ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মিরপুরে করোনায় মৃত্যু নিয়ে আদ্যোপান্ত জানালেন ছেলে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৩৪ পিএম, ২২ মার্চ ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৮:৪৫ পিএম, ২২ মার্চ ২০২০ রবিবার

করোনাভাইরাসে রাজধানী মিরপুরের টোলারবাগে যে বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে, তার ছেলে আজ এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন আদ্যোপান্ত। বাবাকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটা ছুটি করে শেষ পর্যন্ত ভর্তি করেন ডেল্টা হাসপাতালে।

ব্যাংক কর্মকর্তা ওই ছেলে চিকিৎসা নিয়ে যে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। আইইডিসিআরের অসহযোগিতা তাদেরকে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি করে বলে জানান তিনি।

নিচে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

পিতার মৃত্যু এবং সন্তানের ব্যর্থতা-

আমি কখনো ভাবিনি যে আমার পিতার মৃত্যুর ঘটনা আমাকে এইভাবে লিখতে হবে, কিন্তু কিছু মিডিয়ার মিথ্যা রিপোর্ট দেখে আমি বাধ্য হলাম ফেইসবুকে কিছু সত্য প্রকাশ করতে।

গত ১৬ তারিখে আব্বা আসুস্থ বোধ করলে আমাদের ড্রাইভার ওই দিন বিকালে উনাকে কল্যাণপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসে। ওই সময় আমরা ভাইরা সবাই অফিসে। আমি অফিস থেকে বাসায় এসে শুনলাম ডাক্তার সাসপেক্ট করছে, উনার করোনা হয়েছে এবং কোভিড ১৯ টেস্ট এর জন্য সাজেস্ট করেছে। অতঃপর ওই রাত্রেই আমরা উক্ত টেস্ট এর জন্য IEDCR এর হান্টিং নম্বরে ফোন দেওয়া শুরু করি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তাদের সাথে আমরা যোগাযোগ করতে সমর্থ হই, তারা আমাদেরকে জানায় যেহেতু অসুস্থ ব্যক্তি বিদেশফেরত না এবং বিদেশফেরত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে উনি আসেননি সেহেতু এই টেস্ট উনার জন্য প্রযোজ্য নয়।

আমি তাদেরকে বলেছিলাম, উনি নিয়মিত মসজিদে যান এবং ওই খান থেকে এই ভাইরাস আসতে পারে কি না। তারা আমাদের বললেন যে, এই ভাইরাস বাংলাদেশের কমিউনিটিতে মাস লেভেলে এখনো সংক্রমিত হয়নি। সুতরাং আপনারা চিন্তা করবেন না, এটা সাধারণ শ্বাস কষ্টের প্রব্লেম। ওই রাত্রেই আনুমানিক ১০.৩০ এ আমি উনাকে শ্যামলীর একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং আমাদের পরিচিত একজন স্পেশালিস্ট ডক্টরকে দেখাই। উনি আমাকে বলেন, রোগীর নিউমোনিয়া হয়েছে, উনাকে নিউমোনিয়ার ট্রিটমেন্ট দিতে হবে, তবে বাংলাদেশের কোনো হাসপাতাল এই রোগীর ভর্তি নিবে না, আপনারা বাসায় ট্রিটমেন্ট করেন। আমি ওই রাত্রে বাসায় চলে আসি এবং আব্বাকে নেবুলাইজার এবং মুখে খাওয়া এন্টিবায়োটিক দিতে থাকি। পরের দিন ১৭ তারিখে দুপুরে আমি আব্বাকে নিয়ে যাই শ্যামলীর ওই হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। তারা রোগী দেখে বলেন যে, রোগীর অবস্থা ভালো না, উনাকে আইসিউ সাপোর্ট দিতে হবে কিন্তু তাদের আইসিইউ তারা দিতে পারবে না। এরপর আমি কেয়ার হাসপাতালে কথা বলি। ওরা বলে ওদের আইসিইউ খালি আছে। আমরা দ্রুত আব্বাকে নিয়ে কেয়ার হাসপাতালে যাই এবং আইসিইউতে ভর্তি করি। ১৫ মিনিট পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের বললেন, এই রোগী তারা রাখতে পারবে না।

অতঃপর আমরা রোগী নিয়ে কল্যাণপুরের একটি হাসপাতালে যাই। তারা আমাদেরকে কেবিন দিয়ে সাহায্য করে কিন্তু তাদের আইসিইউ খালি নেই। আমি তখন স্কয়ারে ফোন দিলাম আইসিইউ এর জন্য। কিন্তু স্কয়ার আমাদেরকে বলল, রোগী ছাড়া শুধু কাগজপত্র নিয়ে আসতে। তারা কাগজপত্র দেখে ভালো মনে করলে রোগী ভর্তি করবে। রাত আনুমানিক ১২.৩০ এ হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে বললেন, এই রোগীর আইসিইউ লাগবে, আপনারা দ্রুত আইসিইউ এর ব্যবস্থা করেন। আমি বিভিন্ন হাসপাতালে কথা বলতে থাকি, কোথাও আইসিইউ খালি নেই। অতঃপর ডেল্টা হাসপাতাল তাদের আইসিইউ দিতে রাজি হয়। আমি এবং আমার ছোট ভাই রাত্রে ৪টার সময় আব্বাকে নিয়ে ডেল্টাতে আসি এবং দুপুর ১২টার পর থেকে আব্বা লাইফ সাপোর্টে চলে যান।

১৮ তারিখ দুপুর থেকে আমরা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ IEDCR এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। অতঃপর ১৯ তারিখ বিকালে IEDCR রাজি হয় এবং রাত্রে টেস্ট করে এবং পরের দিন ২০ তারিখ দুপুরে তারা আমাদেরকে জানায় যে, রিপোর্ট পজিটিভ। আমাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলে ১৫ দিন।

রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর থেকে ডেল্টা হাসপাতাল আমাদের প্রেশার দিতে থাকে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়ার অনুমোদন দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা অনুমতি না দিয়ে তাদেরকে বলতে থাকি ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা আর রোগীর কাছেও যায়নি এবং আমাদেরকে আইসিইউ এর ভেতর ঢুকতেও দেয়নি। যা-ই হোক আমার আব্বু আবশেষে ২১ তারিখ ভোর ৩টার সময় ইন্তেকাল করেন।

আমরা সন্তানরা ব্যর্থ পিতার সঠিক ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করতে এবং এমনকি তার জানাজাতে উপস্থিত থাকতে। সন্তান হিসেবে, একজন পুত্র হিসেবে এর চেয়ে কঠিন কষ্ট আর কিছুই হতে পারে না। আমরা বুকে পাথর বেঁধে বাসায় অবস্থান করছি সরকারের আইন মেনে ১৫ দিনের জন্য। কিন্তু কিছু পেইজ এবং ফ্রন্ট লাইনের মিডিয়া আমাদেরকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে যে, আমার ভগ্নিপতি বিদেশ থেকে আমাদের বাসায় এসেছে, যেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমার দুই ভগ্নিপতি। বড় বোন এবং তার হাজবেন্ড চিটাগং এর দুটি সরকারি কলেজের অধ্যাপক। অন্য ভগ্নিপতি জাপান থাকে। সে গত এক বছরের মধ্যে দেশে আসেনি। আমার বাবা যেদিন আইসিউতে লাইফ সাপোর্টে চলে যান সে দিন মানে, ১৯ তারিখ আমার বড় বোন এবং দুলাভাই চিটাগং থেকে আমাদের বাসায় আসেন এবং বর্তমানে তারাও আমাদের সাথে হোম কোয়ারেন্টাইন পালন করছে।

আমাদের এই বিপদের সময় দয়া করে আমার পরিবার সম্পর্কে মিথ্যা রিপোর্ট করবেন না। এখন পর্যন্ত আমাদের পরিবারের বাকি সদস্যরা সুস্থ আছে। কারো মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা দেয়নি। আমার ছোট ভাই এবং ড্রাইভার অসুস্থ বোধ করায় কভিড ১৯ টেস্ট করানো হয়েছে, যার ফল নেগেটিভ এসেছে। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করেন এবং হেফাজত করেন বাংলাদেশের সবাইকে

আমিন..

এসি