ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

‘সোয়াইন ফ্লু’র আতঙ্কও এভাবে ছড়ানো হয়েছিল

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ০৫:২৩ পিএম, ২৩ মার্চ ২০২০ সোমবার | আপডেট: ১০:৫৮ পিএম, ২৩ মার্চ ২০২০ সোমবার

বর্তমানে করোনাভাইরাসে নাকাল পুরো বিশ্ব। এ ভাইরাস নিয়েও চলছে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা। এর আগে ঠিক দশ বছর আগে ২০০৯ সালের এপ্রিলে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে আবির্ভাব ঘটে নতুন এক রোগ। রোগটি ঠেকাতে দেশে দেশে নেয়া হয়েছিল বাড়তি সতর্কতা। কিন্তু এর মধ্যে একটি গ্রুপ তৈরি করেছিল মহা আতঙ্ক।

এটা প্রথম মেক্সিকোতে শনাক্ত হয়। তখন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় স্যাম্পল পাঠালে সেখানকার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেন, এটা খুব সিভিয়ার (মারাত্মক) ভাইরাস। ভাইরাসটি মূলত শূকরের মাঝেই পাওয়া যেত, যা ওই পশুটাকে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত করত। অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতই এটি শ্বাসনালীতে সংক্রমন করে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) ২০০৯ এর জুন মাসে বিশ্বের ৭৪টি দেশে নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের উপস্থিতির কারণে এই রোগের তৎকালীন অবস্থাকে বিশ্বব্যাপি মহামারি বলে চিহ্নিত করে। সংস্থাটির বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছিলেন, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন এবং কয়েক মিলিয়ন মানুষ মারা যাবেন। সারা পৃথিবী জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একটু হাঁচি কাশি দিলে হাসপাতালে ভর্তির হিড়িক পড়ে যায়।

ইংল্যান্ড সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা অধ্যাপক এন্ডারসন বলেন, এ মহামারি থেকে বাঁচার একটাই উপায়- ট্যামিফ্লু পিল খাওয়া। না হলে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবেন। 

তখন আতঙ্কিত হয়ে সব এন্টিফ্লু ও ভ্যাকসিনের অর্ডার আসতে লাগল। দশ বিলয়িন ডলার ঔষুধ ও ভ্যাকসিন বিক্রি হয়ে গলে অল্প সময়ের মধ্যে। পরে দেখা গেল, ২০০৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে যত লোক মারা গেছেন ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুতে মারা গেছেন অনেক কম লোক। আবার যারা মারা গেছেন তাদের অনেকেরই আগে থেকে ক্যানসার, ফুসফুসের অসুখ, এইডস, স্থুলতা, এ্যজমা, শ্বাস কষ্টের অসুখ ছিল। পরে যখন ইউরোপীয় কাউন্সিল পুরো বিশ্ব থেকে তদন্তের নির্দেশ দিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কেন এত আতঙ্ক ছড়াল। তখন দেখা গেল, সবচেয়ে বেশি যে ঔষুধ বিক্রি হয়েছে ট্যামিফ্লু। এর প্রস্তুকারক যে সুইস কোম্পানি ‘হফম্যান লা রশ’ ঐ ঔষুধ প্রস্তুতকারক এবং ঔষুধ আবার মূল উপাদান প্রস্তুতকারক হচ্ছে গ্লাক্সো স্মিথক্ল্যাইন।

দেখা গেল- হু বিশেষজ্ঞদের যে প্যানেল এটাকে মহামারি আকারে ঘোষণা করেছিল, তার একাধিক সদস্য হাফম্যান লা রশ এবং জিএসকে-এই কোম্পানিতে কাজ করতেন। এবং বৃটেন সরকারের যে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ছিলেন, প্রতি বছর জিএসকে থেকে ১,১৬,০০০ হাজার পাউন্ড সম্মানী পেতেন। মার্কিন সরকারের যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ডিভিশনের প্রধান, ন্যান্সি কক্স, তিনি হফম্যান লা রশ, এবং জিএস থেকে গবেষণা করার জন্য নিয়মিত অনুদান পেতেন। 

এবারও করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এমনভাবে আতঙ্ক প্রচার করা হচ্ছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি খুব অসহায়।’

সূত্রপাত
২০০৯ সালের মার্চে মেক্সিকোতে পাঁচ বছরের শিশু এডগার হার্নানদেজ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার লক্ষণগুলো ছিল জ্বর, মাথা ব্যাথা এবং গলা ব্যাথা। ডাক্তাররা তার অসুখকে সাধারণ ঠান্ডা জনিত বলে চিহ্নিত করেন। পরবর্তিতে তার স্যাম্পল কানাডাতে পাঠানো হয়। সেখানে বিজ্ঞানীরা এডগারে স্যাম্পলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস খুজে পান, যেটা মূলত শূকর হতে এসেছিল (সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা)। পরবর্তিতে দেখা যায় ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এডগাড়ের গ্রাম লা গ্লোরিয়াতে কয়েকশত মানুষ একই লক্ষণ জনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।

২০০৯ সালের মার্চে মেক্সিকোর দক্ষিণের রাজ্য ওক্সাকাতে ৩৯ বছর বয়স্কা তিন সন্তানের জননী এডেলা মারিয়া গুটিয়ারেজ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন। এর ঠিক পাঁচদিন পর গুটিয়ারেজ মৃত্যুবরণ করে। ডাক্তার প্রথমে তার মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া ধারণা করলেও তার স্যাম্পল কানাডাতে পাঠান এবং সেখানে দেখা যায় গুটিয়ারেজও একই শূকর হতে আসা ইনফ্লুয়েঞ্জা দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল যা কিনা এডগারের মাঝে পাওয়া যায়। মেক্সিকো সরকারের মতে এডেলা মারিয়া গুটিয়ারেজই সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারনে মৃত্যর প্রথম ঘটনা।

এই ভাইরাস প্রতিরোধে কোন প্রতিষেধক আছে কি?
এই ভাইরাস প্রতিরোধে মানবদেহে ব্যবহারের মতো কোন প্রতিষেধক নেই তবে শূকরের জন্য প্রতিষেধক রয়েছে। তবে এই ভাইরাসের সাথে মানবদেহের এইচওয়ানএনওয়ান ভাইরাসের বেশ মিল থাকায় সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক ব্যবহার করলে তা কিছুটা সুরক্ষা দেবে। তবে এই ভাইরাসের জন্য সাধারণ প্রতিষেধক কতটা কার্যকর হবে এ বিষয়ে গবেষণা চলছে যার ফলাফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে।

বাংলাদেশ ও ভারতে সোয়াইন ফ্লু
২০০৯ সালের ১৮ জুন বাংলাদেশে প্রথম সোয়াইন ফ্লু শনাক্ত করা হয়। ১৭ বছর বয়স্ক রোগী যুক্তরাষ্ট্র সফর করে দেশে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ সরকারের আইডিসিআর, আসিডিডিআর,বি ও সিডিসির সম্বন্নিত সার্ভাইলেন্স কার্যক্রমে রোগীর দেহে সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়। তবে রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন। বাংলাদেশে এ যাবৎ ১০২ জন ব্যক্তির মাঝে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস পাওয়া গেছে। যদিও কোন মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। ভারতে এ যাবৎ ২৭২২ জন সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। সোয়াইন ফ্লুতে ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা এ পর্যন্ত ৬০ জন। (সংকলিত)।

এমএস/এসি