ঢাকা, বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন বা সৎকারে যা করণীয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:১৮ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৪:২৯ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী শত শত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। শুধু আক্রান্ত ব্যক্তি নন, আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তাই করোনায় আক্রান্ত জীবিত মানুষের পাশাপাশি মৃত ব্যাক্তিও এখন ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় প্রিয়জনের মৃত্যুর পরে পাশে থাকতে পারছে না স্বজনরা। চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃতব্যাক্তির দাফন বা সৎকার করার বিষয়টি।

এরই মধ্যে চীনের পর বেশী আক্রান্ত ও মৃত্যুর নগরী ইতালি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বন্ধ ঘোষণা করেছে। অনেক আক্রান্তকে পরিবারের পক্ষ থেকে বিদায় জানানোর সময়ও দিচ্ছে না করোনা ভাইরাস। মৃত ব্যক্তিদের অন্তিম যাত্রায় যে মর্যাদা দেওয়া হয়, তা দিচ্ছে না ইতালি।

কিন্তু মুসলিম দেশ, তথা আমাদের দেশে আক্রান্ত ব্যাক্তির মৃত্যুর পর করণিয় কি তা হয়তো অনেকেই জানেন না। সেই সঙ্গে স্বাস্থ সংস্থাগুলোর দেওয়া পরামর্শ কী তাও অজানা রয়েছে। এমন কী ইসলাম এ বিষয়ে কী বলে তা জানা জরুরী। আসুন জেনে নেই করণীয় সম্পর্কে-

দাফন বা সৎকারসংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনা :

করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে পরিষ্কার করা বা ধোয়া যাবে না, নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়া ছোঁয়াও যাবে না। করোনা রোগে মৃত ব্যক্তির দাফন বা সৎকারসংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনায় এমন সতর্কতার কথা বলা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রটোকল অনুযায়ী নির্দেশনাটি তৈরি করা হয়েছে। মৃতদেহ থেকে অতিরিক্ত ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে নির্দেশনাটি তৈরি করা হয়েছে উল্লেখ করে এতে হাসপাতাল বা বাড়ি থেকে মৃতদেহ সংগ্রহ, পরিবহন, দাফনসহ প্রতিটি পর্যায়ের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা সন্দেহভাজন কেউ মারা গেলে মৃতদেহ সরানো, সৎকার বা দাফন শুরুর আগে অবশ্যই সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) জানাতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির নির্দেশনা অনুযায়ী, চার সদস্যের একটি দল সম্পূর্ণ সুরক্ষা পোশাক পরে মৃতদেহ সৎকার বা দাফনের জন্য প্রস্তুত করবে। মৃত্যুর স্থানেই মৃতদেহ প্লাস্টিকের কাভার দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে হবে। দলের নেতা মৃত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো অনুরোধ থাকলে তা জেনে নেবেন। কোথায় কবর দেওয়া হবে, সেটিও ঠিক করে রাখতে হবে।

মরদেহ গোসল :

ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে মরদেহ গোসল করানো যাবে না। পরিবারের অনুরোধ থাকলে মরদেহ গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম বা পানি ছাড়া অজু করানো যাবে। আর পরিবারের পক্ষ থেকে কাফনের কাপড়ের জন্য অনুরোধ থাকলে সেলাইবিহীন সাদা সুতির কাপড় কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কাফনের কাপড় প্লাস্টিকের ব্যাগে রেখে তার ওপর মরদেহ রাখতে হবে এবং দ্রুত ব্যাগের জিপার বন্ধ করতে হবে। ব্যাগে কাফনের কাপড় দেওয়ার সময় যারা মরদেহ উঁচু করে ধরবেন, তাঁদের অবশ্যই সুরক্ষা পোশাক পরে থাকতে হবে।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, মৃতদেহ সৎকারের জন্য মৃতদেহের সব ছিদ্রপথ (নাক, কান, পায়ুপথ ইত্যাদি) তুলা দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দিতে হবে, যাতে কোনো তরল গড়িয়ে না পড়ে। এরপর সংক্ষিপ্ত রুটে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃতদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে যেতে হবে।

মৃতদেহ পরিবহন :

যাত্রাকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মৃতদেহটি দাফন পরিচালনাকারী দলের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়িতে দুটি অংশ থাকতে হবে, যাতে চালক ও পরিবহন কামরার মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক কাচ বা প্লাস্টিকের আবরণ থাকে। পরিবহনের পর ব্যবহৃত বাহনটি জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এ সময় জীবাণুমুক্ত করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে অবশ্যই প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরতে হবে। দাফনের সময় মৃতদেহ বহনকারী ব্যাগটি কখনোই খোলা যাবে না।

দাফনের পর :

দাফনের পর কবর বা সমাধিস্থানটি ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার গভীর মাটির স্তর দিয়ে ঢাকার পাশাপাশি দাফন করা স্থানের আশপাশ উপযুক্ত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কারও করতে হবে।

এ ছাড়া মৃত ব্যক্তি যে স্থানে মারা গেছেন, সেই স্থানটিও যত দ্রুত সম্ভব জীবাণুমুক্ত করা এবং মৃতদেহ দাফনের পর সেই স্থান ভালোভাবে ঘিরে রাখতে হবে।

অন্যান্য নির্দেশনা :

করোনায় সন্দেহভাজন কারও মৃত্যু হলে সমান সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আইইডিসিআরে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এসে মৃত ব্যক্তির মুখের লালার নমুনা নিয়ে নিশ্চিত করবেন যে মৃত ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কি না।

করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ কখনোই ময়নাতদন্ত করা যাবে না। আর মৃতদেহ পোড়ালে দেহাবশেষ বা ছাই থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায় না।

আইইডিসিআর’র নির্দেশনা :

আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এ বিষয়ে জানান, নিজেদের ব্যবস্থাপনায় মৃত ব্যক্তির দাফন সম্পন্ন করা হবে। লাশ আইইডিসিআর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই প্যাকেট করে দেবেন এবং পরিবহনের ব্যবস্থাও করবেন।

মৃত ব্যক্তির লাশ প্যাকেট করার আগে আমরাই ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী, গোসল করিয়ে দেব। এরপর কাফনের কাপড় পড়িয়ে প্যাকেট করা হবে। সেই প্যাকেট কোনো অবস্থাতেই কেউ খুলতে পারবে না। প্যাকেট খুলে আত্বীয়-স্বজন লাশের মুখ দেখার সুযোগ নেই।

লাশ প্যাকেট করার পর তা খোলা হলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। এতে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। তাই যেভাবে আমরা প্যাকেট করে দিবো সেভাবে আমাদের লোক দিয়ে আমাদের ব্যবস্থাপনায় কবর দেয়া হবে।

করোনায় মারা যাওয়া রোগীর জানাজা :

আইইডিসিআর পরিচালক বলেছেন, ইসলামের বিধান অনুযায়ী, একজন মৃত ব্যক্তির জন্য যে ধরনের জানাজার প্রয়োজন হয় তাতে অংশ নিতে কোনো বাধা নেই। লাশ সামনে রেখে জানাজা পড়া যাবে এবং তাতে অংশ নেয়া যাবে।

ইসলাম কী বলে?

বর্তমান সময়ে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে ওই ব্যক্তিকে গোসল দেয়া, জানাজা দেয়া এবং দাফন করা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। সাধারণত কোনো মুসলমান মারা গেলে উপস্থিত মুসলিমদের ওপর ওই মৃত ব্যক্তির গোসল, জানাজা ও দাফন করা ফরজে কেফায়া। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে কেউ যদি মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তবে ইসলামের বিধান বা মূলনীতি কী হবে তা হয়তো অনেকেরই অজান।

এ ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি কী?

হাদিসে মহামারিতে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে শহীদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তি ঈমানদার হলে সেও শহীদি মর্যাদা লাভ করবে। আর এ ব্যক্তিকে শহীদ হিসেবে মনে করে গোসল, জানাজা না দিয়েই দাফন করা যাবে। বিশেষজ্ঞ আলেমরাও এমনটি মনে করেন।

আল ওয়াত্বান অনলাইন গণমাধ্যমে মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বোর্ডের প্রধান এবং সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য ড. আব্দুল হাদি যারে, তার একটি ফতোয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে যে-

‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অথবা এ জাতীয় কোনো অসুস্থতা বা রোগ-বালাই; যা ছড়িয়ে পড়তে পারে এ রকম আশংকা যদি থাকে এবং গোসল করানোর কোনো ব্যবস্থাই যদি না থাকে অর্থাৎ সতকর্তামূলকভাবেও যদি গোসল করানোর কোনো ব্যবস্থা না থাকে বা করতে গেলেই সমাজের অন্য মানুষের জন্য যদি তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় তবে সেক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে ‘তায়াম্মুম’।

আর তায়াম্মুম হলো কোনো ব্যক্তি তার হাত মাটিতে ফেলে সে হাত মৃত ব্যক্তির মুখ মাসেহ করে দেবে, হাত মাসেহ করে দেবে। এভাবে মৃত ব্যক্তিকে বিদায় জানাবে এবং দাফনের ব্যবস্থা করবে।

আর যদি তায়াম্মুমটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় এবং কোনোভাবেই তায়াম্মুম করানো না যায় তাহলে সেক্ষেত্রে এ ব্যক্তিকে গোসল এবং তায়াম্মুম ছাড়াও যদি দাফন করা হয় তাহলে কোনো অসুবিধা হবে না।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন-

‘অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর, শুন, আনুগত্য কর এবং ব্যয় কর। এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। যারা মনের কার্পন্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।’ (সুরা তাগাবুন : আয়াত ১৬)

তিনি এ আয়াত থেকে মত ব্যক্ত করেছেন যে, মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে গেলে অন্যদের ক্ষতি নিশ্চিত হয়ে গেলে সে কাজ না করলে কোনো গোনাহগার হবে না।

একই মত ব্যক্ত করেছেন, দারুল ইফতাহ আল মাসরিয়ার আমির শায়খ আহমদ মামদুহ। তিনি বলেন, গোসল করানোর চেষ্টা করতে হবে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে গোসল করাতে পানি স্প্রে করার মাধ্যমে তার শরীর ধুয়ে দেয়া যায় তাতেই চলবে। এ চেষ্টা করতে হবে। নতুবা তায়াম্মুম করাবে। একান্তই না পারলে কোনো অসুবিধা হবে না।

তবে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বিভাগের সাবেক প্রধান শেখ আব্দুল হামিদ আল-আতরাশ কিছুটা ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বিনা অজুহাতে কোনো মুসলমানকে গোসল দেয়া ছাড়া বিদায়/দাফন দেয়া জায়েজ হবে না। নিয়ম মোতাবেক অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তার গোসল ও জানাজা দিতে হবে।

সুতরাং যদি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন যে, করোনা বা মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার কারণে ওই মৃত ব্যক্তির শরীরে এ ভাইরাস রয়েছে এবং তার কাছাকাছি গেলে, তার গোসল দিলে কিংবা তার জানাজা দিলে অন্য সুস্থ ব্যক্তিদের আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির আশংকা রয়েছে বা প্রাণনাশের আশংকা রয়েছে তবে সে ক্ষেত্রে গোসল, জানাজা স্থগিত হতে পারে।

ইসলামের মূলনীতি :

মহামারি করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য কোনো সামাজিক কিংবা ধর্মীয় জনসমাগমে যাওয়া যেমন বৈধ নয়, তেমনি অন্য মুসলমানের ক্ষতি বা কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এমন মৃত ব্যক্তির গোসল, জানাজা ও দাফন দেয়া ছাড়া দাফনেও কোনো বাধা নেই।

কেননা, মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হলো-

‘যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’

(সুরা আহজাব : আয়াত ৫৮)

এছাড়া আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর কষ্টকর কোনো বিধান চাপিয়ে দেন না বলেও কুরআনে উল্লেখ করেন-

‘আল্লাহ তাআলা কারো ওপর তার ক্ষমতার বাইরে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।’

(সুরাবাকারা : আয়াত ২৮৬)

‘আল্লাহ তাআলা চান তোমাদের বোঝা হালকা করে দিতে এবং মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।’

(সুরা নিসা : আয়াত ২৭)

অতএব, এ কথা বলা যায় যে- সমাজের মানুষের ক্ষতি হলে ধর্মীয় বিধানেও কোন কঠরতা নেই। মানুষের ক্ষতি না করে যা করা উচিত তা করতে হবে। তাই প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোক, আবেক থাকলেও মানুষের ক্ষতি হয় এমন কিছু থেকে বিরত থাকতে হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ ঢাকার খিলগাঁও তালতলার একটি কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এটি নিয়েও দেখা গেছে জটিলতা। খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দাদের প্রতিবাদের মুখে দাফন নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে।

এসএ/