ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

করোনা নিয়ে কি চীন ব্যবসা করছে?

মঈন বকুল

প্রকাশিত : ০১:৫৬ পিএম, ২ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৩:৪৬ পিএম, ২ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার

পশ্চিমের বেশিরভাগ অঞ্চল এখন করোনার হটস্পট। ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভারসাম্য রাখতে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো নাস্তানাবুদ হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ইইউসহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে চীন মাস্ক, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে সাহায্য করছে। অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও স্পেন চীনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, চীন কী মানবিকতার জায়গা থেকে সাহায্য করছে, নাকি একে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে চীন নিজেদের প্রভাব বিস্তার ও ব্যবসা করছে? এ প্রশ্ন এখন পশ্চিমা সমালোচক থেকে শুরু করে অনেকের।

বার্তা সংস্থা এএফপির বিশ্লেষণে বলা হয়, এর মাধ্যমে মহামারি মোকাবিলায় সমালোচনা এড়াতে চাচ্ছে চীন। একই সঙ্গে পাশ্চাত্য ও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তির প্রতিযোগিতা দেখানোর একটি সুযোগ পেয়েছে চীন।

বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, আলজেরিয়ার মতো অনেক দেশ চীনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে দ্বিধা করবে না। সার্বিয়ায় এরই মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে চীন। করোনা মহামারি মোকাবিলা নিয়ে শুরুতে সার্ব প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুসিস ইউরোপের ঐক্যের পক্ষে কথা বললেও পরে তিনি বলেন, একটি দেশই (চীন) আছে, যারা আমাদের সাহায্য করতে পারে। চীন সাহায্য পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার পর শি জিনপিংকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন ভুসিস। এ থেকে স্পষ্ট হয়, চীন করোনা যুদ্ধে নিজের প্রভাব বিস্তারের বিরাট সুযোগ লুফে নিয়েছে।

এরই মধ্যে চাপের মুখে পড়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে লাখ লাখ মাস্ক নিয়েছে। করোনার রোগীদের চিকিৎসায় ভেন্টিলেটরও দিচ্ছে বেইজিং। এ ছাড়া তাদের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের বেশ কয়েকটি দলও করোনা আক্রান্তদের সেবা দিতে ওই সব দেশে গেছেন। 

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, চীন থেকে ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাস, এ ভাইরাসকে পুঁজি করে ব্যবসা শুরু করেছে।

ট্রাম্প বলেন, মার্কিন বিজ্ঞানীদের কাছে ভাইরাসের উপাত্ত পাঠিয়েছে চীন। প্রেসিডেন্ট শি’র সঙ্গে ফোনালাপের পর তারা আরও তথ্য পাঠাচ্ছে।

‘চীনে তাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা নিয়ে আমরা কথা বলেছি। আমরা অনেক কিছুই জানতে পেরেছি,’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বললেন।

তবে চীনের দাবি, মার্কিন সেনাদের গবেষণাগার থেকে উহানে ছড়িয়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। অর্থ, ওষুধ, নার্স ও চিকিৎসক দিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বে অন্য যে কোন মহাদেশে তারা এ ভাইরাস মোকাবেলায় তাদের অভিজ্ঞতা ও সহায়তায় প্রস্তুত।

এদিকে, কয়েকদিন আগে চীন থেকে পাঠানো করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কিট ‘ত্রুটিপূর্ণ’বলে জানাল স্পেন ও চেক প্রজাতন্ত্র। চীনের কাছ থেকে কেনা করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ কিটে ত্রুটি পাওয়া গেছে বলে সতর্ক করেছে স্পেনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।

তারা বলছে, চীন থেকে আনা কিটগুলো দিয়ে শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ধারাবাহিক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। ভাইরাস শনাক্ত করার ক্ষেত্রে কিটগুলো ৩০ শতাংশের কম কার্যকর হওয়ায় সেগুলো ব্যবহারের অযোগ্য বলে জানিয়েছে স্পেনের স্বাস্থ্য বিভাগ।

তবে এসব বিষয়ে প্যারিসের ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের (এফআরএস) রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এন্টোইন বন্ডাজের বলেন, জানুয়ারি মাসে ইইউ সাহায্য পাঠালেও চীন নিজেদের বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছে। তখন দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের সামরিক অবস্থান ও প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ের সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে পশ্চিমা শক্তির মধ্যে তীব্র উত্তেজনা চলছিল। তবে কভিড-১৯ এখন চীনের সঙ্গে ওই সব দেশের আদর্শিক লড়াইয়ে জ্বালানি জোগাচ্ছে।

ইইউ ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ অ্যালিস একমন বলেন, (বেইজিং) তাদের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ দেখাতে আন্তর্জাতিক সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। করোনা মোকাবিলায় সাহায্য করায় ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরজুলা ফন দেয়ার লায়েন ১৮ মার্চ বেইজিংয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তবে উষ্ণ সে সুরটি এখন তেতো হয়ে গেছে। ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল গত সপ্তাহে ইউরোপকে ‘আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’ প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। 

তিনি আরও বলেন, ইউরোপের সৌজন্যের রাজনীতির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ করোনা যুদ্ধের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক উপাদান পেঁচিয়ে রয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, চীন প্রথমেই নিজ দেশের করোনা মহামারিকে ধামাচাপা দিয়ে ফেলেছে। বিষয়টি তাদের দ্রুত বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে এবং বিশ্বব্যাপী নিজেদের অবস্থান জানান দিতে সাহায্য করেছে। বোরেলের সুরেই কথা বলেছেন ফ্রান্সের ইউরোপিয়ান অ্যাফেয়ার্স প্রতিমন্ত্রী অ্যামেলি ডি মৎচালি। 

চীনের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কখনও কখনও ভুয়া তথ্য ও মেকি ভাব প্রচার এবং প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা খুব সহজ হয়ে যায়।’ তবে মঙ্গলবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোন চীন থেকে অতিপ্রয়োজনীয় মাস্ক আমদানির কথা জানান। নভেল করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল নিয়েও পশ্চিমাদের সঙ্গে একমত নয় চীন। 

চীনের উহান থেকে উৎপত্তি হওয়া করোনা ভঅইরাস এখন বিশ্বজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করেছে। সারাবিশ্বে প্রাণহানি প্রাণহানি ঘটেছে ৪৭ হাজারেরও বেশি। এছাড়া আক্রান্ত হয়েছেন ৯ লাখ প্রায় ৩৬ হাজার মানুষ।

করোনায় মৃতদের মধ্যে শুধু ইউরোপেই ৩০ হাজারেরও বেশি। যার সবচেয়ে ভুক্তভোগী ইতালি। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৩ হাজার ১৫৫ জন। যেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৫৭৪ জনে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মানুষ মারা গেছে প্রতিবেশি স্পেনে। প্রতিদিনই সেখানে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হচ্ছে। দেশটিতে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ৯ হাজার ৩৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট আক্রান্ত ১ লাখ ৪ হাজার ১১৮ 

প্রাণহানিতে ইউরোপের এ দুই রাষ্ট্র (ইতালি ও স্পেন) এগিয়ে থাকলেও ভয়াবহ সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। করোনার হানায় দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে। 

এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ভারতে। দেশটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩২৮ জন। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ছুঁই ছুঁই। মৃত বেড়ে ৫৮ জনে পৌঁছেছে। 

পাকিস্তানে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ১১৮ জন, প্রাণহানি ঘটেছে ২৭ জনের। নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারেও এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।

আর বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও দুইজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে।  এ নিয়ে দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৫৬ জনে। 

এমবি//