ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের পর্যটন শিল্প

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:৫৯ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০২:০৩ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০২০ বুধবার

মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের পর্যটন শিল্প। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রথমেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও দেশের সকল পর্যটন কেন্দ্র। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে পর্যটন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল ধরনের কর্যক্রম। পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ উৎকণ্ঠা ও হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।

এরমধ্যে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দীর্ঘ এক মাস ধরে জনশূন্য। আগে বাংলা নববর্ষ বরণে নানা অনুষ্ঠান ও লাখো পর্যটকের সমাগমে সমুদ্র-শহর কক্সবাজার থাকতো মুখর। অথচ আজ সুনশান নীরবতা সমুদ্র-শহরের কলাতলী, হিমছড়ি ও ইনানী বিচজুড়ে। কোন দোকানপাট খোলা নেই, রাস্তায় নেই কোন কোলাহল। সবকিছুই এখন করোনার দখলে; ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন শিল্প। বেকার হয়ে পড়েছেন অর্ধলাখ মানুষ। 

পর্যটন ১০৯টি উপখাতকে সরাসরি প্রভাবিত করে, চালিত করে ও প্রসারিত করে। একজন পর্যটকের আগমনে সেবাখাতে প্রতি ১০ জনে ১ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়। পরোক্ষভাবে কাজ পায় আরও ৩৩ জন। অর্থাৎ ১ লক্ষ পর্যটকের আগমনের সঙ্গে ৪৪ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। কোনো স্থানে যদি বছরে ১০ লক্ষ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটক বিচরণ করে তবে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরক্ষভাবে এর সুফল ভোগ করবে। বর্তমানে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল কয়েকটি শিল্পের মধ্যে পর্যটন অন্যতম।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সি, লন্ডন (ডব্লিউটিটিসি)-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০১৯ সালে পর্যটনের অবদান ছিল ৭৭,৩০০ কোটি টাকা। আসল কথা হল বাংলাদেশের পর্যটনখাত পর্যালোচনা করার জন্য যে তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন তা সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না। এ যাবত যে ক্ষয় ক্ষতির কথা আলোচানা হয়েছে তা সবই অনুমান নির্ভর প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি। 

বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জনাব মহিবুল হক বলেছেন, ‘এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু ক্ষয় ক্ষতির সঠিক পরিমাণ কেউ বলতে পারছেন না।’

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে হোটেল ও বিমান মিলে ১০ ভাগ ব্যবসায়ী করপোরেট শ্রেণির, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ৮০ ভাগ এবং ১০ ভাগ প্রান্তিক শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। ফলে পর্যটনের সাথে মূলতঃ ৯০ ভাগ পেশাজীবী ও কর্মী অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে, যা অন্য যে কোন উৎপাদনধর্মী এবং সেবাধর্মী শিল্পের চাইতে আলাদা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা আক্রান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তা বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই ঘোষণা থেকে এ কথা পরিস্কার হয়েছে যে, তিনি বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতি নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন এবং তা থেকে উদ্ধার করার জন্য সদা সচেষ্ট।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বাঁচিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে আগামী জুন ২০২১ পর্যন্ত প্রণোদনা ঘোষণা করতে বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে থেকে ৫টি উপায় তুলে ধরে তা বাস্তবায়নের দাবি তোলা হয়েছে।

এদিকে গত ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৩০ শতাংশ কর্মী চাকরি হারাতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে টোয়াব সভাপতি মো. রাফিউজ্জামান বলেন, ‘আউটবাউন্ড ও ইনবাউন্ড পর্যটনের একটি বড় বাজার চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, ভারত ও ইতালি। করোনা ভাইরাসের কারণে উভয় পর্যটনে বড় ধাক্কা লেগেছে। এতে আমাদের ট্যুর অপারেটররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ভাইরাস আতঙ্কে নেপাল, ভুটান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও এশিয়ার প্রধান পর্যটন গন্তব্যগুলোতে টুর প্যাকেজ টিকিট বাতিল করেছে প্রায় ৮০ শতাংশ বাংলাদেশি ভ্রমণকারী। একইভাবে বাংলাদেশে আসার পূর্ব নির্ধারিত ভ্রমণ বাতিল করেছে অনেক বিদেশি পর্যটক। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে টোয়াবের সদস্যরা।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, টোয়াব আয়োজিত বাংলাদেশের দশম পর্যটন মেলা ‘শেয়ারট্রিপ বাংলাদেশ ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ফেয়ার-২০২০’ আগামী ৩-৫ এপ্রিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে সব প্রস্তুতি থাকার পরেও মেলা আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে। আগামী ২৯-৩১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মেলার আয়োজন করা হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে টোয়াবের পক্ষ থেকে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তাদের সুপারিশগুলো হচ্ছে—

আপৎকালীন সুপারিশ

১. সরকারের পক্ষ থেকে টোয়াবের সদস্যদের আপৎকালীন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।

২. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ-১ এর অন্তর্ভুক্ত ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হয়েছে। টোয়াব সদস্যদের উক্ত প্যাকেজের আওতায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মচারীর বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া, ইউটিলিটি বিল ও অন্যান্য লোকসান সমন্বয় এবং মূলধন সংকট নিরসনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় পরবর্তী ২ বছরের জন্য সহজ শর্তে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী ঋণের দ্রুত ব্যবস্থা করা।

৩. পর্যটনের এই কঠিন সময়ে আগামী তিন অর্থবছরের (জুলাই ’২০–জুন ’২১, জুলাই ’২১–জুন ’২২ ও জুলাই ’২২–জুন ’২৩) বাজেটে আমাদের পর্যটন খাতের সুরক্ষা ও উন্নয়নে সরকার কর্তৃক যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা।

৪. টোয়াবের সদস্যদের এআইটি এবং ট্রেড লাইসেন্স ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ফি, পজ মেশিন ট্রানজেকশন ফি ও ইউলিটি বিল, টোয়াবের সহযোগী সদস্যদের যাদের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট আছে সেগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট মওকুফ করা এবং যাদের চলমান ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত ও সুদ মওকুফ করা।

৫. সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের এবং বিদেশীদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে টোয়াব সদস্যদের মাধ্যমে ট্যুর প্যাকেজ পরিচালনা করা।

৬. কক্সবাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তরবঙ্গ, সিলেট, বরিশাল ও অন্যান্য অঞ্চলের পর্যটন-সংশ্লিষ্ট স্বল্প আয়ের পেশাজীবীদের (স্থানীয় ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড, কমিউনিটি পর্যটন পরিবার, মাঝি, চালক ইত্যাদি) জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, জেলা প্রশাসন ও ট্যুরিস্ট পুলিশের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে আপৎকালীন আর্থিক অনুদান নিশ্চিত করা।

৭. টোয়াব মেম্বারদের মধ্যে কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাহলে তাদের পরিবারকে নূন্যতম ৩০-৫০ লক্ষ টাকা অনুদান প্রদান করা।

৮. করোনাভাইরাসের কারণে টোয়াবের বাৎসরিক মেলা পিছিয়ে দেয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে টোয়াব। ভবিষ্যতে এই মেলা সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য আগামী ৩ বছর মেলার নির্ধারিত বিআইসিসি ভেন্যু ভাড়া মওকুফ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।

স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ

১. বাংলাদেশের সকল আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ বিমান বন্দরগুলোতে ও অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ স্থানসমূহে মিট এন্ড গ্রিট বা ইনফরমেশন বুথ স্থাপনে টোয়াবকে অনুমতি প্রদান করা এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।

২. অন অ্যারাইভাল ভিসার পাশাপাশি ই-ভিসা প্রবর্তন করা এবং অন অ্যারাইভাল ভিসা ও ই-ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে টোয়ার-সদস্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রত্যয়ন ও ভ্রমণসূচি বাধ্যতামূলক করা।

৩. বাংলাদেশের পর্যটন-পণ্য উন্নয়ন ও প্রসারে ইউএনডব্লিউটিও, ইউএনডিপি, আইএলও, এডিবি, জাইকা, বিশ্বব্যাংক-সহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে অনুদান ও সহজ-ঋণ আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৪. আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনের প্রচার, ব্র্যান্ডি ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন এবং এ কার্যক্রমে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও পর্যটন কর্পোরেশনের পাশাপাশি টোয়াবকে সম্পৃক্ত করা। এছাড়াও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড কর্তৃক সকল প্রকার অনুষ্ঠান আয়োজনে টোয়াবকে সম্পৃক্ত করা।

৫. টোয়াবের সহযোগী সদস্যদের যাদের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট আছে সেগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট ক্রয়ে ট্যাক্স ফ্রি সুযোগ প্রদান করা।

৬. স্থানীয় ট্যুর অপারেটররা যেন উপকৃত হন, সে জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে পরবর্তী এক বছরের জন্য বিদেশি অনলাইন বুকিং ইঞ্জিন (booking.com, agoda.com, expedia.com, makemytrip.com etc.) ও পর্যটন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও লেনদেন প্রক্রিয়ায় ক্রেডিট ব্যবহার সীমিত করে টোয়াব সদস্যদের মাধ্যমে সেবা গ্রহণে নিশ্চিত করা।

৭. বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে টোয়াবের সদস্যদের জন্য পজ মেশিন ও ইএমআই সুবিধা প্রণয়নের ব্যবস্থা করা।

৮. ‘ট্রাভেল উইথ ট্যুর অপারেটর’ শীর্ষক সামাজিক প্রচার কর্মসূচি পরিচালনা করা, যেখানে বার্তা থাকবে যে সর্বোচ্চ সেবার জন্য টোয়াব সদস্যদের প্রাধান্য দেয়া।

এমবি//