ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:০৫ পিএম, ১২ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার

পৃথিবী থেকে মানব জাতি বিলুপ্তির এক সনদপত্র দিয়েছে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল। যেখানে নিতান্তই কিছু শব্দ আর বর্ণ রয়েছে। ওই সনদটি নিয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করলে আপনিও বুঝে ফেলবেন যে আপনি আর মাত্র কয়েকটা দিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন! আপনার সাথে আপনার বাবা মা সন্তান সবাই অতীত হয়ে যাবে!

যখন কোনও রোগ সনাক্ত করার পরও কোনও ওষুধে ভালো হয় না, তখন ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ ব্ল্যাড, পুঁজ বা ইউরিনকে পাঠানো হয় ল্যাবরেটরিতে। কেন অতি সাধারণ একটা রোগ ওষুধে ভালো হচ্ছে না, তা জানতেই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়। ল্যাবে মাইক্রোবয়োলজিস্টরা ব্ল্যাড, ইউরিন বা পুঁজকে কয়েকদিন ধরে চাষ করা হয়। এরপর ব্যাকটেরিয়াদের ওপর বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়। সেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলতে সক্ষম কি না- তা যাচাই করা হয়।  

ব্যাকটেরিয়াকে মারার সক্ষমতা থাকলে সেই অ্যান্টিবায়োটিকের পাশে লেখা হয় ‘এস’। ‘এস’ ফর সেনসিটিভ। অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিকটি ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে সক্ষম। ব্যাকটেরিয়াকে মারার সক্ষমতা না থাকলে লেখা হয় ‘আর’। ‘আর’ ফর রেজিস্ট্যান্ট। অর্থাৎ প্রয়োগকৃত অ্যান্টিবায়োটি ব্যাকটেরিয়া মারতে সক্ষম নয়। আগে কাজ করলেও ব্যাকটেরিয়া নিজেকে বদলে ফেলেছে। এতে কী দাঁড়ায়? অতি সাধারণ রোগও আর অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সারবে না। রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া এখন ইচ্ছা মতো বংশ বিস্তার করতে পারবে। মানুষের শরীরে রোগ সৃষ্টি করে তারা বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকবে। চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞান দর্শকের ভূমিকায় শুধু দেখে যাবে। একদিন ছোট্ট রোগটা নিয়ে আক্রান্ত মানুষটা মারা যাবে।

একটি রিপোর্ট দেখলে বুঝতে পারবেন। একটি বাচ্চার বয়স মাত্র ৪ বছর। অথচ, সব অ্যান্টিবায়োটি রেজিস্ট্যান্ট। খুব সামান্য একটা রোগ। ওষুধ দেয়া হয়েছে কিন্তু রোগ সারছে না। চিকিৎসক বা চিকিৎসা বিজ্ঞান তাকে আর বাঁচাতে পারছে না। ছেলেটা নিশ্চিত মারা যাবে। শত শত অ্যান্টিবায়োটিক থাকা সত্ত্বেও ব্যাকটেরিয়াগুলো মেরে ফেলা সম্ভব না। কারণ ব্যাকটেরিয়া নিজের ডিএনএ নিজেই পরিবর্তন করে ফেলেছে। ফলে সামান্য ব্যাকেটেরিয়া মারার মতো সক্ষমতা চিকিৎসকদের নেই। বাচ্চাটির বাবা মা চেয়ে চেয়ে দেখছে, ছেলাটার অকাল মৃত্যু। কিন্তু এই ছেলেটি তার মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়। কিন্তু কেন মরতে হচ্ছে শিশুকে?

সামান্য জ্বরে আমরা ফার্মেসি থেকে দুটি জিম্যাক্স কিনে খেয়ে ফেলি। ১০০ ব্যাকটেরিয়াকে মারার জন্য ৭ দিনের ডোজ লাগে। অথচ, দুইদিন পর ভালো হয়ে গেলে আমরা আর সেই ডোজ পূর্ণ করি না। এর ফলে ৭০টা ব্যাকটেরিয়া মরলেও বেঁচে থাকা বাকি ৩০টি ব্যাকটেরিয়া জিম্যাক্সকে চিনে ফেলে। ফলে তারা নিজেদের গঠন দ্রুত বদলে নেয়। তখন আর জিম্যাক্স দিয়েও পরের বার আর রোগ সারাতে পারি না। কারণ জিম্যাক্সের বিরুদ্ধে সব ধরণের স্থায়ী ব্যবস্থা ব্যাকটেরিয়া নিয়ে ফেলেছে।

এখন এই ব্যাকটেরিয়াওয়ালা মানুষটি যদি আমাদের সামনে আসে, তখন তার নিঃশ্বাস, হাঁচি স্পর্শে আমাদের শরীরে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়াটি চলে আসবে। এভাবে জিম্যাক্স রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া লাখ লাখ কোটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। একটা নবজাতক, যে কি না গতকালই জন্মালো সেও আপনার ভুলের কারণে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া ধারণ করতে পারে। আপনি যে বাড়িতে থাকেন সেই বাড়ির বাসিন্দ, যেই ম্যাচে থাকেন সেই বর্ডার, যে নদীতে পা চুবান সেই নদীর অনুকূলের বাসিন্দারাও হয়ে গেল জিম্যাক্স রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার অবয়ারণ্য সম্পন্ন মানুষ। শুধু জিম্যাক্স কেন? আমাদের কেউ কেউ অন্য রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্য অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা আরেকটি ওষুধের রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তৈরি করবে। সেই রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া ভাগাভাগি করবে সারা দেশের মানুষের সঙ্গে, যেখানে যাবে, যেখানটা স্পর্শ করবে, সেখানটাতেই ছড়িয়ে দিবে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া।

এভাবেই একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে আরেকটি ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট শিখে নিবে। ফলে সবার কাছ থেকে ধার করে আমাদের ব্যাকটেরিয়াগুলো হয়ে যাবে সব অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্ট। তাকে এখন যে ওষুধই দেন না কেন, তা কাজ করবে না। ফলে আপনি ওষুধের ডিসপেনসারিতে কোটি কোটি টাকার ওষুধ রেখেও বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন।

তারা যত ধনীই হোক, যে দেশেই চিকিৎসা করাক, সেই ঈশ্বরের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। তার মৃত্যু অনিবার্য।

ভয়ের কথাটা তাহলে কোথায়? আপনার শরীর থেকে রক্ত নিয়ে কালচারে পাঠান। দেখতে পাবেন, আপনি নিজেও অর্ধেক অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্টওয়ালা ব্যাকটেরিয়া নিয়ে বেঁচে আছেন।

আরও ভয়ের কথা হচ্ছে- যে ৩০০ জন মানুষ রেজিস্ট্যান্ট তাদের ঘরের মা বাবা সন্তান বা বন্ধু বান্ধবের অনেকেই অলরেডি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে আছে। কেউ অতি উৎসাহী হয়ে নিজের রক্ত কালচারের জন্য যেদিন হাসপাতালে পাঠাবেন, সেদিনই তারা ধরে ফেলবেন যে নিজের অজান্তেই তারা এইডসের চেয়েও ভয়াবহ একটি ব্যাপার নিয়ে এতদিন বেঁচে ছিল। আজ থেকে তার মৃত্যুর কাউন্টডাউন শুরু।

আমাদের শরীরের ব্যাকটেরিয়া যে হারে রেজিস্ট্যান্ট হচ্ছে, সে হারে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে না। জীবন রক্ষাকারী প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসুলিন আবিষ্কৃত হয় ১৯৪০ সালে। সবচেয়ে ক্ষমতাধর অ্যান্টিবায়োটিক মেরপেনেম আবিষ্কৃত হয় ১৯৮৩ সালে। এর মাঝামাঝি সময়টাতে আমার হাজার হাজার অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করলেও মেরপেনেমের মতো আর কোনও শক্তিশালি অ্যান্টিবায়োটিক পৃথিবীতে আসেনি। ফলে চার বছরের বাচ্চা ছেলেটি আপনাদের ভুলে পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছে। সে কি আমাদের ছেড়ে দেবে? তার শরীর থেকে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তার বাবা মাসহ অনেকের শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে। দায় মুক্তি আমাদের হবে পুরো মানবজাতি নিচিহ্নি হওয়ার পর।

প্রায় বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবী চলে যাবে ভিনগ্রহীদের হাতে। এলিয়েনরা পরবর্তী রাজত্ব করবে। বিশ্বাস করুন এলিয়েন আসার নিশ্চয়তা না থাকলেও এই পৃথিবীর পরবর্তী বাসিন্দা হবে নিতান্তই সাদাসিধা ব্যাকটেরিয়া। লাখ লাখ বছর সে আমাদের দেহে নিরীহ বসে ছিল। আমরাই তাকে শিখিয়ে ফেলেছি, কীভাবে আমাদের দেহে বসে আমাদেরকেই হত্যা করা যায়। এখন নিজেই প্রশ্ন করুন কে বেশি বুদ্ধিমান? ব্যাকটেরিয়া মাইক্রোস্কোপিক হয়েও, হাত পা না থাকা সত্ত্বেও মস্তিষ্ক না পেয়েই শিখে ফেলল কীভাবে মানুষকে হত্যা করতে হয়। এবার ভাবুন কে বেশি বুদ্ধিমান। সম্ভব হলে আজই ব্যবস্থা নিন।

কোন কোম্পনি বাজারে কয়টা অ্যান্টিবায়োটিক ছেড়েছে, কোন ডাক্তার কয়টা প্রেসক্রিপশন করেছে, কোন রোগী কয়টা খেয়েছে, সব হিসাব বের করতে হবে। আজ না পারলে আগামীকাল থেকে কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হবে, কীভাবে প্রেসক্রিপশন হবে, কীভাবে রোগী খাবে- সেটা নির্ধারণ করুন। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তাই আজ এখন এই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করুন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না। প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ম মেনে খাবেন। আপনার অনাগত প্রতিটি দিনে নিজেকে নিরাপদ রাখতে এটাই একমাত্র উপায়। তা না হলে আপনার অনাগত সন্তান বেঁচে থাকবে না ২০৭০ সাল দেখার জন্য।