ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নাজমার মা

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

প্রকাশিত : ০৪:৪৬ পিএম, ৯ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৪:৪৭ পিএম, ৯ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার

সবাই তাকে ডাকতেন নাজমার মা। আম্মাও ডাকতেন। আমরাও। তার নাম যে আসলে কি ছিল তা আজ হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিনা। লম্বা ফর্সা একহারা গড়নের নাজমার মার মুখটা ছিল খুব শান্ত। কোনো অনুভূতি তাতে খুব একটা বোঝা যেত না। 

বাসার চালের আটা কুটতে হবে ডাক নাজমার মাকে, গেষ্ট আসবে ডাকো নাজমার মাকে। পিঠা বানাতে হবে ডাকো নাজমার মাকে। আম্মার শুধু বলা, লাফাতে লাফাতে চলে যেতাম নাজমার মাকে ডাকতে। নাজমাদের বাসাটা ছিলো আমার কাছে বিস্ময়। পুকুর পাড়ে এক চিলতে ঘর। এক টুকরো উঠোন। তাতে ৫ ছেলেমেয়ে নিয়ে নাজমার মায়ের সংসার। নাজমার বাবা ছিলেন ময়মনসিংহ টিচার্স টেনিং কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। ওদের বড় একটা চৌকি ছিল। দেয়ালে টানানো ছিল এক কাঁচের আয়না। নাজমা মাথায় তেল দিয়ে ওই আয়নায় সিঁথি কাটতো। আমি অবাক হয়ে দেখতাম। আমাদের বাসার বড় ডেসিং টেবিলটা যত না টানতো আমায় তার চেয়ে বেশি টানতো ওই চারকোনা কাঁচের আয়না।

নাজমার মেজ বোন নাম এখন মনে নেই। ও ছিলো আমার সাগরেদ। নাকি আমি ওর, বুঝিনা । টইট্ই করে সারাদিন একসাথে ঘুরে বেড়াতাম আমরা। ওর কোলে থাকতো ওর লিকলিকে চেহারার ছোট ভাই। খেলার ফাঁকে ফাঁকে ওকে সাথে নিয়েই মাঠ থেকে তুলতো ও নানাধরনের শাক। কচু থেকে শুরু করে হেলেঞ্চা, বউতা, ঘিমা ঢেকি শাক কত কি! আমিও তুলতাম ওর সাথে। পুকুরে নেমে ছিঁড়তাম কলমী শাক। কলমীর হালকা সাদা বেগুনি ফুলে মুগ্ধ হতাম আমরা। লাল শাপলার ডাঁটা তুলতো ও কখনো কখনো। ফ্রকের মধ্যে শাকগুলো রাখতাম। ভরে গেলেই দৌঁড়ে নাজমাদের বাসায় গিয়ে দিয়ে আসতাম। নাজমার মা সেগুলো বাছতে বসতেন। পিঁড়ি পেতে বসে বসে দেখতাম, কি নিপুন হাতে সেগুলো বাছছেন তিনি। 

দুপুর গড়িয়ে যেত। আমি বাসায় চলে যেতাম। খেয়ে দেয়ে বিকেলের দিকে যখন যেতাম দেখতাম মাটির চুলায় তখন টগবগ করছে ভাত। একপাশে বড় কড়াইয়ে শাক। নাজমারা ৫ ভাইবোন চুলার চারপাশে বসে আছে গোল হয়ে। সবার দৃষ্টি ভাতের হাঁড়ির দিকে। হাঁড়ি থেকে গরম মাড় ঢালতেই ওরা বাটিতে লবন দিয়ে চুমুক দিয়ে একটু একটু করে খেত। নাজমার মা মিহি করে রসুন কুচি করে শাক ভাজি করেন। তাতে দেন কাঁঠালের বিচি। সুন্দর এক গন্ধ ছড়িয়ে পরতো চারপাশে। এক কড়াই ভর্তি সবুজ শাক। আস্তে আস্তে কমে আসে বিকেলের আলো। ভাত নামে চুলা থেকে। 

নাজমার মা সবার টিনের থালায় গরম ভাত বেড়ে দেন। ঢিবির মতো উঁচু গরম ভাত। তাতে দেন শাক ভাজি। সবাই মনোযোগ দেয় খাওয়ায়। মুখে তৃপ্তির হাসি। পেট মোটা সরু লিকলিকে ছোট ভাইটা ভাত মুঠো করে নেয়। ভাতগুলোকে তখন আমার জুঁই ফুলের মতো লাগে। আমিও ওদের সাথে পিঁড়িতে বসে পড়ি সে ভাত খেতে। আহা যেন অমৃত! 

এখন খেলে রাতে কখন খাবে? আমার এমন বোকা প্রশ্নে অবাক ওরা। ওই সময়েই জানতে পারি বিকেল আর সন্ধ্যার এই মাঝামাঝি সময়ে সময় ভাত খেলে রাতে আর খেতে হয় না। পেট ভরা ভাত নিয়ে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। জানতে পারি ওরা এই একবেলাই খায়, এই সময়েই।

অবাক হলেও নাজমার মার এই টেকনিক তখন বুঝিনি। বড় হয়ে বুঝেছি। সন্তানদের সন্ধ্যায় খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলে রাতের খাবার আর দিতে হয় না। অভাবের সংসারে এভাবেই বুদ্ধি করে বাঁচে ওরা। 
আজ বুঝি ওদের অভাব ছিল কিন্তু আচরণে কোনো ভিন্নতা ছিল না। নাজমার মা আম্মাকে অনেক কাজে সহায়তা করেছেন কিন্তু কখনো কিছু চাননি। আম্মা যা দিয়েছেন তাই নিয়ে গেছেন হাসিমুখে। এখন অনুভব করি তার ছেলেমেয়েরাও কখনো ক্ষুধা লেগেছে বলে হাত পাতেনি আমাদের কাছেও। 

সারাদিন কাম্পাসে একসাথে ঘুরলেও কখনো বুঝিনি সকাল থেকে ওরা না খেয়ে আছে। হাসিমুখেই একসাথেই সবাই ভাতগোটা, তেঁতুল, সফেদা, আতাফল, বিলেতী লিচু যখন যে মৌসুম থাকতো সেই ফল কুড়িয়ে খেয়েছি। এসব খেয়ে সকাল-দুপুর ক্ষুধা পার করে বিকেলের নরম আলোয় সাদা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত খেতো ওরা। একটুও বুঝিনি। 

এখন মনে হয়, না বুঝে ওদের খাবারে কত ভাগ বসিয়েছি আমিও। আমি না খেলে ওরা হয়তো আরেকটু ভাগে পেত। তবে ওদের সাথে খেতে বসে একবারও আমার মনে হয়নি আমি অনাহুত অতিথি। ভালবাসা আর মায়া থাকলে একটা শুকনা মরিচ আর একটু শাক দিয়ে যে এক থালা ভাত খাওয়া যায় তা দেখেছি নাজমার মায়ের সংসারে। টেবিল ভর্তি খাবার দেখেও অনেক সংসারে দেখেছি অতৃপ্তির বেদনা। যারা খাবার নষ্ট করেন তারা কখনো অনুভব করতে পারবেন না, না-খাওয়ার কষ্ট কত প্রকার ও কি ধরনের! এখনই মিতব্যয়ী না হলে এই করোনা সংকট পরে চারদিকে হয়তো শুরু হবে একমুঠো খাবারের জন্য হাহাকার। তখন নাজমার মায়ের সেই বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝির এক বেলা খাবার খেয়ে হয়তো দিন পার করতে হবে আমাদেরও।

লেখক: সাংবাদিক

এমবি//