ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

করোনাকালে বিজ্ঞান আর ধর্ম বিতর্ক

রাশেদ আহমেদ

প্রকাশিত : ১২:৫২ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৩:৩১ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০২০ মঙ্গলবার

‘যদি বেঁচে যাও এবারের মতো। যদি কেটে যায় মৃত্যু ভয়। জেনো বিজ্ঞান লড়েছিলো একা। কোন মন্দির-মসজিদ নয়’। করোনাকালে এ ধরণের লেখা পোস্ট হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর বিপরীত জবাবে পোস্ট এসেছে এ রকম-‘যদি ক্ষমা পাও এবারের মতো। কেটে যায় যদি ভয়াল দিন। জেনো, বিজ্ঞান অসহায় হয়ে প্রভুকে ডেকেছে অন্তহীন’।

বলা হয় প্রথম পোস্টটি যারা ধর্মে অতোটা বিশ্বাসী নয়, অনেকটা প্রগতিশীল তাদের। আর পরের পোস্টটি তাদের, যারা ধর্মে বেশি বিশ্বাস করেন। এই দুটো পোস্ট ধর্ম আর বিজ্ঞানকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আসলেই কি দুটো মুখোমুখি দাঁড় করানোর বিষয়? 

যা প্রমাণিত তাইতো বিজ্ঞান। আর যা প্রমাণ করা যায় না, বিশ্বাসের ওপর থাকে তা হচ্ছে ধর্ম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় লেখক ড্যান ব্রাউন তার দ্য দা ভিঞ্চি কোড বইয়ে লিখেছেন ‘বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের সংমিশ্রনের যৌক্তিকতাটা কী? যে ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস ধারণ করেন তার দ্বারা নিরপেক্ষ বিজ্ঞান ভাবনা সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় বিশ্বাসী কারোর জন্য তার বিশ্বাসের স্বপক্ষে বস্তুগত কোন প্রমানের’। 

ড্যান ব্রাউন বেশিরভাগই ধর্মের বিরুদ্ধে লিখেছেন। থৃলার উপন্যাস দা ভিঞ্চি কোডে খ্রিস্টান ধর্মের নানা অসারতা তুলে ধরেছেন। যীশুর বান্ধবী/স্ত্রী, সন্তান নিয়ে গোপনীয়তাও প্রকাশ করতে ছাড়েননি পুরোনো গসপেলের উদাহরণ উল্লেখ করে। সত্য-মিথ্যা সেটির বিতর্ক ঐতিহাসিকের বিচার্যের ব্যাপার।

বাংলাদেশের লেখক ড. রমণীমোহন দেবনাথ তার লেখা ‘সিন্ধু থেকে হিন্দু ‘ বইয়ে নানা প্রমাণ ধরে দেখিয়েছেন হিন্দু কোন ধর্ম নয়। অহেতুক সনাতন ধর্ম বলে আখ্যা দেয় কেউ কেউ। এটি আচার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তার ভাষায় এটি প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সাথে যুক্ত। এর দেবদেবীও হচ্ছে রূপান্তরিত।

ড. হুমায়ুন আজাদও ধর্মকে কষাঘাত করেছেন। তার ‘আমার অবিশ্বাস’ বইয়ে লিখেছেন,  ‘বিশ্বাসের চেয়ে বারান্দার চড়ুইটিও জীবনের জন্য অনেক মূল্যবান। চড়ুইটি যা দিতে পারে বিশ্বাস তা পারে না’। ইসলাম ধর্মের নানা বিধি-বিধানের সমালোচনা করেছেন তীর্যক ভাষায়। বলেছেন, ‘মানুষের জন্য যা কিছু ক্ষতিকর সেগুলোর শুরুতেই রয়েছে বিশ্বাস। বিশ্বাসের কাজ অসত্যকে অস্তিত্বশীল করা’।

এতোসব আলোচনা উঠছে করোনায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়া বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে। এই ভয়াল অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বিজ্ঞান যখন লড়ে যাচ্ছে অক্লান্তভাবে তখন ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে প্রার্থনা বাড়িয়ে আরও বিপত্তি ডেকে আনে। নানা ফতোয়া দিয়ে বিভ্রান্ত করে মানুষকে। বিজ্ঞানের এই লড়ে যাওয়ার জবাব ধর্মীয় ব্যাক্তিরা দিচ্ছেন এভাবে- ‘লড়তেতো হবে তাদেরই। করোনা মসজিদ-মন্দির-গির্জা আনেনি। এর জন্য দায়ী ওই বিজ্ঞানই’।

বিজ্ঞান যেমন বিমান বানিয়ে উপকার করেছে তেমন এটোম বোমা বানিয়ে বিস্তর ক্ষতিও করেছে বিশ্ব মানবতার। এর উত্তর কি হবে? হতে পারে এভাবে , একটি চকচকে ছুরি দিয়ে আপেল কাটা যায় আবার মানুষও হত্যা করা যায়। ছুরি আপনি কিভাবে ব্যবহার করবেন সেটি আপনার বিষয়। ছুরির দোষ কী?

প্রশ্ন হচ্ছে বিজ্ঞান আর ধর্মকে কি মুখোমুখি দাঁড়ানোর বিষয়? 

আমি বলি না। বিজ্ঞান ও ধর্ম তার নিজ নিজ জায়গায় থেকে তার মতো করেই কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিজ্ঞান যেখানে শেষ করে ধর্ম সেখান থেকে শুরু করে। বিজ্ঞান যখন বলে আকাশ বলতে কিছু নেই, এটা শূন্যতা। ধর্ম বলে এ শূন্যতার অনেক ওপর  সৃষ্টিকর্তা আছেন। বিজ্ঞানের ক্ষমতা নেই তার কাছাকাছি যাওয়া। বিজ্ঞান যতো এগোবে ধর্ম তারও একধাপ পরে থাকবে। বিজ্ঞান মানব কল্যাণে অনেক কিছু দিয়েছে। মোবাইল ফোনে মূহুর্তেই ১৫ হাজার মাইল দূরে থেকেও গল্প করা যায় কাছাকাছি বসে থাকার মতো। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করে মানুষ বেঁচে থাকে বিজ্ঞানের কৃপায়। এরপরও প্রাণী সৃষ্টি করতে না পারা বা মৃত্যু ঠেকাতে না পারার ব্যার্থতার জন্য জয় জয়কার ধর্মের। আর এখানেই ধর্মীয় নেতারা কন্ঠ উঁচু করে বলেন, বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা। বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো সৃষ্টিকর্তার অনস্তিত্বকে প্রমান করতে পারবেনা। বিজ্ঞানের সব থিওরি সৃষ্টিকর্তার বিশাল সৃষ্টিযজ্ঞেরই অংশ। সৃষ্টিকর্তার কাছে সবাই অসহায় ইত্যাকার।

আসলে ধর্ম আর বিজ্ঞান নিয়ে বিতর্কের শেষ হবে না। তাই এই বিতর্ক অর্থহীন। ধর্ম আর বিজ্ঞান এক সাথে চলেনা, সমান্তরাল ভাবেও চলেনা। তবে কি বিপরীতমুখি? এ কথাও পুরোপুরি সঠিক নয়। ধর্ম চলছে ধর্মের মতো আর বিজ্ঞান তার মতো। 

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় অনেক সময় ধর্মের অসাড়তা ধরা পড়ে। ধর্ম সেটি নিশ্চুপ মেনে নেয়। অথবা মেনে নেয়ার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়। আবার বিজ্ঞান যা এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি সেখানে ধর্ম বলছে সৃষ্টিকর্তা  তার সব রহস্য উন্মোচন করতেতো দেবেন না। 

বিজ্ঞান সবকিছুর ব্যাখ্যা খোঁজে আর ধর্ম খোঁজে সবকিছুর অর্থ। এই বিশ্ব কিভাবে তৈরি হলো সেটি নিয়ে ধর্মের মাথা ব্যাথা নেই। বিজ্ঞানী  স্টি-ফেন হকিং ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে সবসময় বিজ্ঞানকেই এগিয়ে রেখেছেন। তার ভাষায় ‘ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে কর্তৃত্বের ওপর ভিত্তি করে, আর বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির ওপর। বিজ্ঞান কার্যকর বলে বেশি গ্রহনযোগ্য’।

এর বিপরীত অবশ্য বলেছেন, জাপানি বংশদ্ভুত বিজ্ঞানী মিচিও কাকু। তার এক বইতে লিখেছেন, ‘ধর্ম ও দর্শন বিজ্ঞানের শত্রু নয় বরং বন্ধু। ধর্ম ও দর্শনের সাহায্যে বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটে, অবনতি নয়। মিচিও কাকুর এই কথাগুলোর সাথে মিলে যায় বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কিছু কথার। ১৯৪১ সালে আইনস্টাইন তার ‘সায়েন্স, ফিলোসোফি এন্ড রিলিজিয়ন’ শীর্ষক সম্মেলনে বক্তব্যের শেষে বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম পঙ্গু এবং ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অন্ধ’। 

বিজ্ঞান ও ধর্ম  আরেকটি পার্থক্য হচ্ছে মানব জাতির যেকোন দুর্যোগে বিজ্ঞানই সবার আগে এগিয়ে আসে, উত্তোরণের পথ খুঁজতে থাকে। আর ধর্ম সৃষ্টিকর্তার দিকে করুণাভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। আর দুর্যোগের জন্য মানব সমাজকে দোষারোপ করে। বলা হয় তাদের পাপের ফল। যা বিশ্বে করোনার মহামারিতে করা হচ্ছে। করোনা থেকে বাঁচতে যখন বলা হয়েছে ঘরে থাকতে তখন ধর্ম পালনকারীরা প্রার্থণার জন্য সমবেত হন মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায়। এতে সংক্রমণ আরও বাড়তে থাকে। যদিও এখন এই প্রবনতা নিয়ন্ত্রণ করা গেছে কঠোর বিধি-নিষেধের কারণে। 

আমার মতে বিজ্ঞান যেমন আমাদের জন্য অপরিহার্য,তেমন প্রয়োজন আছে  ধর্মেরও। মানুষ বরাবরই উশৃংখল প্রবন প্রাণী, তাকে সঠিক পথে রাখতে হয়। মানুষের অন্তর শুদ্ধির বড় উপায় হচ্ছে ধর্ম পালন। কোন কোন সময় মানুষকে ধর্মের ভীতি দেখিয়ে ন্যায়ের পথে আনা ও রাখা যায়। ধর্মের একটি ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে যা মানুষকে বশ করতে পারে। ধর্মের মূল বিষয় হচ্ছে অদৃশ্য অসীম ক্ষমতা, যিনি সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা। তার কাছেই মানুষ নিজেকে সমর্পণ করে। মানুষের যেকোন বিপদে সৃষ্টিকর্তাই উদ্ধার করেন। এই যে সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাসী এরও একটি শক্তি আছে যেটি অন্তরের শক্তি বাড়িয়ে দেয়। এতে করে বেড়ে যায় মনোবল। 

মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার বড় উপায় হচ্ছে নিজের ভেতরের শক্তি বাড়ানো। ইমিউন শক্তি বেশি থাকলে করোনা  পরাস্ত করতে পারবেনা বরং ভাইরাস হেরে গিয়ে  ধ্বংস হয়ে যাবে। যাদের ধর্মে বিশ্বাস নেই তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো দ্বিতীয় কোন অদৃশ্য শক্তি নেই। আস্তিকরা মনে করে শেষমেষ সৃষ্টিকর্তা তাদের জন্য ত্রান কর্তা হয়ে আসবেন। তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এই বিশ্বাস তার মানষিক শক্তি বাড়িয়ে দেয়। এটা বা কম কিসের? মানষিক শক্তি বৃদ্ধির ফলে যদি মানুষের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয় তাহলে করোনা ভাইরাস মোকাবেলা হয়ে যাবে এমনিতেই। ভ্যাকসিন প্রয়োজন হবে না। বিশ্বে ইতিমধ্যে করোনার প্রকোপ কমার দিকে। হতে পারে সচেতনতা ও সতর্কতার কারণে। অথবা মানুষের শরীর এই ভাইরাসের চরিত্র সম্পর্কে জেনে ফেলেছে আর সেভাবেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে শরীরের ভেতরে। 

ভবিষ্যতে করোনা থাকবে না। মানুষ একে পরাভূত করবেই। যেমন পরাজিত করেছে প্লেগ, স্পেনিশ ফ্লু, সার্স এর মতো সংক্রমণ ব্যাধি। আমার মতো বেশিরভাগ মানুষ এটি বিশ্বাস করেন। কারণ এই যুগে মানুষতো হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। মানুষ জিতবে। তবে বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে যে বিতর্ক তা হয়তো থামবে না, চলতেই থাকবে। কারণ দুটির মধ্যে পার্থক্য হয়ে বিশ্বাস আর প্রমানের। আমি বলবো যা ধর্মে বিশ্বাস করেন, বিজ্ঞানকে মানুন। আর যারা বিজ্ঞানের ওপর পুরোটাই বিশ্বাসী তাদের ধর্মকে অশ্রদ্ধ করার দরকার নেই। কারণ ধর্ম পৃথিবীতে থাকবে। এই বিশ্বাস মুছে ফেলা যাবে না।

এমবি//