ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর মানবিক দিক

ড. কামাল হোসেন

প্রকাশিত : ১১:০১ এএম, ১৭ মার্চ ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৬:০১ পিএম, ১৭ মার্চ ২০২০ মঙ্গলবার

মানবিক দিকটা বঙ্গবন্ধুর একটা বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা যায়। গাড়িতে গেলেও যেখানে আমাদের গরিব মানুষ থাকত, আমাদের টুকিরা যেখানে থাকত—তিনি তাদের দেখেই বলতেন, ‘এই দেখ দেখ আমার সমর্থক সব।’ আন্তরিকভাবে তিনি এটা বিশ্বাসও করতেন যে এরাই তার আসল সমর্থক। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি আর এখনকার রাজনীতি বেশ তফাত। অবশ্য এখনকার রাজনীতি হলো ব্যবসায়ীদের হাতে নিয়ে রাজনীতি করা। তবে এটা বুকভরেই বলা যায়, তখনকার রাজনীতি এমনটা ছিল না। ব্যবসায়ীদের টাকা তোলা, তা থেকে বঙ্গবন্ধু দূরে ছিলেন, খুব দূরে ছিলেন, টাকাপয়সার রাজনীতি তিনি করেনওনি, কাউকে করতে উত্সাহিতও করেননি। কেননা, তিনি যখন মারা গেলেন কিছুই রেখে যাননি। এই ৩২ নম্বর বাড়িটা বানানোর জন্য শহিদ সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছেন, এছাড়া ওনার সেরকম কোনো টাকাও ছিল না। আর রাজনীতি করে কারো কাছ থেকে টাকা আদায় করা, এটা তার স্বভাবের পরিপন্থি ছিল। উনি বলেন, তাজউদ্দিন বলেন, তারা তো বড়ো ধরনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। একজন জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রী আর তাজউদ্দীন ভাই বিশেষ বিশেষ সময়ে মূল দায়িত্ব পালন করেছেন। একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালীন দায়িত্ব নিলেন, সফলভাবে সেটা পালন করলেন, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে কিছুই রেখে যাননি। আমার মনে পড়ে, বেগম তাজউদ্দীন একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমার ভাই তো অনেক করলেন দেশের জন্য, কিন্তু আমাদের যে ছোট্ট বাড়িটা রেখে গেলেন, দেওয়ালগুলো ফেঁটে যাচ্ছে, মেরামত করার টাকা নেই।’ তখন আমরা টাকা তুলে ওনাকে দিলাম সবাই মিলে বাড়ি মেরামতের জন্য। এটা একটা গর্বের বিষয় ছিল।

আমাদের যারা মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন, জাতির পিতা বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ওনারা শুধু দিয়ে গেছেন, ব্যক্তিজীবনে কিছুই রাখেননি। সেজন্য তাদের পরিবারকে কষ্ট করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার মেয়েকে লন্ডনে আমি দেখেছি, বিভিন্ন রকম চাকরি করে তারা বিশেষ করে রেহানা চাকরি করেছে। এটা আমাদের গর্বের বিষয়। ওনাদের মাপের নেতা যারা, বিশেষ করে স্বাধীনতা অর্জন করার ব্যাপারে, তারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। কার্যকরভাবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছেন, আমাদের সেই শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য জেল খেটেছেন, কিন্তু নিজের জন্য তারা কিছুই করেননি। পরিবারের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি।

বঙ্গবন্ধু আমাকে ভালোবাসতেন, সেটা আমার বিশেষ সৌভাগ্য। সেই সোহরাওয়ার্দী সাহেব আমার মুরুব্বি ছিলেন, আমার বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দী সাহেব সার্টিফিকেট সব দিয়েছিলেন। ফিরে আসার পরও আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি যখন আসতেন, কেইস করতেন, তিনি যত দিন থাকতেন, আমি পাশে থাকতাম। তখন দেখি আমাদের মুজিব ভাইও ওনার কাছে আসতেন, ঘন ঘন। খুব বিশ্বাসী লোক হিসেবে তিনি ইয়ারপোর্ট পর্যন্ত ওনাকে আগাইয়া দিতেন। তিনি মানিক ভাইয়ের বাসার সেই বৈঠকখানায় থাকতেন, মুজিব ভাইও প্রায় সময়ই থাকতেন। অসাধারণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে। আমি লন্ডন থেকে শুনতাম শেখ মুজিবুর রহমান তরুণ নেতৃত্ব কার্যকরভাবে দিচ্ছেন যে, মুসলিম লীগকে একদম যুক্তফ্রন্টের সময় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছিল, এ ব্যাপারে মুজিব ভাইয়ের যে অবদান সেটা সবাই স্বীকার করবে।

মুজিব ভাই যেভাবে সংগঠন করলেন, মানুষের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন, জনসমর্থন অর্জন করলেন—এই অবদানটা ওনার উল্লেখযোগ্য। আমিও যখন লন্ডন থেকে ফিরে এসে পলিটিকসে যোগদান করি, মুজিব ভাই তখন বললেন, তোমাকে শুধু শহরে নয়, জেলায় জেলায় যেতে হবে, মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, সম্পর্ক করতে হবে, মানুষের কষ্ট বুঝতে হবে। আমি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখি, মুজিব ভাই কীভাবে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আমি যখন দীর্ঘদিন পর জেলায় জেলায় যাই, তখন মানুষ বলে, আমাদের মুজিব ভাই থাকতে এসেছিলেন, এত দিন পরও তখন বুঝতে পারি মুজিব ভাই কী করে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আর তিনি যে ঘন ঘন যেতেন, এত দিন পর বুঝলাম যে গণসংযোগের মূল জনসমর্থন অর্জন করার জন্য, এটাই ওনার রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল।

আমরা অনেক সময় বলি, উনি ভালো বক্তৃতা করতেন। ৭ই মার্চের বক্তৃতা দেখি। বাস্তবিকভাবে উনি অসাধারণ বত্তৃতা দিতেন। প্রত্যেক মানুষই ওনাকে শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। তিনি যে সহজ-সরল ভাষায় বত্তৃতা দিতেন, সেটা অল্প বয়সি মানুষেরও বুঝতে কোনো অসুবিধা হতো না। এই যে মুজিব ভাইয়ের মানবিক গুণটা, তা সে-ই পারে, যার হূদয় বড়ো, যে মানুষকে ভালোবাসতে পারে, মানুষকে আপন করে নিতে পারে। সেই মানুষটিই আমাদের মুজিব ভাই।
লেখক : রাজনীতিক

এসএ/