ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

রমজানকে যেভাবে অর্থবহ করবেন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:২২ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১১:৫১ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার

যে ব্যক্তি রমজান পেল এবং রমজানের রোজা পেলো কিন্তু নিজেকে গোনাহমুক্ত করতে পারল না তার মতো অভাগা আর কেউ নেই। আর যে ব্যক্তি পবিত্র রমজান পেল এবং তার হক সঠিকভাবে পালন করলো, সে এমনভাবে পাপমুক্ত হলো যেন সে সদ্য মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হলো।

প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সে বিখ্যাত হাদিসটিতে রোজার আবশ্যক কর্তব্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেছে। যেখানে তিনি রমজানের হক আদায় না করলে কী পরিণতি হবে তা বর্ণনা করেছেন। 

হাদিসে এসেছে-হজরত কাব ইবনে উজরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এক দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (মসজিদে নববির) মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন, তখন বললেন, ‘আমিন’। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন, তখন বললেন, ‘আমিন’। যখন তিনি তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন তখনও বললেন, ‘আমিন’।

হজরত কাব ইবনে উজরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন তিনি (মিম্বর থেকে) নামলেন, আমরা তাঁর কাছে আমিন বলার কারণ জানতে চাইলাম। বললাম এর আগে আপনাকে কখনো এভাবে আমিন বলতে শুনিনি।

উত্তরে তিনি বললেন, প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সময় জিবরিল আলাইহিস সালাম আমার কাছে এসে বললেন, ‘ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যে রমযান মাস পেল, তবুও তার গোনাহ মাফ করাতে পারল না। আমি বললাম, ‘আমিন’।

যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম তখন বললেন, ‘ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যার কাছে আপনার নাম উচ্চারিত হলো অথচ সে আপনার প্রতি দরূদ পাঠ করল না। আমি বললাম, ‘আমিন’।

যখন তৃতীয় সিড়িঁতে পা রাখলাম, তখন বললেন, ‘ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যে বৃদ্ধ পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তারা জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না। অর্থাৎ তাদের খেদমতের মাধ্যমে নিজেকে জান্নাতবাসী করতে পারল না। আমি বললাম, ‘আমিন।’ (মুসলিম, তিরজিমি)

মুসলিম উম্মাহর জন্য রমজানের রোজার গুরুত্ব কতবেশি তা সহজেই বোধগম্য। সুতরাং রমজানের রহমত ও বরকত লাভে মুমিন মুসলমান যে নমুনায় রোজা পালন করবেন, যে বিষয়গুলো প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবেন। আলেমগণ এই রমজানকে সুন্দর একটি রুটিনের মধ্যে পালনের কথা বলেছেন।

রোজায় একটি দিনের রুটিন কেমন হওয়া উচিৎ তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-

- রমজানের চাঁদ দেখার পর রাতের নামাজ তারাবিহ যথাযথ ভাব-গাম্ভীর্যের সঙ্গে আদায় করা।
- শেষ রাতে সাহরি খাওয়ার আগে তাহাজ্জুদ ও ক্ষমা প্রার্থনার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া।
(সেহেরীর অন্তত এক ঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জু পরতে হবে। প্রতিদিন অন্তত ২ রাকাত তাহাজ্জুদ অবশ্যই পড়তে হবে। ধীর স্থির ভাবে মনোযোগের সঙ্গে এই নামাজ আদায় করতে হবে। পরিবারের সবাই যেনো এই নামাজ আদায় করেন সেদিকটি খেয়াল রাখতে হবে।) 
- রাতের শেষ সময়ে সাহরি খাওয়া। ওয়াক্ত শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে সাহরি খাওয়া শেষ করা। সাহরিতে পেট ভরে না খাওয়া বরং কিছু কম খাওয়ার চেষ্টা করা।
(সাহরি খাওয়ার পর দোয়ায় বসতে হবে। একান্তে নির্জনে এই দোয়া হতে পারে। পরিকল্পনা করে এটা করতে হবে।)
- এরপর দেরি না করে মসজিদে চলে যাওয়া (সামাজিক কোন কারণে মসজিদে যাওয়া সম্ভব না হলে, বাসায় নামাজ আদায় করা)। মনোযোগের সঙ্গে ফজরের আজান শোনা এবং উত্তর দেয়া। আজানের পর দরূদ পড়ে দোয়া করা।
- আজানের পর সুন্নত পড়ে জামাতের জন্য অপেক্ষা করা। যতটুকু সম্ভব এ সময় মাসনুন দোয়া, জিকির এবং তাওবা-ইসতেগফারে মশগুল থাকা।
- ফজরে জামাআতের ইকামাত শুরু হলে আজানের মতো ইকামতের উত্তর দেয়া এবং আল্লাহর সামনে হাজিরা দেয়ার মানসিকতায় এ নামাজকে জীবনের শেষ নামাজ মনে করে তা মনোযোগের সঙ্গে আদায় করা।
- ফজরের সালাম ফেরানোর পর ১ বার তাকবির আর ৩ বার ইসতেগফার পড়া।
সম্ভব হলে এ তাসবিহগুলো আদায় করা-
- ‘আল্লাহুম্মা আংতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম, তাবারাক্বতা ইয়া জাল ঝালালি ওয়াল ইকরাম’ পড়া।
- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ পড়া।
- আয়াতুল কুরসি ১ বার পড়া।
- তাসবিহ ফাতেমি পড়া। ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩/৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়া।
- ‘বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়া দুর্রু মাআসমিহি শাইয়ুন ফিল আরদি ওয়া লা ফিস সামায়ি ওয়া হুয়াস সামিয়ুল আলিম’ ৩ বার পড়া।
- দরূদ শরিফ পড়া।
- তাওবা ও ইসতেগফার পড়া।
- সুরা হাশরের শেষ ৩ আয়াত পড়া।
- সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করা। অতঃপর
- সূর্য ওঠে গেলে ৪ রাকাআত ইশরাকের নামাজ আদায় করে বিশ্রামে যাওয়া।
- বিশ্রামের পর (ঘুম থেকে উঠে) অফিসে, কাজে বের হওয়ার আগে ৪ রাকাআত চাশতের নামাজ পড়ে নেয়া।
- যাদের কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য কুরআন তেলাওয়াত কিংবা তেলাওয়াত শোনা, কুরআন অধ্যয়ন কিংবা কুরআনের অনুবাদ বুঝে বুঝে পড়ার মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করা। রমজানে সব সময় কোরআনের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করা। 
- জোহরের নামাজের আগেই ওজু ও গোসল সেরে আগে আজানের সময় কিংবা আরো আগে মসজিদে চলে যাওয়া (সামাজিক কোন কারণে মসজিদে যাওয়া সম্ভব না হলে, বাসায় নামাজ আদায় করা)। সুন্নাতের পর জামাআতের আগে তাসবিহ-তাহলিল, কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকা।
- যারা খতম তারাবিহ আদায় করেন, প্রতিদিনের তারাবিহতে তেলাওয়াত করা কুরআনের অংশটুকু অর্থসহ পড়া। সম্ভব হলে তাফসির দেখে নেয়া। অন্তত সে অংশটুকু ভালো করে তেলাওয়াত করা।
- রাতের তারাবিহ সুন্দর ও প্রাণবন্ত করতে সম্ভব হলে আসরের আগে পরিমাণমত বিশ্রাম গ্রহণ করা।
- বিশ্রাম গ্রহণের পর আসরের নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে চলে যাওয়া (সামাজিক কোন কারণে মসজিদে যাওয়া সম্ভব না হলে, বাসায় নামাজ আদায় করা)। সম্ভব হলে সুন্নত নামাজ পড়ে জামাআতের অপেক্ষা করা এবং তাওবা-ইসতেগফার করা।
- আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত তেলাওয়াত, দোয়া-জিকিরে মনোনিবেশ করা।
- ইফতারের আগ মুহূর্তে ইফতারি সামনে নিয়ে ইফতারের জন্য অপেক্ষা করা। আর আল্লাহর তাসবিহ ও জিকিরে মশগুল থাকা।
- ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে খেজুর দিয়ে ইফতার করা। খেজুর না থাকলে সাদা পানি দ্বারা ইফতার গ্রহণ করা (ইফতারিতে ভাজাপোড়া খাওয়া থেকে বিরত থাকা)। 
- ইফতারের পর প্রশান্তির দোয়া পড়া- ‘জাহাবাজ্জামাউ ওয়াব তালাক্বিল উরুকু ওয়া ছাবাতাল আঝরু ইনশাআল্লাহু তাআলা।’
(যে, খেজুর এবং পানি দিয়ে ইফতার করে বেশি তৈলাক্ত খাবার কিংবা অন্যান্য খাবার বেশি পরিমাণে না খাওয়া। মাগরিবের নামাজ আদায় করে খাবার গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারি।)
- মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে চলে যাওয়া (সামাজিক কোন কারণে মসজিদে যাওয়া সম্ভব না হলে, বাসায় নামাজ আদায় করা)। ফজরের পর যে তাসবিহ ও দোয়াগুলো পড়তে বলা হয়েছে, সেগুলো পড়া। অতঃপর তারাবিহ নামাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
- যারা কর্মব্যস্ত তারা কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলে তাসবিহ-তাহরির, তাওবা-ইসতেগফারে নিজেকে নিয়োজিত রাখা আবশ্যক।
- রাতে যত দ্রুত সম্ভব ঘুমাতে যাওয়া। কারণ পরের দিনের রুটিন আবারও শুরু করতে আপনাকে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠতে হবে (ঘুমাতে যাওয়া আগে সম্ভব হলে কিছু সময় কোরআন অর্থসহ পড়া)।
- পুরো দিনে কোন প্রকার মিথ্যা থেকে দূরে থাকা, দান করা, রোজাদারদের ইফতারি কারানো।
- একজন (সম্ভব হলে অধিক সংখ্যক) এতিমদের পুরো মাসে খাওয়ান।

এভাবেই পুরো রমজান মাস মন্দ ও অন্যায় কাজ থেকে নিজেদের বিরত রেখে ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখার মাধ্যমে বিগত জীবনের গোনাহগুলো মাফ করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা।

হাদিসে পাকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের আশায় রাতের নামাজ তারাবিহ আদায় করবে, আল্লাহ তাআলা তার আগের জীবনের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’

মুমিন মুসলমানের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের অন্যতম মাস রমজান। এ মাসের ইবাদতই বছর জুড়ে লালন করবে মুমিন। মন্দ কাজ ত্যাগ করে ভালো কাজে নিয়োজিত থাকবে রোজাদার।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত তারাবিহ, তাহাজ্জুদ, জিকির-আজকার ও তাওবা-ইসতেগফার, দান-খয়রাতের মাধ্যমে পুরো রমজান মাস অতিবাহিত করা।
এসএ/