ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গণমাধ্যম রক্ষার অজুহাতে মতলববাজদের নতুন পাঁয়তারা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:৪৭ পিএম, ১ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ১০:১৪ পিএম, ১ এপ্রিল ২০২০ বুধবার

বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল

বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল

করোনা ভাইরাসের এই মহামারির সময়ে গণমাধ্যম শিল্পের জন্য মতলববাজরা প্রণোদনার আব্দার করতে শুরু করেছে। প্রথমে সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে এই দাবি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তোলার চেষ্টা করা হয়। মতলববাজদের এই পাঁয়তারা আঁচ করতে পেরে গত ২৯ মার্চ বিএফইউজে এবং ডিইউজে এক যুক্ত বিবৃতিতে করোনার এই আপৎকালে অবিলম্বে গণমাধ্যম কর্মীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করার জোর দাবি জানায়। এতে মতলববাজরা বুঝে ফেলে, সাংবাদিকদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করা সহজ হবে না। তাই গতকাল এডিটরস্ গিল্ড একটি বিবৃতি দিয়ে সরকারের কাছে প্রনোদনার আব্দার করে ৬ দফা দাবি জানিয়েছে। 

তাদের দাবিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখুন, সরকারের সহায়তায় খাজানা ভরতে চায়। তারা বুঝে গেছে সামনে বড় দুঃসময়। তাই এখনই খাজানা ভরতে হবে। তাদের মনে এই আশংকাও আছে যে, টাকা না দিলে একসময় কেউ হয়তো কাজ করবে না। তখন সকল আরাম আয়েশ ত্যাগ করে পেটের ধান্ধায় নামতে হবে। আমি প্রনোদনার বিপক্ষে নই। তবে কথা আছে। কেন এবং কার জন্য এই প্রনোদনা?

বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ করোনা শনাক্ত হয়েছে। ১০ মার্চ থেকে সরকার সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। ২৬ মার্চ থেকে সকল সরকারি- বেসরকারি অফিস আদালত ছুটি ঘোষণা করা হয়। আজকে ৩০ মার্চ। এর মধ্যে সময় গেছে মাত্র ৪ দিন। সমাজের দিনমজুররাও মহামারির এই দুঃসময়ে ৩/৪ দিনের মাথায় খাদ্যের জন্য অন্যের কাছে হাত পাতেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, গণমাধ্যম মালিকদের কাছে কি ২/৪ মাস চলারমত টাকা নাই?
নিশ্চয়ই আছে কিন্তু দেবে না।

বর্তমানের এই আপৎকালে সরকার সমাজের সকল বিত্তবানদের প্রতি আহবান জানাচ্ছে তারা যেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সরকার প্রত্যেক ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরও বলছে, কর্মচারিদের বেতন ভাতা দিতে। সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে এখনো উল্লেখযোগ্য কোন গণমাধ্যম মালিক তার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারিদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেনি। অথচ গণমাধ্যম কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে অরক্ষিত অবস্থায় মাঠে ময়দানে থেকে কাজ করছে। শুধু তাই নয়, বেতন দূরে থাক কোন গণমাধ্যম মালিক তার অফিসে এবং অফিসের বাইরে সংবাদ কর্মীদের নূনতম সুরক্ষার ব্যবস্থা করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন তাদের বোধোদয় হচ্ছে না। সংবাদ কর্মীরাওতো মানুষ। তাদেরওতো জীবন-জীবিকা, পরিবার পরিজন আছে। বর্তমানে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত। সবাইকে ঘরে থাকার জন্য বলা হচ্ছে। এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই সংবাদ কর্মীদের হাতে নগদ অর্থ থাকা খুবই জরুরি। টাকা থাকলে তারা বাজারঘাট করে দিয়ে নিশ্চিতভাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু তা হচ্ছে না। সংবাদ কর্মীরা মালিকদের কাছে এই সময়েতো ধার কর্জ চাচ্ছে না। বকেয়া বেতনের দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু মালিকরা কান দিচ্ছে না। বরং তারা সরকারের কাছে প্রণোদনা চায়।

বিষয়টাকে যদি উল্টো দিক থেকে পর্যালোচনা করা হয় তা হলে কি দেখা যায়? একটু মিলিয়ে দেখুন। সরকার এক হিসেবে সারা বছর ধরেই গণমাধ্যমকে নানা ভাবে প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের দেওয়া এই প্রণোদনার কারণেই সারাদেশ থেকে হাজার হাজার পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে।

প্রিন্ট মিডিয়ায় সরকার বর্ধিতহারে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বিজ্ঞাপনের রেট বেড়েই চলছে। পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হোক বা না হোক সবাই নিয়মিত বিজ্ঞাপন পাচ্ছে। নিয়মিত বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি পায় বিশেষ বিশেষ ক্রোড়পত্র। বর্তমানে একটি দৈনিক পত্রিকা ডিক্লারেশন পাওয়ার পর ডিএফপির মিডিয়া তালিকাভুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই ওই পত্রিকার বিজ্ঞাপন রেট হয়ে যায় পার কলাম ইঞ্চি ৩৬০ টাকা। এখন পত্রিকায় সংবাদ কর্মী থাকুক বা না থাকুক নিয়মিত প্রকাশিত হোক বা না হোক তাতে কিছু যায় আসে না। বিজ্ঞাপন পাবেই। হিসেব করলে দেখা যাবে নওয়াব গং বাদে দেশের আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলো টেবিলে টেবিলে দিয়ে থুয়ে প্রতিমাসে ২০/৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। অথচ তাদের পত্রিকায় না আছে সাংবাদিক, না আছে কর্মচারি।

এসব বিষয়ে ইউনিয়ন থেকে একবার চিঠি দিয়ে মন্ত্রী ও মন্ত্রনালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হলেও ফল হয়েছিল উল্টো। বর্তমানে গণমাধ্যম মালিকদের নিজস্ব ও নিয়ন্ত্রিত সংগঠন আছে কয়েকটি। নোয়াব, বিএসপি, এ্যাটকো, এডিটরস্ গিল্ড সবগুলোই মূলতঃ মালিকদের সংগঠন। এসব সংগঠনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকে প্রতিষ্ঠানের শতভাগ মালিক, কেউ ৫০ ভাগ, কেউ ২৫ ভাগ, কেউ ১০,১৫, কিংবা ০৫ ভাগের মালিক। কিন্তু মতলববাজির জন্য তারা একেক নামে একেক সংগঠন বানিয়ে এবং দখল করে নিয়েছে।

প্রণোদনার বিষয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার হিসেবটা বললাম।

এবার ওভারগ্রাউন্ডদের দিকে তাকালে কি দেখা যায়? ওভারগ্রাউন্ড দাবিদারদের তিনটি স্তর আছে। একটি করপোরেট, অপরটি মোটাতাজা ব্যক্তি মালিকানার এবং শেষ স্তর হচ্ছে পরিবার লিমিটেড। করপোরেট গণমাধ্যম ওই গ্রুপের অপরাপর সকল ব্যবসার রক্ষা কবচ। মোটাতাজা ব্যক্তি মালিকানার পত্রিকা হচ্ছে ওই মালিকের নানা মূখী ব্যবসায়ী সুবিধার বার্গেনিং এজেন্সি। পারিবার লিমিটেড কোং গুলো নিজেদের স্বার্থে কাজ করে। এরা সবাই আবার তথ্য মন্ত্রনালয়ে দেওয়া এ্যাক্রেডিটিশন কার্ডধারি।

ফলে সকল মহলে তাদের অবাধ যাতায়ত। আর এতে করে সচিবালয়সহ সরকারের সকল দফতরে তদবিরবাজির অবারিত সুযোগ ভোগ করে। এতসব সুবিধাভোগ করার সুযোগওতো এক ধরণের প্রণোদনা নিশ্চয়ই।

এর বাইরেও আছে জমি-জমা, প্লট,ব্যাংক ঋণ, বিদেশ দৌড়া দৌড়ির নন চেকিং সুবিধায় ইত্যাদি ইত্যাদি বহু সুযোগ সুবিধা। এগুলোওতো প্রণোদনার আওতায় পড়ে নাকি। তাছাড়া বাংলাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার- বেসরকারি অফিস আদালতে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তার আগে বিজ্ঞাপন ব্যবসা ও আয়ে ব্যাঘাত ঘটার কোন অজুহাত দেখানোর সুযোগ নেই। শুধু বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে তাল বাহানা। এখনো পত্রিকা খুলে দেখুন কি পরিমাণ বিজ্ঞাপন। এডিটস্ গিল্ড প্রণোদনা চেয়েছে। কিন্তু সেটাকি শুধু তেলের মাথায় তেল দেওয়ার জন্য? নাকি সারাদেশের সকল গণমাধ্যমের জন্য! সেটাও পরিষ্কার নয়।

গণমাধ্যম হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। তারা যখন সরকারের আইন মানেনা, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও বলতে হয়, "আমরাতো দিয়েছি কিন্তু মালিকরা ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন না করলে কি করবো"। এবার যখন প্রণোদনা চায় তখন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ মাননীয় প্রধামন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই, এই সুযোগে একটি কমিশন গঠন করে দেখুনতো কে কত সুবিধা ভোগ করে আর বিনিময়ে তারা সংবাদ কর্মীদের বেতন-ভাতা ঠিকমত দেয় কিনা। এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এদেশের সংবাদ কর্মীরা গণমাধ্যমের জন্য প্রণোদনার মতলববাজির পাঁয়তারার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে।

এসি