ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

করোনার উপসর্গ ও করণীয় নিয়ে যা বলছেন চিকিৎসকরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:২০ পিএম, ১০ মার্চ ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৫:২৩ পিএম, ১০ মার্চ ২০২০ মঙ্গলবার

করোনার উপসর্গ ও করণীয় নিয়ে যা বলছেন চিকিৎসকরা

করোনার উপসর্গ ও করণীয় নিয়ে যা বলছেন চিকিৎসকরা

করোনা বা কোভিড-১৯, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এক আতঙ্কময় ভাইরাসের নাম। এটি মূলত শ্বাসতন্ত্রের রোগের কারণ। যা প্রাকৃতিকভাবেই প্রাণীর মধ্যে থাকে। 

চীনের উহান থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটিতে এখন পর্যন্ত ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন দেড় লাখেরও বেশি। এর মধ্যে অবশ্য সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন ৬৫ হাজারের অধিক। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বে ক্রমাগত বন ও জঙ্গল কেটে উজাড় করে ফেলায় প্রাণী ও মানুষের মাঝে দূরত্ব অনেক কমে আসছে। এতে করে একে-অপরের সংস্পর্শে চলে এসেছে। ফলে প্রাণীর মধ্যে থাকা ভাইরাস সহজেই মানুষের দেহে প্রবেশ করছে এবং তা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। 

এসব ভাইরাস একত্রিত হয়ে আবার নতুন করে ভাইরাস তৈরি হচ্ছে। যদিও তা সংখ্যায় একেবারেই কম। এসব ভাইরাসের সংক্রমণ শক্তি কম হলেও অনেক সময় কোনও একটি শক্তিশালী ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে ব্যাপক ক্ষতি করছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস তাদেরই একটি। 

ইতোমধ্যে বিশ্বের ১১০টি দেশে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসের এখন পর্যন্ত সাতটি প্রকার আবিষ্কার করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে চারটিই হচ্ছে- সিজনাল। যা অনেক সময় কাশি ও ইনফ্লুয়েন্জা থেকেই শুরু হয়। তবে বাকি তিনটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। 

এর মধ্যে একটি হলো- ২০০৩ সালের চীনে মহামারী আকার ধারণ করা সার্স ভাইরাস। যাতে বহু সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এরপর ২০১২ সালে সৌদি আরবে ছড়িয়ে পড়া মার্স ভাইরাস। যাতে শুধু উৎপত্তিস্থল দেশটিতেই সাড়ে ৮শর বেশি মানুষ প্রাণ হারান। 

আর সবশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস। যাতে এখন পর্যন্ত বিশ্বের চার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। 

অন্যান্য ভাইরাসের ন্যায় এতে মৃত্যু হার কম হলেও আক্রান্তের ব্যাপকতা অনেক বেশি। ছোঁয়াচে রোগ হওয়ায় এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সবশেষ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৩ জনের শরীরে ভাইরাসটির সংক্রমণের দেখা মিলেছে। এছাড়া আক্রান্ত সন্দেহে আরও ৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। 

তাইতো সবার মাঝেই কৌতুহল- বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করা ভাইরাসটির প্রতিরোধে করণীয় কি? এর সমাধানসহ করোনা মোকাবেলায় কি ধরণের পদক্ষেপ আমরা নিতে পারি? 

জানতে চাইলে আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকতা ডা. মুশতাক হোসেন একুশে টেলিভিশনকে জানান, ‘করোনা ভাইরাসের লক্ষ্মণগুলো প্রায় একই। এর মধ্যে জ্বর, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট থাকবে। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত দেশগুলোয় আমি ভ্রমণ করেছি কিনা, বা আক্রান্তদের মধ্যে কারো সংস্পর্শে এসেছি কিনা, এসব শর্তের সঙ্গে যদি সর্দি, কাশি হয়- তবেই তিনি করোনায় আক্রান্ত বলে চিহ্নিত হবেন। তবে আক্রান্ত হলেই যে কেবল বিপদজনক তা কিন্তু নয়। কেননা, এ ভাইরাসের আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ ভাগই মৃদু সংক্রমণ বা উপসর্গ। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যেও অল্প সংখ্যক রোগীর অবস্থা গুরুতর অবস্থায় চলে যেতে পারে।’ 

তিনি  বলেন, ‘আমরা যদি আক্রান্ত দেশগুলোর দিকে তাকাই দেখতে পাই, যাদের বয়স ষাটোর্ধ্ব, এদের মধ্যে আগে থেকেই যারা ডায়াবেটিকস, ব্লাড প্রেসার, হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা কিংবা ক্যান্সারে ভুগছেন, তারাই কেবল মরণাপন্ন জায়গায় চলে যেতে পারেন। তাই বলা যায়, আক্রান্ত বেশি হলেও এ রোগে মৃত্যুর হার খুবই কম।’

এ চিকিৎসক বলেন, ‘চীনের মতো জনসংখ্যাবহুল দেশে যদি আক্রান্তদের মধ্যে ৩ শতাংশও যদি মৃত্যু হিসেবে ধরি তাতেও কিন্তু অনেক হয়। কিন্তু সেখানে সে তুলনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।’ 

কম বয়সীরা আক্রান্ত হলে করণীয় কি? জানতে চাইলে ডা. মুশতাক বলেন, ‘আশার কথা হলো- আক্রান্ত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতি পাই, কম বয়সীদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই করোনা সংক্রমণ ধারা পড়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য চিকিৎসকদের ধারণা ছিল, সার্স ও মার্সের মতোও নতুন এ ভাইরাসটিতে শিশু ও তরুণদের আক্রান্তের সংখ্যা দীর্ঘ হতে পারে। তবে সে শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে কম বয়সীদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। তারপরও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কেউ আক্রান্ত হলে সরাসরি হাসপাতালে না গিয়ে আগে চিকিৎসকদের জানাতে হবে এবং প্রাথমিকভাবে বাড়িতেই চিকিৎসা নিতে হবে।’ 

আক্রান্ত ব্যক্তিদের কি ধরণের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যাদের মধ্যে করোনার মৃদু লক্ষ্মণ পাওয়া গেছে, তাদেরকে মূলত প্যারাসিটামল ছাড়া অন্যা কোনও ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে না। তবে যখন শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পাবে তখন সে অনুযায়ী অক্সিজেন, ম্যাকানিক্যাল ভেন্টিলেটর এবং আইসিইউতে নেয়া হয়। শুধু করোনা নয়, সার্স, মার্স ও অন্যান্য ভাইরাস থেকে শুরু করে বেশিরভাগ ভাইরাস রোগেরই সরাসরি কোনও ঔষধ নেই। চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার আলোকে যা পর্যবেক্ষণ করে ও চিকিৎসা দেন।’ 

করোনা প্রকোপ থেকে মুক্তি পেতে পণ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী জানিয়ে ডা. মুশতাক বলেন, ‘করোনা ভাইরাস মূলত তিনভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ড্রপলেট ইনফেকশন অর্থাৎ, কোনও ব্যক্তির পাশপাশি থাকাকালীন হাঁচি দেয়া। ফলে ওই হাঁচিতে অপর ব্যক্তি আক্রান্ত হচ্ছেন, সংস্পর্শ থাকাকালীন। অর্থাৎ, অফিস, আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ঘরে একত্রে থাকায় এটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং ফোমাইট বা অপ্রাণী বস্তুতে আপনার হাঁচি লেগে থাকায় সেটা যখন অপর কোনও ব্যক্তি স্পর্শ করেন তখন তিনি আক্রান্ত হতে পারেন। তাই হাঁচি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। যাতে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে। এবং যখনই এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশে যাওয়া হয়, তখনই হাত ধুয়ে ফেলা উচিত।’

মাস্কের ব্যবহার নিয়ে তিনি বলেন, ‘যিনি সুস্থ আছেন তাকে আমরা মাস্ক ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করি। কেননা, শুধুমাত্র মাস্ক ব্যবহার করলেই যে একজন সুস্থ ব্যক্তি করোনা থেকে সুরক্ষিত থাকবেন তা কিন্তু নয়। একজন সুস্থ মানুষ মাস্ক মুখে যখন খেতে যাবেন, মুখ ধুতে যাবেন তখন মাস্ক খুলতে হবে। এতে মাস্ক স্পর্শ করতে হবে। আর এতেই মাস্কের কার্যকারিতা শেষ হয়ে যাবে। এভাবে চললে তো কমপক্ষে দিনে ২০টি মাস্ক আপনাকে ব্যবহার করতে হবে।’

‘আবার যে মাস্ক ফেলে দিবে তা অনেকে কুড়িয়ে এনে নতুন করে বিক্রি করবে। তাই সুস্থ ব্যক্তি নয়, শুধুমাত্র অসুস্থ ব্যক্তিদেরই মাস্ক পড়া জরুরি। তা নাহলে এ অবস্থা চলতে থাকলে জরুরি মুহূর্তে রোগী কিংবা চিকিৎসক কেউই মাস্ক পাবেন না’, যোগ করেন তিনি।

ডা. মুশতাক হোসেনের মতে, প্রাণঘাতি এই করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, হাত ধোয়া, শ্বাসতন্ত্রের পরিচ্ছন্নতা, কাশি শিষ্টাচার মেনে চলার বিকল্প নেই। এতে ৭০ ভাগেরই বেশি চিকিৎসা এমনিতেই হয়ে যাবে। তাহলে শুধু করোনা নয়, যে কোনও রোগ থেকে আমরা সহজেই মুক্তি পাবো। 

একই কথা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ
ভাইরাসটির উপসর্গ নিয়ে তিনি বলেন, ‘একটা ভাইরাস একজনের শরীরে আসার ১৪ দিনের মধ্যে দৃশ্যমান হতে পারে। কাশি, জ্বর, গায়ে ব্যথা হতে পারে। কম বয়স্কদের এ রোগের ঝুঁকি একেবারেই কম। বিশেষ করে ৩৯-৪০ পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই কম। বিশেষ করে অন্য দেশ থেকে আসা রোগীদের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। অর্থাৎ যেসব দেশে এ ভাইরাস মহামারী হয়ে উঠছে সেসব দেশ থেকে আসা রোগীর মাধ্যমে এ ভাইরাস আসতে পারে। নতুবা আমাদের দেশে এ ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা তেমন নেই।’

এ চিকিৎসক বলেন, ‘তবে সতর্ক থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহার, হাত পরিষ্কার করা খুবই জরুরী। তবে হাঁচি-কাশি খোলা জায়গায় না দেয়াই ভালো এবং এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। প্রবাস থেকে আসা রোগীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে সবেচেয় বেশি।’

এআই/এনএস