ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পরপারে কবি ছড়াকার নাসের মাহমুদ 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৫৪ পিএম, ৩ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:৪৪ পিএম, ৩ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার

কবি ও ছড়াকার নাসের মাহমুদ- সংগৃহীত

কবি ও ছড়াকার নাসের মাহমুদ- সংগৃহীত

কবি ও ছড়াকার নাসের মাহমুদ মারা গেছেন। আজ শুক্রবার রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সত্তরের দশকের জনপ্রিয় ছড়াকার নাসের মাহমুদের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪। স্ত্রী ও দু’সন্তান কুশল ও সুফল কবির পাশে ছিলেন। ছড়াকার নাসের মাহমুদের ভাই চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান জুয়েল। অন্য ভাইয়েরা ব্যবসায়ী ও আমেরিকাপ্রবাসী। 

পারিবরিক সূত্রের বরাত দিয়ে নাসের মাহমুদের স্নেহধন্য সাংবাদিক ড. অখিল পোদ্দার জানিয়েছেন, রাত ১১টা পর্যন্ত তাঁর মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে থাকবে।

ছড়াকার নাসের মাহমুদ ছিলেন ছড়া-কবিতার কুশলী কারিগর। ছন্দের আধুনিকতা ও বিষয় বৈচিত্র্যে তাঁর দক্ষতা লক্ষণীয়। ১৯৫৬ সালের ১লা জুলাই তিনি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মরহুম শাহ লুৎফর রহমান ও মা সুফিয়া রহমান। পৈতৃক বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পাংশার উপজেলার ভাতশালা গ্রামে। তাঁর জীবনের সিংহভাগ কেটেছে কুষ্টিয়ায় তাঁর প্রিয় শহরে। পাংশার ভাতশালা তাঁর প্রিয় গ্রাম।
 
নাসের মাহমুদের ছেলেবেলা ও কৈশোর কেটেছে করাচি, কোয়েটা, লাহোর, মুলতান, পেশোয়ার, ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুরের ধনাগোদা তালতলী ও রাজবাড়ীর ভাতশালা গ্রামে। একুশে টেলিভিশনের হেড অফ ইনপুট ড. অখিল পোদ্দার আরও জানান, কবি নাসের মাহমুদকে আমরা জানতাম সক্রেটিস হিসেবে। যেকোন সমস্যা নিয়ে গেলে তিনি তা হাসিমুখে সমাধান করে দিতেন এবং যথাযথ যুক্তি দিয়ে। তিনি ছিলেন প্রখর জ্ঞানের অধিকারী এবং প্রবল যুক্তিবাদী। পড়াজানার গন্ডি ছিল বিশাল। এখন তিনি মহাকালের আদিঅন্তহীনতায় সমর্পিত। কিন্তু তাঁর আলো চারপাশে প্রোজ্জ্বলিত। করোনাকাল শেষ হলে বিশেষ সময়ে তাঁর গুণগ্রাহীদের সঙ্গে কথা বলে স্মরণসভার আয়োজন হবে।  

ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন নাসের মাহমুদ।ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, খেলাঘর, উদীচী ও অঙ্গীকার চলচ্চিত্র সংসদ যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রথম সারির নেতাও ছিলেন তিনি।  

নাসের মাহমুদ বাংলাদেশ ছড়া একাডেমীর উদ্যোক্তা পরিচালক। বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমী (চট্টগ্রাম), বাংলাদেশ লিমেরিক সোসাইটি (চট্টগ্রাম), লালন একাডেমী (কুষ্টিয়া), বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি (কুষ্টিয়া)-র জীবন সদস্য ও বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক। 

নাসের মাহমুদ ছড়া সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্মৃতিপদক ও বিশেষ সম্মাননা ২০১৪ লাভ করেন।  তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৭টি। এর মধ্যে , ছড়ার বই ১২টি, কবিতা ও ছড়াকাহিনীর বই একটি করে, যৌথছড়ার বই ৩টি ও সম্পাদিত বই ১০টি।

ছড়াকার নাসের মাহমুদ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কুষ্টিয়া এবং সে গণ্ডি পেরিয়ে তার তীর্যক ছড়াগুলো ঢাকা পর্যন্ত যে প্রতিবাদী বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল তা তার সমসাময়িক কবি, ছড়াকাররা খুব কমই করতে পেরেছিলেন। তাঁর রম্য, মিঠেকড়া ছড়া এদেশের সাহিত্যের ছড়া শাখাকে শুধু পুষ্টই করেনি, সৃস্টি করেছে নতুন আনন্দমোহন ক্ষেত্র। তার কবিতার হাতটিও ভিন্ন দ্যোতনার। 

ছড়াকারের আছে মৌলিক অনেক শিশুতোষ ছড়ার বই। বড়দের জন্যও আছে বেশ কয়েকটি কবিতা গ্রন্থ। এপার বাংলা ওপার বাংলার কবিদের, গদ্য লেখিয়েদের গল্প নিয়েও তার সম্পাদিত কিছু গ্রন্থ আছে। এদেশের প্রায় সকল দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকায় প্রচুর লেখা আছে তাঁর। বাম ঘরানার নাসের মাহমুদ সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখতেন।

এই ছড়াকারের বাল্যবন্ধু ডা. আহসানুল হক নবাব বলেন, ‘নাসের মাহমুদ এ দেশের ছড়া সাহিত্যের একজন দিকপাল ছড়াকার। ছড়ায় প্রতিবাদ করা যায়, ছড়ায় সমাজের বৈষম্য, সমাজের কুৎসিত কদাকার অসঙ্গতি ফুটিয়ে তোলা যায়- সেটা তার মত করে আর কেউ এদেশে আঁকতে পারেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘শেষ বয়সে নাসের স্নায়ুরোগ এবং স্মৃতিভ্রস্টতায় ভুগছিলেন। প্রিয় চায়ের কথা সারাদিনে একবারের জন্যও মনে করতে পারত না। এক কালে তার কি অনেক বন্ধুজন, সুহৃদ ছিলো, ছিল উচ্ছল, বর্ণিল জীবন। এখন তাঁকে দেখে তা আর মনে হয় না। তাঁকে দেখে দুখু নজরুলকে মনে পড়ে।’

কবি ও ছড়াকার নাসের মাহমুদের অন্যতম সুহৃদ ছড়াকার ও রম্যলেখক আলী হাবিব। দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার সিনিয়র সহকারি সম্পাদক আলী হাবিব বলেন, ‘ছড়া যে কতোটা ক্ষুরধার হতে পারে তা নাসের মাহমুদের লেখা না পড়লে বোঝা বড় দায়। দেশ ও রাজনীতির ক্রান্তিকালে তিনি ছড়ার মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিলেন। তাঁর আড্ডার ভাষাও ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত,গভীর ও নিখাদ। ঢাকার রাস্তায় নিউন সাইন ও ইউনিপোলে বিভিন্ন ব্যাংকের শিক্ষণীয় বিজ্ঞাপনে তাঁর ছড়া শোভা পাচ্ছে।’

এ দিকে তাঁর মৃত্যুতে তার শুভাকাংখীসহ কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিব্যক্তিরা স্মৃতিচারণ করেছেন। মাছরাঙা টিভির বার্তা প্রধান রেজোয়ানুল হক রাজা বলেন, ‘নাসের ভাইয়ের হাসি মুখটা খুব মনে পড়ছে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।’ প্রবীণ সাংবাদিক সনৎ নন্দী বলেন, ‘নাসেরের সাথে আমার পরিচয় ৮০ দশকের প্রথম দিকে। তাঁর সঙ্গে আমার প্রচুর স্মৃতি। আমার সাথে তার পারিবারিক সম্পর্ক। দীর্ঘদিন প্রচণ্ড অসুস্থ ছিল। ও আমার আপনজন।’

চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র বার্তা সম্পাদক ও ছড়াকার আদিত্য শাহীন বলেন, ‘তিনি রাজবাড়ীর মানুষ হলেও কুষ্টিয়ার মানুষ তাকে কুষ্টিয়াতেই পেয়েছে গত ৪০ বছর। নাসের ভাই লিখেছেন মানুষের চোখ খুলে দিতে। সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন অন্যায়, অবিচার আর নীতিহীনতার বিরুদ্ধে। ছড়া ছিল তার অস্ত্র।’ নাট্যজন ও সিনিয়র সাংবাদিক রনজক রিজভী বলেন, ‘বাল্যকাল থেকে তাঁর সঙ্গে আমার সখ্যতা এবং একসঙ্গে বোধন থিয়েটারের একটি প্রকাশনার স্মৃতি মনে পড়ছে। নাসের ভাই শূন্যে ভালো থাকবেন।’ স্মৃতিচারণ করেন তাঁর স্নেহধন্য সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম মনিসহ অন্যরা। 

ছড়াকার নাসের মাহমুদ যে কতটা মানবিক ছিল তা বোঝা যায় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিগত রবিউল আলম বাবুলের একটি স্মৃতিচারণ থেকে। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে তিন বছর আগে আমার ফেসবুকে একটি পোস্টে মেধাবী ছাত্রী ইকরার কিডনি সমস্যার জন্য সাহায্যের আবেদন করেছিলাম। আমার সঙ্গে পরিচয় ছাড়াই যে মানুষটি নির্দ্বিধায় নিজের একটি কিডনি দান করার প্রস্তাব রাখতে পারেন সেই মানুষটি আজ বিকেলে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন আপন ঠিকানায়!’
দৈনিক গড়ব বাংলাদেশের প্রধান সম্পাদক ডা. উজ্জ্বল রায় বলেন, ‘এমন অভিভাবকের অসময়ে চলে যাওয়া সত্যি সত্যিই খুব কষ্টের। বছর দুই আগে শেষ দেখা হয়েছিল বারডেমে। ভালো থাকবেন প্রিয় নাসের মাহমুদ।’ প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল বারী বলেন, ‘১৯৮৬ সাল থেকে ছড়াকার নাসের মাহমুদকে চিনতাম। কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশন থেকে গোয়ালন্দ পরে দৌলতদিয়া হয়ে অনেকবার ঢাকা যাতায়াত করার স্মৃতি আজো মনে পড়ে।’

চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র রিপোর্টার জাহিদুজ্জামান বলেন, ‘যে সময় দৈনিক কুষ্টিয়া পত্রিকায় কাজ করতাম ওই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন সঞ্জয় চাকী। সে সময় সঞ্জয় চাকীর সাথে কবি ছড়াকার নাসের মাহমুদের ছিল খুব গভীর সম্পর্ক। সেই সূত্র ধরে তার সাথে পরিচয়। অনেক কথা হতো।নাসের ভাই আমাদের সবাইকে ভালোবাসতেন। তার হাসিমুখ আজও মনে পড়ে।’
কানাডাপ্রবাসী সাংবাদিক সন্জয় চাকী কবি নাসের মাহমুদের অবদান তুলে ধরেন নানান নিরীখে। তিনি বলেন, ‘শিগগিরিই কানাডাতে নাসের মাহমুদের ঘনিষ্টজনদের নিয়ে স্মরণসভার আয়োজন করা হবে।’

এমএস/