ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: দানব আর মানুষের লড়াই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:৩৯ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২০ বৃহস্পতিবার

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ও তার সৃষ্টি দানব

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ও তার সৃষ্টি দানব

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবকে নতুন করে পরিচয় করে দেয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে হররপ্রেমী পাঠকদের কাছে  তার জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। সিনেমার দর্শকদের কাছেও যথেষ্ট সমাদৃত। বইয়ের পাতায় জীবন্ত হয়ে ওঠা এই দানবের প্রেমে পড়া পরিচালকদের ছোঁয়ায় রূপালী পর্দায় নতুন রূপে বেশ কয়েকবার হাজির হয়েছে সে। তারপরেও তাকে নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। 

তরুণ সুইস বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ইঙ্গোলস্টাড বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবদেহের শারীরতত্ত্ব নিয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। প্রাণের উৎস নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহী এই বিজ্ঞানীর স্বপ্ন ছিল তিনি এমন কিছু আবিষ্কার করবেন, যার বদৌলতে পুরো পৃথিবী তাকে আজীবন স্মরণ করবে। তিনি দিন-রাত মানবদেহ এবং এর বিভিন্ন টিস্যু নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। কীভাবে টিস্যু ধ্বংস হয় এবং পুন:রায় জন্মানো সম্ভব- এসব তথ্য নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতেন তিনি। তারপর একদিন হঠাৎ করে তিনি প্রাণের রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হলেন। ব্যস! ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে আর রুখে কে?

তিনি এবার এমন কিছু করে দেখাতে চাইলেন, যা এর আগে কেউ করতে সাহস পায়নি। বেশ কিছু প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গের সমন্বয়ে তিনি একটি অতিকায় প্রাণী সৃষ্টি করলেন। তারপর তার গবেষণাগারের অভ্যন্তরে বৈজ্ঞানিক কায়দায় বৈদ্যুতিক শকের মাধ্যমে এর ভেতর প্রাণের সঞ্চার করলেন। প্রাণের স্পর্শে জেগে উঠলো এক দানব! নিজের সৃষ্টির সামনে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এটি তার নিজের সৃষ্টি, সেটা যেন বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিলো তার। 

এমনকি তিনি নিজেই ভয় পেয়ে গেলেন এই দানবকে দেখে। তিনি নবজাতক দানবকে পরিত্যক্ত করলেন। নিজের মালিকের দ্বারা বিতাড়িত এই দানব উন্মুক্ত শহরে একাকী জীবন শুরু করে। এরপরই শুরু হয় দানবকে ঘিরে এক রোমাঞ্চকর গল্প।

প্রচন্ড শক্তিশালী এই দানবটি দেখতে কুৎসিত। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ভয় পেয়ে এই দানবের প্রতি অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করলে দানবটি হিংস্র হয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের সংকল্প করে। সে বনে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সে তার প্রতিশোধ শুরু করে ফ্রাংকেনস্টাইনের সহকারী ড. নীল ও একজন আয়া হত্যার মাধ্যমে। 

এরপর সে হত্যা করে তার সৃষ্টিকর্তার ভাইকে। এভাবেই সে বনে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং শত শত সাধারণ লোক হত্যা করে। সে ফ্রাংকেনস্টাইনের বিয়ের রাতে আবারও হানা দেয় দানবটি। নববধূসহ হত্যা করে তার পরিবারের বাকী সদস্যদের। এমন কী সে এক পর্যায়ে সয়ং তার সৃষ্টিকর্তাকেও মেরে ফেলে। তবে শেষে অবশ্য পুলিশের গুলিতে তারও মৃত্যু হয়!

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের রচয়িতা মেরি শেলী দেখিয়েছেন- কীভাবে সৃষ্টি স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বইটিতে স্রষ্টার অসহায়ত্ব চিত্রিত হয়েছে মূলত। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামক একজন বিজ্ঞান গবেষক মৃতকে প্রাণ দিয়ে অতিমানব তৈরি করতে গিয়ে যে বিপত্তি বাধায়, সেটিই মূলত বইটির উপজীব্য। তবে আড়ালে রয়েছে ভিন্ন সুর।

ইঙ্গিত রয়েছে সর্বশক্তিমান হিসেবে বিবেচিত ঈশ্বরের প্রতি। স্রষ্টার অবহেলায় সৃষ্টি কীভাবে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে, সেটিই তিনি দেখাতে চেয়েছেন এই উপন্যাসে। 

মৃতদেহ প্রাণ পাওয়ার পর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দেখলেন যে, সেটি অতিমানব হয়নি, হয়েছে অতিকায় এক দানব। আসলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভুল হয়েছিল। চেহারা এবং আকার আকৃতি দেখেই তিনি তার সৃষ্টিকে দানব জ্ঞান করেছিলেন এবং শুরু থেকেই ঘৃণা করেছিলেন। ফলে ‘দানবটি’ হয়ে ওঠে প্রতিশোধপরায়ণ। একে একে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন-এর পরিবারের সকলকে হত্যা করে সে।

পরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সাথে দেখা করে দানবটি আত্মপক্ষ সমর্থন করে এবং বলে, এবারে দানবটি যেন সত্যিই কেঁদে ফেলল, বলল—আমি জানি, আমার জীবনের সমস্ত দুঃখময় কাহিনী শুনলে তুমি আমাকে নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে। তুমি আমার স্রষ্টা, কিন্তু তুমিই আমার সমস্ত দুঃখের কারণ। তাই আজ তোমাকেই আমি শুধু বলতে চাই, কেন আমি হিংসাবৃত্তি নিলাম। তুমি ততটুকু শুধু ধৈর্য ধর। তারপর তোমার যা খুশি তাই করো। শুধু আজ আমার একটা কথা শোনো—।

দানবটি আরও বলে, “কিন্তু এই কুৎসিত কদাকার ভীষণ মূর্তি দেখে কেউ ভালোবাসে না, কেউ কাছে আসতে চায় না—দূরে সরে যায়। আমি একলা, একেবারে নিঃসঙ্গ। তুমি আমার প্রাণ দিয়েছ, কিন্তু রূপ দিলে না কেন? কেন আমায় এত কুৎসিত করে গড়ে তুললে? আর কেন তুমি তোমার সৃষ্টিকে ভালবাসতে পারলে না? প্রাণ দিলে, রূপ দিলে না। প্রাণ দিলে, সঙ্গী দিলে না। এই বিরাট পৃথিবীতে সকলে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করছে—আমি শুধু একা আমার দুঃখের বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তুমি কি বুঝতে পারো না যে, তুমিই তোমার সৃষ্টির উপর মর্মান্তিক অবিচার করেছ?”

লেখিকা বইটিতে দানবটিকে দায়ী করেননি, দায়ী করেছেন দানবটির স্রষ্টাকে, স্রষ্টার অবহেলাতেই সে দানব হয়েছে, নইলে আকৃতি যাই হোক, দেখতে যেমনই হোক দানব হওয়ার কোন ইচ্ছে তার ছিল না।

এরপর দানবটি বাঁচার আঁকুতি জানিয়ে তার স্রষ্টাকে বলছে- 
“হে আমার প্রভু, আমি একজন সঙ্গী চাই, আমি চাই ভালবাসা। আমি জানি কোন মানুষই আমার সঙ্গে মিশবে না। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আমার মতো আরেকটি কদাকার কৃৎসিত দানব সৃষ্টি করো—সে আমার সঙ্গী হবে। সে আমাকে ঘৃণা করবে না। আমরা পরস্পরকে ভালবাসব। এই দুর্বিসহ জীবনে তবেই পাব শান্তি।”

এই বলে দানবটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে হুমকি দেয়। যদি সে আরেকটা ওরকম দানব তৈরি না করে, তাহলে সে সারা পৃথিবী কান্নায় ভরে দেবে এবং তার জন্য দায়ী থাকবে তার স্রষ্টাই। মূলত এর পরেই শুরু হয় দানব আর মানুষের টিকে থাকার এক অসম লড়াই।

যেমনটা দেখা যাচ্ছে বর্তমান বিশ্বে- করোনা ভাইরাস নামে এক অদৃশ্য দানবের বিরুদ্ধেই অনেকটা অসম লড়াইয়েই অবতীর্ণ হয়েছে মানুষ। যাতে পৃথিবীর সর্বত্র হারাচ্ছে হাজার হাজার প্রাণ। 

এনএস/