ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শুধু খাদ্য বিতরণ করে অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা যাবে না 

সাব্বির আহমেদ 

প্রকাশিত : ০৫:৩১ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৮:০৬ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার

করোনা ভাইরাস শুধু স্বাস্থ্যের এবং জীবনের জন্যই হুমকি নয় এটা অর্থনীতির জন্যেও বিরাট হুমকি। করোনার কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও বিরাট অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বলা হচ্ছে, এ দুর্যোগ ১৯৩৩ সালের মহামন্দা এবং ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের চেয়েও বড় হবে। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা করতে হবে দুই ফ্রন্টে। এক) স্বাস্থ্য ও জীবন সুরক্ষা; এবং দুই) অর্থনীতি চালু রাখা। কৃষি হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কৃষির উৎপাদন ব্যবস্থাটা এমন যে অনেক মানুষকে একত্রিত হতে কাজ করতে হয় না। মাঠের মধ্যে দূরে দূরে থেকে কাজ করা যায়। তাই করোনা কৃষি উৎপাদন ব্যহত করতে পারবে না। সমস্যা হচ্ছে শিল্প উৎপাদন নিয়ে। শিল্প কারখানায় অনেক মানুষকে প্রায় গাদাগাদি করে কাজ করতে হয় যা করোনা ছড়ানোর জন্য উর্বর ক্ষেত্র। তবে বিভিন্ন সুরক্ষা নিয়ে সেখানে কাজ করা সম্ভব। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ তা করছে এবং আমাদের এখানেও সুরক্ষা নিয়ে শিল্প উৎপাদন চালু রয়েছে। 

শুধু উৎপাদন করলেই চলবে না। অর্থনীতি চালু রাখতে হলে উৎপাদন, বিপণন এবং উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বজায় রাখতে হবে। করোনার কারণে প্রায় ৫.২ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে বা পড়তে যাচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষের সঞ্চয় নেই। তারা আয় করতে পারলে খেতে পারেন। এদের হাতে টাকা না থাকলে উৎপাদিত পণ্য কেনার মানুষ পাওয়া যাবে না। অর্থনীতি অচল হয়ে পড়বে। কর্মহীন মানুষদের মধ্যে শুধু খাদ্য বিতরণ করে এই বিরাট অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা যাবে না। বাজারের চাহিদা বজায় রাখতে হবে। চাহিদা তখনই থাকবে যখন প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য মানুষের হাতে নগদ টাকা থাকবে। 

নিম্ন আয়ের মানুষদের খাদ্যের অভাব হলে জেলা প্রশাসকদের খাবার সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসকেরা কি উপায়ে খাদ্য সরবরাহ করবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। ধারণা করা যায়, জেলা প্রশাসকদের উদ্যোগে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে লঙ্গরখানা খোলা হবে অথবা এক জায়গায় জড়ো করে টাকা, চাল, ডাল, তেল, নুন, ইত্যাদি দেওয়া হবে। যেভাবেই হোক না কেন এক জায়গায় অনেক মানুষের সমাগম হবে। এত মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করলে স্যোসাল ডিস্ট্যান্সিং বা সামজিক দূরত্ব মানানো প্রায় অসম্ভব হবে। আর তা করা না গেলে করোনা ছড়ানোর সুযোগ বাড়বে। তাছাড়া এভাবে খাদ্য সামগ্রী, টাকা পয়সা দেওয়া হলে মানুষের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। বাংলাদেশ এখন আর দরিদ্র দেশ নয়। মধ্যম আয়ের দেশের মত, ডিজিটাল বাংলাদেশের মত আচরণ এবং কাজ করতে হবে। 

মোট জনশক্তির (১৭ কোটি) ৫৮.৭% বা প্রায় ১০ কোটি মানুষ কর্মক্ষম। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট কর্মক্ষম মানুষের ৮৭% বা প্রায় ৮.৭ কোটি মানুষ কাজ করেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এর মধ্যে কৃষিখাতে নিযুক্ত জনশক্তি রয়েছে। মোট কর্মক্ষম মানুষের ৪০% বা ৩.৫ কোটি মানুষ কাজ করেন কৃষি খাতে। কৃষিখাতে নিযুক্ত মানুষেরা করোনার প্রভাবে কাজ হারাবেন না। বাকি প্রায় ৫.২ কোটি মানুষ কাজ করেন অকৃষি এবং অপ্রতিষ্ঠানিক খাতে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, দোকানপাট, হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, নির্মান শিল্প, বাস, ট্রাক, লেগুনা, ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের কাজ নেই। কাজ নেই তো মজুরী নেই। করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন এই নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এদের জন্য বিভিন্ন দেশ সরাসরি নগদ অর্থ সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে। সেসব দেশে সরকারের টাকা সরাসরি পৌঁছে যাবে এসব মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে (হিসাব)। বাংলাদেশ তা পারবে না কেন?

আমাদের দেশে সকলের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট (হিসাব) নেই, মোবাইল অ্যাকাউন্ট আছে অনেকের। সরকারের সেফটিনেটের টাকা সরাসরি অনেকের অ্যাকাউন্টে চলে যায়। অকৃষি এবং অপ্রতিষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করেন তারা দুঃস্থ বা বয়স্ক নন। তারা সেফটিনেটের টাকা পান না। তাদের জন্য জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করা কি খুব কঠিন কাজ? কঠিন সময়ে সঠিক কাজটা করতে পারতে হবে। অর্থনীতি চালু রাখতে হবে। তাহলে রক্ষা করা যাবে কাজ হারিয়ে, আয় হারিয়ে পথে বসে যাওয়া মানুষদের। দুঃস্থ, বৃদ্ধ, বিধবাদের সঙ্গে তাদের হাতে টাকা পৌঁছাতে পারলে বেঁচে যাবে ৫.২ কোটি মানুষ। 

বর্তমান পৃথিবীতে ডিজিটাল বাংলাদেশে লাইন দিয়ে চাল, ডাল, টাকা নেয়ার মত আদিম পদ্ধতি মানায় না। বাংলাদেশ এখন দরিদ্র নয় মধ্যম আয়ের দেশ। গরীব ও কর্মহীন মানুষদের হাতে ব্যাংক অথবা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পৌঁছাতে হবে। জনপ্রতি মাসে অন্তত ১,০০০ টাকা। তাতে এক জায়গায় ব্যাপক জনসমাগম রোধ করা যাবে, মানুষের মানবিক মর্যাদা অক্ষুণ থাকবে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিভাবে তা কম সময়ে করা যায় তা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

প্রতিটি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে তার এলাকার কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষের মোবাইল নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর সংগ্রহ করার দ্বায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। প্রধান শিক্ষকবৃন্দ নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকবৃন্দের সহায়তায় একটা তালিকা প্রস্তুত করে নিজে সকল শিক্ষকসহ স্বাক্ষর করে তা নিজ উপজেলার সমাজসেবা কর্মকর্তার নিকট জমা দেবেন। সমাজসেবা কর্মকর্তাবৃন্দ যার যার উপজেলার সকল স্কুল থেকে প্রাপ্ত তালিকা একটা এক্সেল সিটে অন্তর্ভূক্ত করে প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া তালিকার একটা ফটোকপি নিজে স্বাক্ষর করে তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট পাঠাবেন। মূল কপি নিজের দপ্তরে সংরক্ষণ করবেন। এভাবে তালিকার এক্সেল সিট জেলা প্রশাসক হয়ে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ে চলে আসবে। 

সমাজসেবা মন্ত্রণালয় সারা দেশের কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকাটি বিটিআরসিতে পাঠাবে তথ্যের যথার্থতা নিরীক্ষা করার জন্য। প্রতিটি টেলিফোন নম্বর একটা জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে দেয়া হয়েছে। বিটিআরসি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে তালিকার যথার্থতা নিরীক্ষা করে নির্ভুল তালিকা সরকারী মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’র কাছে পাঠাবে অটোমেটিক অ্যাকাউন্ট তৈরি করার জন্য। এরপর সরকার সেই অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেবে। এই পদ্ধতিতে কয়েক দিনের মধ্যে লাখ লাখ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস অ্যাকাউন্ট তৈরি করে কর্মহীন দরিদ্র মানুষের কাছে টাকা পাঠানো সম্ভব। 

এই পদ্ধতির দুর্বলতাসমূহ: 
১) প্রধান শিক্ষকদের নেতৃত্বে তৈরি করা তালিকা ১০০% নির্ভুল হবে না। ১০০% নির্ভূল কোন কিছু কোন দিন সম্ভব হয়নি, হবে না। 

২) সকল দরিদ্র মানুষের মোবাইল ফোন নেই। তবে করোনায় কর্মহীন নিম্ন আয়ের সকল মানুষের মোবাইল ফোন আছে বলে মনে করি। যাদের মোবাইল ফোন নেই বা ছিন্নমূল মানুষ তাদের ঠিকানায় সরকারের লোক বা সেচ্ছাসেবকবৃন্দ খাবার এবং নগদ অর্থ পৌঁছে দিতে পারবেন। এতে এক জায়গায় মানুষ জড়ো করার প্রয়োজন হবে না। দরিদ্র এবং ছিন্নমূল মানুষদের জন্য ভাসান চরে আবাসন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। 

৩) নিম্নতম পর্যায়ে হলেও দুর্নীতির সুযোগ থাকবে। 

প্রধান শিক্ষক এবং সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষদের তালিকা তৈরি করার সুবিধাসমুহঃ 

১) শিক্ষকেরা এখনো সমাজে অন্যদের তুলনায় সামাজিকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য অবস্থানে আছেন। অন্যান্য পেশার লোকদের তুলনায় তাঁরা কম দুর্নীতিগ্রস্ত।

২) একই স্কুলের সকল শিক্ষক এই তালিকা স্বাক্ষর করে সরকারী দফতরে জমা দেবেন। এতে কর্মহীন নিম্ন আয়ের এবং দরিদ্র নন এমন ব্যাক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ কমে যাবে। স্বজনপ্রীতির সুযোগ অত্যন্ত কম থাকবে। 

৩) সমাজসেবা মন্ত্রণালয় বৃদ্ধ ভাতা, দুঃস্থ ভাতা, বিধবা ভাতা, ইত্যাদির তালিকা আগে তৈরি করেছে এবং সে অনুযায়ী ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হচ্ছে। তাদের এ কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। 

৪) সরাসরি কেন্দ্র থেকে ‘নগদ’র মাধ্যমে টাকা পাঠানো হলে দুর্নীতির সুযোগ খুব কম থাকবে। 

৫) কর্মহীন দরিদ্র মানুষ সহজে এবং কম সময়ে সরকারের সাহায্য পাবেন।
 
৬) ডিজিটাল বাংলাদেশ সৃষ্টি করার সুফল সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেয়া যাবে। 

৭) মানবিক মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে।

প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে ৫.২ কোটি কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষের হাতে নগদ টাকা পৌঁছাতে পারলে চালু থাকবে অর্থনীতির চাকা। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে শুধু জীবন নয়, হুমকির মুখে রয়েছে অর্থনীতিও। অর্থনীতি চালু রাখতে হলে এক দিকে উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে আরেক দিকে উৎপাদিত পণ্য কেনার চাহিদা বজায় রাখতে হবে। ৫.২ কোটি মানুষের হাতে টাকা না থাকলে অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে। যার ফলাফল হবে ভয়াবহ। 

(২৫ মার্চ, ২০২০/ কলাবাগান, ঢাকা) 

লেখক: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালটেন্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসালটিং লিমিটেড।