ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

চিকিৎসকদের দোষারোপের আগে আরেকবার ভাবুন

প্রকাশিত : ০৫:২৫ পিএম, ৯ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:৪৮ পিএম, ৯ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার

অভাবিত বৈশ্বিক বিপর্যয় এই করোনা মহামারী। আপনারা ঠিকই বলেছেন, উন্নত রাষ্ট্রগুলো পর্যদুস্ত এর আক্রমণে। সেখানে আমাদের মতো দেশে সবকিছু ভালোভাবে হবে এটা আশা করছে না কেউ।

প্রথমেই বলে নিচ্ছি, একজন অসুস্থ মানুষও চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যবরণ করুক কিংবা কষ্ট পাক, তা আমি চাই না। আমার বিশ্বাস কেউই চায় না। তারপরও এ ধরণের কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা খুব দুঃখজনক।

চিকিৎসকদের ত্রুটি-বিচ্যূতি নিশ্চয়ই আছে। কারণ এরা কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে চাষ করা কোন পণ্যের সমাহার না। এই সমাজ থেকেই উঠে এসেছে তারা। কারো ভাই-বোন, পুত্র- কন্যা। সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি পেশায় যখন দুর্নীতিবাজ আর লুটেরাদের জয়-জয়কার, সেখানে শুধু ডাক্তাররা ফেরেশতা হবে, এটা আশা করেন কিভাবে? একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কিংবা লুটপাট করা ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদদের ঘরে জন্ম নেয়া সন্তান ডাক্তার হলেই কি পুত-পবিত্র হয়ে যাবে?

বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ বা খুলে রাখার বিষয়টি এত সহজ না। এপিডেমিক কন্ট্রোল বিষয়টিও সবাই বিশেষজ্ঞ হওয়ার মত সহজ বিষয় না। এটা সায়েন্স। মেডিকেল সায়েন্সের একটি বিশেষায়িত ধারা। দেশখ্যাত মেডিসিন বা ক্লিনিক্যাল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও কিন্তু এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছেন। কাজেই এখানে জাজমেন্টাল না হওয়াই ভালো।

উন্নত বিশ্বের যাদের অনুকরণীয় উদাহরণ দিচ্ছেন, সেই পেশার দেশের মানুষদের প্রতি আপনারা বড় নির্দয়। বলবেন, আমরা ওদের মত উচ্চমানের না, মানবিকতায় ওদের চেয়ে ঘাটতি আছে আমাদের, এই তো?

ভালো, আমরা কি দেশটাকে ওই লেভেলে নিতে পেরেছি? ওদের মন্ত্রীরা, ব্যবসায়ীরা, সরকারি কর্মকর্তারা কি আমাদের মতো? ওখানে কি বালিশকাণ্ড হয়? যাহোক, এসব কথা বলে আর লাভ নাই। কারণ আমাদের কর্তা-ব্যক্তিরা, সাথে প্রাচীন-নব্য টাকাওয়ালারা তো সুযোগ পেলেই বিদেশে পাড়ি জমান। সামনে তো বিদেশি ডাক্তার- নার্সরাই দেশে আসছেন।

দেশের ডাক্তাররা না হয় আলুপটলের বা মুদি দোকান দিয়েই জীবনধারণ করবে। মেধা যেহেতু আছে, এখানেও তারা খারাপ করবে না।

এবার ঠান্ডা মাথায় শুধু কয়েকটা কথা ভেবে দেখতে অনুরোধ করবো:

১. চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের আন্তর্জাতিক সোসাইটি আছে। তারা করোনাকালে নিজ নিজ স্পেশালিটির জন্য কিছু গাইডলাইন ইতোমধ্যে বানিয়ে পাঠিয়েছেন। দেশীয় প্রেক্ষাপটে তা কিছুটা পরিমার্জন সাপেক্ষ হলেও, চিকিৎসকরা সেটা ফলো করছেন। কতটুকু চিকিৎসা কাকে দেয়া সম্ভব বা উচিৎ, তা জবরদস্তি নয়,বিজ্ঞানিকভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তা মূল্যায়ন প্রয়োজন।

২. প্রাইভেট প্র‍্যাক্টিস, প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়, সেবার মান মনিটরিংয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা ও গণমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে। সরকার কি কোন পদক্ষেপ নিয়েছে? এখন জোর করে কোন কিছু চাপিয়ে দেয়া কি সম্ভব?

৩. নামজাদা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর বেশিরভাগের মালিক বা উদ্যোক্তাদের চিনেন তো? বিশ্বাস করেন, তাদের কিছু হবে?

৪. চিকিৎসকদের গালি দেন, সমস্যা নেই। সরকারি একজন চিকিৎসকের সমমর্যাদার অন্য অনেক কর্মকর্তা কি ধরনের বাড়তি সুবিধা পান, যা থেকে চিকিৎসকরা বঞ্চিত, তা জানেন তো?

৫. করোনা চিকিৎসাদানকারী স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া সংশ্লিষ্ট অন্যদের দায়িত্ব পালনে আপনি সন্তুষ্ট?

৬. এই যে প্রথমেই প্রনোদনা পাওয়া গার্মেন্টস মালিকগণ করোনা ঝুঁকি বিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখলো, তারা সাহসী, বীর সৈনিক। আমরা চিকিৎসকরা ভীতু কাপুরুষ, তাই তো?

৭. কেবল ডাক্তাররাই সরকারের কিংবা জনগণের, কারো কারো মতে তাদের টাকায় পড়েন না, অন্যরাও।

৮. অজ্ঞতা দোষের না। কোন বিষয়ে অজ্ঞ হয়েও নিজেকে সবচেয়ে বিজ্ঞ ভাবা ভয়ঙ্কর।

৯. যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন, তারা আপাতত দেশি ভীতু কাপুরুষদের দেখভালেই আছে তো? কিছু ভীতু করোনায় আক্রান্তও হয়েছেন। সিলেটের একজন সহকারী অধ্যাপক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউ, হেলিকপ্টার, এমনকি সরকারি এম্বুলেন্স পর্যন্ত পাননি।

১০. এই ভীতু কাপুরুষ অমানুষ কিছু ডাক্তার মুক্তিযুদ্ধে, ভাষা আন্দোলনে কিছু ভূমিকা রেখেছিলেন, মনে আছে তো? ডা. শামসুল আলম খান মিলনের নামটা ইতিহাসের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

১১. এদেশে অনেক সময় ডাক্তারদের উপর কিছু মানুষ বেআইনি আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়ে। আপনাদের মত দায়িত্বশীল বা সেলিব্রিটিদের এই সব ঢালাও দোষারোপ ওইসব ঘটনার প্রশ্রয় দিতে পারে, তা কি ভেবেছেন?

ভালো থাকুন। ঘরে থাকুন। নিরাপদ থাকুন।