ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

করোনা সংকট নিরসনে দরকার স্বচ্ছ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড

মুনতাকিম আশরাফ

প্রকাশিত : ১০:৩৮ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ১০:৪৩ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২০ বুধবার

মুনতাকিম আশরাফ

মুনতাকিম আশরাফ

পুরো মানবসম্প্রদায় করোনা নিয়ে আতঙ্কিত। দীর্ঘ দিনের পরিচিত, রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব পর হতে সময় লাগেনি। পিতা সন্তানের কাছে যেতে পারেননি। ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা থাকলেও কচি শিশুরা নিরাপদ দূরত্বে থেকেই পিতাকে শেষ বিদায় জানিয়েছে।

মারা যাওয়ার পরও পিতা তার সন্তানকে শেষ দেখতে পারেননি। সন্তান তার পিতার লাশ কাঁধে করে কবরে নামাতে পারেননি। পরস্পর বন্ধু রাষ্ট্রের সীমানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বেশিরভাগ দেশগুলোর মধ্যে বিমান যোগাযোগও। এখন সময়টা এমনই যে, দূরে থাকো, নিরাপদে থাকো।

মার্চের শুরুর দিকে আমাদের দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের পর থেকেও একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। করোনা সংকটের কারণে দেশে এখন ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ রয়েছে সরকারি- বেসরকারি সব অফিস। ব্যাংক খোলা রাখা হয়েছে সীমিত সময়ের জন্য। আর, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দোকান বাদে সব দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এক দেশের সাথে আরেক দেশের বিমান যোগাযোগ বন্ধ। এতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আর দেশে অঘোষিত লক ডাউন কর্মসূচীর পর থেকে জনজীবনে এক প্রকার স্থবিরতা নেমে এসেছে।

জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআর বলছে, দেশে করোনা আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৮ জনে। আর মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ জনে। রাজধানীসহ দেশের কিছু এলাকা পুরো লক ডাউন করে দেওয়া হয়েছে। জনসাধারণের চলাচল সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। 

তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারি- বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। যদিও এই ভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাই জনসাধারণকেও সচেতন হতে হবে। এ লক্ষ্যে জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথা চিন্তা করে নির্দিষ্ট  সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে আমাদের পেশাদারী ও দায়িত্বশীল প্রশাসনের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী মাঠে তৎপর রয়েছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য নিজেরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির অভিভাবক হিসেবে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৩১ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছেন। করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে কাজকর্ম বন্ধ থাকায় দিনমজুরদের খাদ্য সংকটে পড়তে হচ্ছে। অনেক মধ্যবিত্ত আবার সামাজিকভাবে হেয় হবার কারণেও খাদ্য সহযোগিতা চাইতে পারছেন না। কাজেই মধ্যবিত্ত এবং গরীব-দুস্থ অসহায় মানুষের মাঝে ঘরে ঘরে গিয়ে খাবার বিতরণে বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। এই সময়ে নানাপ্রকার গুজবের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। 

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে খোলা বাজারে ওএমএস পদ্ধতিতে ১০ টাকা কেজি দরে চাল ও আটা বিক্রি শুরু হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ট্রাকে করে সুলভমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রি হচ্ছে। আর ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সকল উপজেলাতে সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে নগদ অর্থ সহায়তা ও শিশু খাদ্য প্রদান করা হচ্ছে। এ সকল কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। 

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশও এর মধ্যে অন্তর্গত। করোনার কারণে গত মাসে রেমিট্যান্স আয় কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। যা আগের ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। আবার, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে। বর্তমানে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় আসে এই খাত থেকে। তবে করোনার প্রভাব পড়েছে এই খাতেও। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন- বিজিএমইএ বলছে, এখন পর্যন্ত বিদেশী ক্রেতারা তিন বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল করেছেন। যাতে মালিকদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ২০ লাখের বেশি শ্রমিক। এমন চিত্র অর্থনীতির আর সব কটি খাতেই। 

এমন অবস্থায় করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব এবং তা থেকে উত্তরণে নতুন চারটিসহ মোট পাঁচটি প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার আকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এটি আবার জিডিপির প্রায় ২.৫২ শতাংশ। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ও উত্তরণে ঘোষিত নতুন কর্মপরিকল্পনায় রয়েছে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি; সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি কার্যক্রম। কর্মপরিকল্পনার আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মাধ্যমে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা প্রদান করা হবে। 

চলমান সংকট মোকাবেলায় এই প্যাকেজটি সময়োপযোগী ও অর্থনীতির টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সব খাত-উপখাত, অনুষঙ্গ-উপষঙ্গ যোগ করা হয়েছে এই প্যাকেজে। এতে রয়েছে পথের ভিক্ষুক, দিনমজুর কিংবা শিল্পপতি সবার জীবন ও জীবিকার মতো বিষয়। আপদকালীন এ কর্মসূচীর আওতায় বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রয়েছে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি, লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ এবং বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র শিল্প ও সেবা খাতে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণের কর্মসূচি। এ জন্য গঠন করা হবে পৃথক তহবিল। 

তবে এই প্যাকেজ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সতর্কতা জরুরি দরকার। অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রণোদনার সুযোগ নিবেন না বলেই আশা করি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষি ও সেবাভিত্তিক খাতের উদ্যোক্তারা সঠিকভাবে এই প্যাকেজের অর্থ কাজে লাগাবেন; ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করবেন এটাই সময়ের দাবি। আবার, এসব অর্থ ব্যবহারে শ্রমিকরা কাজ ফিরে পাবেন। তাদের পরিবার স্বাবলম্বী হবে- এর মাধ্যমে অর্থনীতির বৃত্তাকার চক্র ফুলে ফেঁপে উঠবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্যাকেজের সুযোগগ্রহণকারীরা কর্মসংস্থান তৈরিতে পদক্ষেপ নিবেন বলেও আমাদের আশাবাদ। 

অপ্রত্যাশিত করোনা সংকটে হয়তো এ বছরটা আমাদের অর্থনীতির জন্য একটু কঠিন হবে। তবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে গৃহিত উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা সংকট কাটাতে সক্ষম হবো। তবে, একটি কথা মনে রাখা জরুরি, সংকট নিরসনে সরকারি সহযোগিতা আর বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগের সঙ্গে আমাদের সততা অপরিহার্য। কেননা, সততা না থাকলে সব জলে যাবে। প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণ সরকারি বরাদ্দের সুবিধা পাবেন না।

লেখক: এফবিসিসিআই এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট

এসি