ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মানবেরে রুধিবে কে?

রাশেদ আহমেদ

প্রকাশিত : ০৬:৩৩ পিএম, ৩ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার

স্টিভেন সোডারবার্গ পরিচালিত ‘কনটাজিওন’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১১ সালে। কিন্তু এতোদিন পর এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এই ছবিটি। এর চিত্রনাট্যকার স্কট জেড বার্নস এর কল্পনা শক্তিতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। বিশ্বে এখন করোনা ভাইরাস যেভাবে সংক্রমিত হয়ে মহামারি সৃষ্টি করেছে একই রকম গল্প দেখানো হয় ৯ বছর আগে নির্মিত ‘কনটাজিওন’ ছবিটিতেও। সিনেমায় মরণঘাতি ভাইরাসের উপস্থিতিস্থলও ছিল চীন দেশে। আকাশে উড়ে চলা বিমানে এক যুবকের প্রথম মৃত্যু ঘটে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। এরপর বিমানটির সব যাত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয় কোয়ারেন্টিনে। এরপরও ছোঁয়ার কারণে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ, এশিয়া, আমেরিকায়। 

ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সবাই মাস্ক ব্যবহার শুরু করেন। চিকিৎসকরা পিপিই(পার্সনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুপমেন্ট) পড়ে স্বাস্থ্য সেবা দিতে থাকেন। এরপরও মৃত্যুর মিছিল থামে না হতে থাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। স্তুপ করা মরদেহ ট্রাকে করে নিয়ে মাটি চাপা দেয়া হয়। নিয়মিত ছবি তুলতে থাকা এক নারী সাংবাদিক আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ার আগে তার ছবিটি তুলতে বলেন চিকিৎসককে। কষ্টকর এক অনুভুতি।

এক শিশু যখন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পথযাত্রী তখন চিকিৎসক অস্থির হয়ে যান ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়ার আকাংখায়। তার প্রতীক্ষা শেষ হতে চায় না। সিনেমাটি শেষ হয়েছে প্রতিষেধক আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। শেষ মুহুর্তে বেঁচে যায় মায়াবি ঐ শিশুটি।

আমার লেখার আগ্রহ ছবির শেষ দৃশ্য থেকে। প্রতিষেধক আবিষ্কারের পর সবার মধ্যে যে খুশির ঝলক দেখানো হয়েছে তাতে আমিও উৎফুল্ল হয়েছি। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করেছিল মানবেরে রুধিবে কে? বিশ্বে বর্তমান বাস্তবতায় যদি কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার না হয় তা হলে মানুষ টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। এভাবে বন্দী জীবন আর কতো দিন? আকাশে বিমান উড়বে না, সাগরে জাহাজ চলবে না, মহাসড়কে যানবাহনের হর্ন থাকবে না। অর্থনৈতিক অবস্থার বিপর্যয় ঘটবে। কতো দিন আর? এক সময় মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে বের হবে আর সংক্রামণ ছুঁতে ছুঁতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে প্রানঘাতি বাড়াতে থাকবে। 

আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না অতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাসের কাছে চিকিৎসা বিজ্ঞান হেরে যাবে। মানুষ হেরে যাবে। মানুষের তো এখনও অনেক দূর যেতে বাকী। চাঁদে বসবাস শুরু হয়নি। মঙ্গল গ্রহে এখনও যাওয়া হয়নি। কিছুদিন আগে যে কৃষ্মগহ্বর আবিষ্কার হলো তা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হয়নি। সৌরজগতে কতো নক্ষত্র এখনও অনাবিষ্কৃত। 

পৃথিবীতে এর আগেও কত ভাইরাস কত ফ্লুর আবির্ভাব ঘটলো? সেগুলো কি টিকতে পেরেছে? খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ সালে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে একটি রোগের উদ্ভব হয়েছিল। বর্তমান লিবিয়া, ইথিওপিয়া, মিশরে এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে জাস্টিনিয়ান প্লেগ রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল ফিলিস্তিন ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য জুড়ে। এই রোগ পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে চলে। একাদশ শতাব্দীতে কুষ্ঠ রোগ মহামারি আকার ধারণ করেছিল মধ্য ইউরোপে। ১৩৫০ সালে ব্ল্যাক ডেথ রোগের আবির্ভাব হয়েছিল এশিয়ায়। সেই মহামারি ছড়িয়েছিল ইউরোপে। ১৬৬৫ সালে গ্রেট প্লেগ নামে রোগে লন্ডনে ২০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

এরপর কলেরা, রাশিয়ান ফ্লু, স্প্যানিশ ফ্লু, এশিয়ান ফ্লু, যক্ষা, গুটিবসন্ত আঠারো ও উনিশ শতকের মধ্য সময় পর্যন্ত মহামারি আকার ধারণ করেছিল। প্রতিটির প্রতিষেধক আবিষ্কার করে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। বছর তিরিশেক আগে এইচআইভি ছড়ায়। এরপর আফ্রিকায় ছড়ায় ইবোলা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে সার্স ছড়িয়েছিল মহামারি ছড়িয়েছিল। সেগুলো প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে।
আমরা এখন তাকিয়ে আছি করোনার প্রতিষেধকের দিকে। গবেষকরা দিনরাত ঘাম ঝরিয়ে যাচ্ছেন একটি সুসংবাদ দেয়ার জন্য। কনটাজিওন সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো আবিষ্কারের আনন্দে আমরা হাসতে চাই। তখন চিৎকার করে অবশ্যই বলবো মানবেরে রুধিবে কে? এ সাধ্য কার। 

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশন। 

এমএস/