ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

করোনাভাইরাস: সমাজের রিয়েল হিরো চিকিৎসকরা

এম ওয়াহিদ তাওসিফ (মুছা)

প্রকাশিত : ১০:২৫ পিএম, ৯ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার

সম্প্রতি করোনাভাইরাসে থমকে দাঁড়িয়েছে গোটা বিশ্ব। এ ভাইরাস যেন সভ্যতা আর উন্নত প্রযুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভিন্ন এক পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। সে পৃথিবীর রং মোটেই শুভ্র নয়। সে পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে মৃত্যুর মিছিল। এই অপ্রত্যাশিত অথচ অনিবার্য প্রতিক্রিয়ার মিছিলে সবাই যখন ঘরে বসে নিজের সুরক্ষার কথা চিন্তা করছে ঠিক সেই মুহুর্তেই একদল ফ্রন্ট লাইন ওরিয়ার নিজের জীবন বাজি রেখে এই সংক্রমণ ব্যাধির সাথেই লড়ছেন। পৃথিবী যখন তার ভিন্নরুপে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, যখন অজস্র সম্ভাবনাময় প্রাণ অঝরেই ঝরে পড়ছে তখনো এই যোদ্ধারা মাঠ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ১৬ কোটি প্রাণের স্বার্থে, সম্ভাবনার এক নতুন সকালের আশা নিয়ে অবিরাম-অবিরত কাজ করে চলছেন দেশের হাজার হাজার মানবদরদী একদল যোদ্ধারা। বলছিলাম দেশের রিয়েল হিরো চিকিৎসকদের কথা। 

আমরা যখন বাসায় বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলে ফেলি ঠিক তখনো এই ডাইনামিক লিডাররা পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম না পেয়েও চিকিৎসা দিয়ে চলছেন আমার-আপনার ভাই, বোন, মা,বাবা, স্ত্রী সন্তানকে। কিন্তু তাদের পরিবারের কথা কি আমরা ভেবেছি? আমরা কিভাবে এত আত্নকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি? কিভাবে বিপদ শেষে এই মহান মানুষগুলোকে কসাই বলে অবিরত গালাগালি করছি? এভাবে চলতে থাকলে খুব দ্রুতই স্বাস্থ্য সেবায় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। তাদের মাঝে ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। তাই বলে সকল চিকিৎসককে এভাবে বিচার করার অধিকার কোথায় পেলেন আপনি? একটিবার কী ভেবে দেখেছেন আপনার যখন খুব জ্বর বা কঠিন ব্যাধিতে ভুগতে ভুগতে জীবনের আশা শেষ করে দিচ্ছেন সেই মুহূর্তেও এই মানুষগুলো আমাদের পাশে থাকছে, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে। আর দিন শেষে তারাই কসাই? 

প্রশ্ন রয়ে যায়! অনেক প্রশ্নের উত্তর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না৷ সব উত্তর খুঁজতেও নেই তাতে উপকারের চেয়ে দুরত্বই বেশি বাড়ে। 

ব্যক্তিগভাবে আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। মেডিক্যালের সাথে খুব বেশি সম্পর্ক নেই আমার। থাকবেই বা কি করে? আমি তো চিকিৎসক নই। তাদের ভিতরের অজানা কথাগুলো জানার জন্য এতটা গভীরতায়ও ডুব দেয়া হয়ে ওঠেনি কখনো। কিন্তু ভালবাসা কমেনি এই মানুষ গুলোর জন্য। সামাজিক যোগাযোগ এর মাধ্যমে ফেসবুকে প্রায় ৩০০০ এর অধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর সাথে সম্পৃক্ত আমি। যার ফলেই দিনের পর দিন দেখেছি কসাই এর আড়ালে তাদের ভিতরের লুকিয়ে থাকা মহান মানুষকে। কতটা উদার হলে এমন হওয়া যায় আমার জানা নেই। জানা নেই কতটা নিঃশব্দে মানুষকে ভালবাসা যায়। জানা নেই কতটা দেশপ্রেম থেকেই পরিবার আর প্রিয়জন ছেড়ে হাসপাতালেই রাত কাটানো যায়। কতটা মানবিক হলে বিবাহিত হয়েও এই মহামারী সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে দেশ আর পরিবারকে বাঁচাতে ব্যাচেলর হওয়া যায়। 

করোনায় যখন চাল চুরি আর সংক্রমিত রোগীর সংখ্যার হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই তখনো এই মানুষগুলো সব কটুকথা উপেক্ষা করে নিরলস কাজ করে চলছেন৷ তাদের প্রতি কি কৃতজ্ঞতা বোধ জন্ম নেয় না? জন্ম নেয় না শ্রদ্ধাবোধ? 

একজন চিকিৎসক যখন চিকিৎসা পেশায় যোগ দেন সেদিনই শপথ নেন - I solemnly pledge myself to consecrate my life to the service of humanity; পৃথিবীর আর কোন পেশাতে এই পবিত্র বাক্যগুলো আছে আমার অভিধানে তার সংগ্রহ নেই। 

এইতো করোনা সংক্রমনের সেই দিন এক চিকিৎসক লিখলেন- 
‘আমার প্রতিবন্ধী বড় ছেলেটা রাতে আমার সাথে ঘুমাতো এখন ঘুমায় না তিন সপ্তাহ, আমি বাইরে কাজ করি ভয়ে ওকে রাতে কাছে রাখিনা। ওর ছবিটা আমার কাভার ছবি, সেটা দেখি সারাদিন।

মেয়েটা ঘরে ঢুকলে দৌঁড়ায়ে চুমু খেত, আসতে দেই না।

মেজো ছেলেটা ইন্টার পরীক্ষার্থী, ফোন নিয়ে নিয়েছিলাম ফিরিয়ে দিয়েছি, মরেই যদি যাই ওদের কষ্ট দিয়ে কী হবে।

বউটা যতক্ষণ কাছে থাকতো সারাক্ষণ নানা অভিযোগ করতো, হাসতো, ঝগড়া করতো, গম্ভীর হয়ে গেছে, ও ওতো ডাক্তার, ২৮ বছরের সংসার, দুঃখগুলো বুঝে নিয়েছে মনে হয়।

বিধবা মা দেশের বাড়ি গফরগাঁতে, ফোন করে খোঁজ নিতেই ধরা গলায় বলেন, ‘বাপজান দুআ ইউনুছ পইড়ো, আয়াতুল কুরছি পইড়ো’ আর এর বেশি বলতে পারেন না।

আমার কাজের মানুষ রুপবান, দৌঁড়ায় চা নিয়ে আসতো এখন কাছে আসে না।

ড্রাইভার হারুন, তেল মবিল এর চাহিদা তার কখনো ফুরাতো না, এখন চুপ করে গাড়ি চালায়, কিছুই বলে না।

আমি শক্ত মানুষ তারপরও কালকে কাঁদলাম অনেকক্ষণ। নারায়ণগঞ্জ এর যে বৃদ্ধ ইমাম মারা গেলেন তার ছেলেটা চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছে আহারে আমার বাবা যখন অন্যের জানাজা পড়াতেন হাজার হাজার মানুষ তার পিছনে দাঁড়াতো আজ তার জানাজায় পাঁচজন। আজকে আমার জন্য জাতির যে অভিশাপ, যে ঘৃণা তাতে তো মনে হয় লাশ রাস্তাতেই পড়ে থাকবে। সহকর্মীরা হয়তো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে দূর থেকে।

আমি পেশায় চিকিসৎক, আমি তো মানুষও, আমার পেশার দায়িত্ব যেমন আছে, সংসার, ভালোবাসা, ভয় সব কিছুই আছে। আমরা না হয় অনেক বেঁচেছি, তরুণ চিকিসৎকরা আছে, ওদের জীবনতো সবে শুরু।’

এম ওয়াহিদ তাওসিফ (মুছা)

আমাদের কাছে কী উত্তর আছে এই প্রশ্নগুলোর? ভেবে দেখেছি কতটা দায়িত্ববোধ থেকেই একজন মানুষ এভাবে বিলিয়ে দিতে পারেন নিজেকে। এরকম হাজারো চিকিৎসক রয়েছেন যারা পর্দার আড়ালের নৈপথ্য কারিগর। তাদের স্যালুট। ভালো থাকুন আপনারা। নিরাপদ রাখুক দয়াময় আল্লাহ। আমরা আপনাদের যোগ্য সন্মান করতে শিখিনি৷ জানি আপনারা সন্মানের আশায় দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করেন না, তাতে কী- দয়াময় আল্লাহ তো আপনাদের ছেড়ে যাননি। তিনিই কী আপনাদের জন্য যথেষ্ট নয়? 

পরিশেষে বলতে চাই- সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন, আপনি চিকিৎসক, আপনার ভালো থাকাটা জরুরি।

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

এমবি//