক্ষে কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।

অলৌকিক সমাধান
জরডান সাথের হলেন একজন ইউটিউবার। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তার রয়েছে হাজার হাজার অনুসারী। তিনি দাবি করছেন, "একটা অলৌকিক খনিজ পদার্থ" যাকে এমএমএস নামে ডাকা হয়। সেটা দিয়ে এই করোনাভাইরাস একেবারে দূর করা সম্ভব। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, এটাতে রয়েছে ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড যেটা একটা ব্লিচিং এজেন্ট।

মি. সাথের এবং অন্যরা অবশ্য এই পদার্থকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগেই প্রচার করে আসছে। কিন্তু জানুয়ারি মাসে তিনি টুইট করে বলেন, "ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড ক্যান্সারের কোষকেও ধ্বংস করতে পারে এবং এটা করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে।"

তবে গত বছরে মার্কিন ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রিশন (এফডিএ) সতর্ক করে বলে যে, এমএমএস পান করা স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। অন্যান্য দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে।

কলোইডিয়াল সিলভার দিয়ে করোনাভাইরাসের জীবাণু ধ্বংস অসম্ভব বলেই উল্লখ করেছে এই গবেষণা।
এফডিএ বলছে, তারা এমন কোনও গবেষণা সম্পর্কে জানে না যে, এই পদার্থ নিরাপদ অথবা কোনও অসুস্থতার জন্য পথ্য হতে পারে।

এমনকি এফডিএ সতর্ক করে বলেছে, এটা পান করার ফলে মাথাব্যথা, বমি, ডায়রিয়া এবং পানিশূন্যতার লক্ষণও দেখা দিতে পারে।

ঘরে তৈরি জীবাণুনাশক
করোনাভাইরাস ঠেকানোর একটা কার্যকর উপায় হচ্ছে বার বার করে হাত ধোয়া। আর এ ক্ষেত্রে হাত ধোয়ার জেল, যেটা দিয়ে তাৎক্ষণিক জীবাণু ধ্বংস করা যায়, সেটা ফুরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ইতালি এখন করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি। দেশটিতে যখন এই জেল ফুরিয়ে যাওয়ার খবর বের হলো, তখন এই জেল কীভাবে ঘরে বানানো যায় সেই রেসিপি দেয়া শুরু হলো সোশ্যাল মিডিয়াতে।

কিন্তু সেসব রেসিপি ছিলো মূলত: ঘরের মেঝে বা টেবিলের উপরিভাগের জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যাতে তেমন কোনও কাজই হয় না বলতে গেলে। 

এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই রেসিপি ত্বকের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। তাদের মতে, অ্যালকোহল যুক্ত হ্যান্ড জেলগুলোতে ৬০-৭০ ভাগ অ্যালকোহল থাকে। তার সাথে থাকে এমোলিয়েন্ট নামে এক ধরণের পদার্থ যেটা ত্বককে নরম রাখে।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক স্যালি ব্লুমফিল্ড বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে, ঘরে বসে হাতের জন্য উপযুক্ত জীবাণুনাশক তৈরি করা সম্ভব।

রূপার পানি
কলোইডিয়াল সিলভার মূলত এমন এক ধরনের পানি, যেখানে রুপার ক্ষুদ্র কণিকা মেশানো থাকে। মার্কিন টেলি-ইভানজেলিস্ট ধর্মপ্রচারক জিম বেকার এই পানি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। তার অনুষ্ঠানে এক অতিথি দাবি করেন যে, এই পানি কয়েক ধরণের করোনাভাইরাস মেরে ফেলতে সক্ষম। অবশ্য তিনি স্বীকার করেন যে, কোভিড-১৯ এর ওপর এটা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। 

কলোইডিয়াল সিলভারের সমর্থকরা দাবি করেন যে, এটা (রুপার পানি) অ্যান্টিসেপটিক এবং নানা ধরনের চিকিৎসায় ব্যবহার করা চলে।

কিন্তু মার্কিন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার ভাষায় বলেছে, এই ধরনের পানি ব্যবহার করে স্বাস্থ্যের কোনও উপকার হয় না। বরং এর ব্যবহারে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। এমনকি মানুষ এতে জ্ঞানও হারাতে পারে। তারা বলছে, লোহা এবং জিংক যেমন মানব দেহের জন্য উপকারী, রূপা তেমনটা নয়।

১৫ মিনিট অন্তর পানি পান
ফেসবুকের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে দেয়া পোস্টে একজন 'জাপানি ডাক্তার'কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের জীবাণু মুখের মধ্যে ঢুকে পড়লেও প্রতি ১৫ মিনিট পর পর পানি খেলে তা দেহ থেকে বের হয়ে যায়।

এই পোস্টের একটি আরবি ভার্সন ২ লাখ ৫০ হাজার বার শেয়ার হয়েছে। কিন্তু লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক স্যালি ব্লুমফিল্ড বলেছেন, এই দাবির পক্ষে সত্যিই কোনও প্রমাণ নেই।

তাপমাত্রা ও আইসক্রিম পরিহার
গরমে করোনা ভাইরাস মরে যায় বলে সোশাল মিডিয়াতে অনেক ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। গরম পানি পান করা, গরম পানিতে গোসল করা, এমনকি হেয়ারড্রায়ার ব্যবহারেরও সুপারিশ করা হচ্ছে।

ইউনিসেফের উদ্ধৃতি দিয়ে এমনই একটি পোস্ট নানা দেশে সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, গরম পানি পান করলে এবং রৌদ্রের নীচে দাঁড়ালে করোনা ভাইরাসের জীবাণু মরে যাবে। পাশাপাশি আইসক্রিম খেতেও বারণ করা হয়েছে।

কিন্তু ইউনিসেফ বলছে, এটা স্রেফ ভুয়া খবর। ফ্লু ভাইরাস মানব দেহের বাইরে বেঁচে থাকতে পারে না।

আর দেহের বাইরে এই জীবাণুকে মেরে ফেলতে হলে ন্যূনতম ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লাগবে, যেটা গোসলের পানি থেকে অনেক বেশি গরম। 

তাহলেই এবার বুঝুন। কত রকম ভুয়া স্বাস্থ্য পরামর্শ ভাইরাসের মতোই ভেসে বেড়াচ্ছে আপনার-আমার চারপাশে। সুতরাং বাঁচতে হলে জানতে হবে, সচেতন থাকতে হবে। আর সতর্ক বা সচেতন থাকতে সঠিক তথ্য জানার কোনও বিকল্প নেই।   

এনএস/