ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মানবতার মুক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত : ০৮:৫১ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:০২ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

আজ ৭ই এপ্রিল। আমার জীবনে এই তারিখটির বড় এক তাৎপর্য আছে। ২০১৯ সালের ঠিক এ দিনটিতে বর্তমান কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে যোগদান করেছিলাম। দেখতে দেখতে একটি বছর কেটে গেল! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই বন্ধুরা দুষ্ঠুমি করে ‘প্রফেসর’ বলে  ডাকতো; নিজের মধ্যে অজান্তেই স্বপ্ন বুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব; পড়ব, পড়াবো, শিখব, শিখাবো, জানব, জানাবো আরো কত কি। এটা আমার জন্য কেবল একটা চাকরি বা পেশার নাম নয়, একটি স্বপ্ন বা প্যাশন বটে। যেকোন বার্ষিকীতে মানুষ দুইটা কাজ করে। এক, গত হওয়া বছরটা কেমন ছিল তা মূল্যায়ন করে। দুই, আগত বছরটা কিভাবে কাটাবে তার রেজ্যুলেশন বা পরিকল্পনা করে। সব স্বাভাবিক থাকলে আমিও হয়তো তাই করতাম। কিন্তু পুরো দুনিয়া জুড়ে যে সংকট চলছে তার আঁচ খুব ভালভাবেই লেগেছে আমাদের সোনার টুকরো দেশটায়। তাই এই দুর্দিনে সেই খোশগল্পে না গিয়ে আমার প্রিয় ও স্নেহের শিক্ষার্থী আর বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছোট-ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে দুই একটি কথা বলার চেষ্টা করব।          

সারাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই মহামারীর প্রকোপ এখনো আমাদের দেশে পুরোপুরি দেখা দেয়নি। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে আগামী মে, জুন এ দুইটি মাস আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সামনে বিশাল অগ্নিপরীক্ষা। আমরা কি সব বিধিনিষেধ মেনে চলে নিজেদেরকে, নিজের পরিবারকে রক্ষা করব? নাকি হেলায় গা ভাসিয়ে সকলের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনব? আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশের আশাবাদী মানুষ। আমাদের সাধ্যের চেয়ে স্বাদ বহুগুণে বেশি। এই ছোট্ট দেশটির জনসংখ্যা খাতা কলমে সাড়ে ১৬ কোটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রের হিসেব মতে, সরকারি আর বেসরকারি মোট ১৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৫ লাখের বেশি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোতে ৩৫ লাখের বেশি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী রয়েছে। এই ৮০ লাখ  শিক্ষার্থী যদি শুধুমাত্র নিজেকে ও নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখে আর পরিবারের গড় সদস্য সংখ্যা ৫ জন  করেও হয় তাহলে দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশ যাদের শুধুমাত্র বাৎসরিক মাথাপিছু চিকিৎসা ব্যয় ১২ হাজার ডলার বা দশ লাখ টাকার বেশি তারা বলছে মৃতের সংখ্যা এক লাখের মধ্যে রাখতে পারলে তাদের সফলতা। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে শতভাগ নিয়ম কানুন মেনে চলা এবং অন্যকে উৎসাহিত করাই এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।   

মোট জনসংখ্যার শতকরা ষাট ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে যারা এখনও অনেক অসচেতন। অনেকেই করোনা ভীতিকে মনে করছে গুজব। ধর্মান্ধ ও অবিবেচকের মত এক শ্রেণীর মানুষ ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে, গুজব ছড়াচ্ছে। কাউকে ভয়াবহতা বুঝাতে গেলে উল্টো কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। তারপরও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কৌশলের মাধ্যমে সবাইকে সত্য ও বাস্তব তথ্য জানিয়ে সচেতন করতে হবে। এতে বারবার  অপদস্ত ও অপমানিত হতে হলেও করতে হবে। দেশের ৭০-৮০ লক্ষ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। পথশিশু, রিকশা শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক, দিনমজুরসহ অনেকেই কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এই দুর্দিনে এসব প্রান্তিক মানুষকে মানসিকভাবে ও আর্থিকভাবে সম্বল অনুযায়ী সহযোগিতা করতে হবে। অনেকের সাথে পূর্ব-শত্রুতা, মনমালিন্য থাকতে পারে। এসব ভুলে পাড়া-প্রতিবেশির খোঁজ নিতে হবে। অন্যের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে। মনুষ্যত্বই পরম ধর্ম। শুধুমাত্র ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের কন্টেন্ট আর বইয়ের দুই চারটা পৃষ্ঠার মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজ না। সময় পেলে জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ পড়ে দেখো। জীবনের অর্থ নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। জাতিসংঘ চলমান মহামারিকে বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী মারাত্মক দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অনেকের পারিবারিক সচ্ছলতা থাকতে পারে। ২/৩ মাসের খাবার মজুদ, অঢেল ব্যাংক ব্যালেন্স, সবকিছুই হাতের মুঠোয় থাকলেও ফুর্তি মোডে থাকার মোটেও সুযোগ নেই। Cinema Closed Until Real Life Doesn’t Feel Like a Movie. এই কথাগুলো করোনাময় এই পৃথিবীর কোন এক সিনেমা হলের সামনে ঝুলছে। সত্যিই যেসব দৃশ্য আমরা কেবল মুভিতেই দেখতাম,  তা আজ বাস্তব। এই চরম দুর্দিনে অন্যের বিপদের সহায় হওয়ার সৌভাগ্য সৃষ্টিকর্তা সবাইকে দেন না। এটা কারো প্রতি করুণা নয় বরং মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়া আর পৃথিবীর আলো, বাতাস গ্রহণ করে বেঁচে থাকার ঋণ পরিশোধের সুযোগ, সৃষ্টির সেরা জীবের দায়িত্ববোধ। 

স্বেচ্ছাসেবাকে অনেকেই শো-অফ বলে ব্যঙ্গ করছে। এতে মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার অবকাশ নেই। যুগে যুগে এই শ্রেণীর  মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবে। যারা কিছু করেনা তাদের কোন সমালোচনা হয় না। Let the dogs bark. Why mountain should care? তবে ২৫০ গ্রাম চাল দিয়ে ১৪ জন ছবি তোলে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার মত স্বেচ্ছাসেবার দরকার নেই। সরকারের একার পক্ষে এই দুর্যোগ মোকাবেলা কষ্টসাধ্য। সবার সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি। যেখানেই যেভাবে স্বেচ্ছাসেবার সুযোগ আসে নিজেকে নিয়োজিত করো। নিজে ভালো আছো দেখে অন্যের বিপদকে এড়িয়ে যেওনা। নিজের সুখ এই দুর্দিনে প্রকাশ্যে উদযাপন না করে দুনিয়ার সুস্থতার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করো। 

এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার সাথে সাথে আরেক বিপর্যয় আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এক কোটি মানুষ কাজ হারাবে। রেমিটেন্স কমে যাবে। গার্মেন্টস রপ্তানি, ব্যাংক সুদের হার কমে যাবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২%-৩% কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আমাদের বেশিভাগই নিম্ম ও নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরিবারের একক সদস্য বাবা, মা কিংবা ভাই, বোনের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল। চলমান পরিস্থিতিতে অনেকের কাজ বন্ধ, উপার্জন সীমিত। বেশীরভাগের টিউশন বন্ধ। হাত খরচের জন্যও পরিবারের উপর নির্ভরশীল। ঘরে বসে আয়ের কোন পন্থা খোঁজে পাওয়া যায় কিনা দেখতে পারো যা পরবর্তীতে খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। যে কোন ধরনের কাজের মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। আমদানি-রপ্তানি সারা বিশ্বজুড়ে বন্ধ প্রায়। খাদ্য সংকটের তীব্র সম্ভাবনা রয়েছে। যাদের পারিবারিক কৃষিজ কাজকর্ম রয়েছে তারা কিভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় ভেবে দেখতে পারো। ধান, সবজি, মাছ, লবণের চাহিদা মেটাতে পারলে দেশ বিরাট দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণ পাবে। 

করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তির পরিবার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলেও তাদেরকে সামাজিকভাবে অপদস্ত করা যাবেনা। এটা আরেকটা সংকট। এতে মানবিকতা বিপন্ন হয় সেই সাথে কারো মধ্যে করোনা লক্ষণ দেখা দিলেও লুকিয়ে রাখার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা আরো ভয়াবহ বিপদ।  আক্রান্ত হওয়া কোন অপরাধ নয়। যে কেউ, যেকোন সময় আক্রান্ত হতে পারে। তাদের আশ্বস্ত করতে হবে এবং এটা যাতে না ছড়ায় তার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। অনেকেই দেশের সিস্টেমের কথা বলবে। সমন্বয়হীনতা, অব্যবস্থাপনা,  কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ সেটা বিচার করার সময় এখন নয়। হ্যামলকের পেয়ালায় মধু মিশিয়ে আর যাই হোক স্বর্গ পাওয়া যায় না। দোষারোপ করা মাধ্যমে নিজের প্রাণ রক্ষা পাবে না। Survival is the fittest.
     
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব বন্ধ। অনেককে হা-হুতাশ করতে দেখছি সময় কাটছে না, একগুঁয়ে লাগছে সবকিছু। অভিজ্ঞদের নিকট থেকে ভালো বই ও মুভির তালিকা নিয়ে ভালো কিছু বই পড়তে পারো, মুভি দেখতে পারো। মানুষ হিসেবে ও মানব সম্পদ হিসেবে নিজের মধ্যে থাকা দুর্বলতা গুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করতে পারো। যে মানুষটা জীবনে একবারের জন্য হলেও উপকারে এসেছে তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো, যাকে কষ্ট দিয়েছো তার সাথে কথা বলে নিতে পারো। প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ানো শিক্ষকদের বিশেষ করে যাদের বয়স বেশি উনাদের খোঁজ নিতে পারো। এই দুর্দিনে এরকম উপহার পেলে নিশ্চয়ই এভারেস্ট জয়ের আনন্দ পাবে। এতে নিজের মন ভালো ও উদার হয়। গত বছরের ন্যায় এবারও ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। হেলায় বসে না থেকে প্রাপ্ত সুযোগে বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড়,  আঙ্গিনা সহ ডেঙ্গু সংক্রমণের সম্ভাব্য উৎস পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পারো। অলস সময়ে সবার ঘুমের রুটিনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পরিমিত ঘুমের কম এবং বেশি দুটিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ঋতু পরিবর্তনের কারণে এমনিতেই সবার মধ্যে এই সময়ে জ্বর-সর্দি-কাশি হওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। এই সময়ে করোনা ছাড়া যেকোন ধরণের চিকিৎসা পেতে  বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নিজের শরীরের যত্ন নাও, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই গ্রহণ করো, শরীরকে প্রোটিন সমৃদ্ধ করো। কুসুম গরম পানিতে লেবু, আদা বা ভিনেগার মিশিয়ে দৈনিক দুই থেকে তিনিবার খেতে পারো। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াও। নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য প্রার্থনা করো।   

আমি ভালো লেখক বা দক্ষ পরামর্শক নই। নিজের দায়িত্ববোধ থেকে লেখা। উপদেশ দেওয়া সহজ, মেনে চলা কঠিন। আমরা আবার সুস্থ পৃথিবীতে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিব, সবাই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াব, কারো কাছে যেতে, পাশে বসতে অস্বস্তিবোধ করব না, ছুঁয়ে দেখতে দ্বিধাবোধ থাকবে না, সেই স্বপ্ন থেকেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকার সংকল্পই আমাদের সব কঠিন জয়ের প্রেরণা হোক। আমাদের দৃঢ়তা ও বিপদ মোকাবেলার প্রতিজ্ঞা আমাদের সব কাজকেই সহজ করে দিতে পারে।  

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের বৃহত্তম গ্রন্থ মহাভারতের বনপর্বে যক্ষ্ম প্রশ্ন করেছিলেন- কী ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায়? কি ত্যাগ করলে শোক হয়না? কি ত্যাগ করলে মানুষ ধনী হয়? কি ত্যাগ করলে সুখী হয়? উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিল-অভিমান ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায়, ক্রোধ ত্যাগ করলে শোক হয়না, কামনা ত্যাগ করলে লোকে ধনী হয় আর লোভ ত্যাগ করলে সুখী হয়। 

চলমান সংকটে যুধিষ্ঠিরকে অনুসরণ করার সময় এসে গিয়েছে। আমাদের দল-মত-ধর্ম-বর্ণ সব অভিমান ভুলে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে, সব ধরনের ক্রোধ-বিবেদ পরিত্যাগ করতে হবে, লোভ, কামনা  দূরে সরিয়ে  মানবতার মুক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তবেই হয়তো এই যুদ্ধজয় সম্ভব। নয়তো পরাজয় অনিবার্য।    

লেখক: শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

এমএস/