ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

জীবনের বাঁকবদল

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০২:৩২ পিএম, ২ মে ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০২:৪৭ পিএম, ২ মে ২০২০ শনিবার

প্রথমপর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। আর দ্বিতীয়পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। এবার তৃতীয়পর্বে জানবেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে, তারপর প্রকাশ্যে।

মূর্তি বা অর্থ, খ্যাতি বা মর্যাদা–কোনোকিছুই তার দেবতা হতে পারে নি। কোনোকিছুই হেরা গুহায় ধ্যানে হারিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে নি। তিনি বরং ঘন ঘনই যেতে শুরু করলেন হেরা গুহায়। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের রমজান মাস। প্রায় পুরোটাই যখন কেটে যাচ্ছে আত্মনিমগ্নতায় তখনই ঘটল বাঁকবদলকারী ঘটনা। তখন তার বয়স ৪০ বছর ১১ দিন। রমজানের শেষ দশকে সম্ভবত ২৭ তারিখে সামনে দেখা দিলেন এক অলৌকিক সত্তা। পরিচয় দিলেন নিজের- ‘আমি জিবরাইল’।

মুহাম্মদ এর পরের ঘটনার বর্ণনায় বলেন - ‘জিবরাইল বলল, পড়ো!’ আমি জবাবে বললাম, ‘আমি পড়তে জানি না।’ তখন জিবরাইল আমাকে জাপটে বুকে চেপে ধরলে আমার মনে হলো আমি মরে যাচ্ছি। আবার বললাম, ‘আমি পড়তে জানি না।’ এইভাবে তিনবার বুকে চেপে ধরার পর আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘কী পড়ব?’ জিবরাইল তখন বলল- ‘পড়ো! তোমার সৃষ্টিকর্তা প্রভুর নামে। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিষিক্ত ডিম্ব থেকে। পড়ো! তোমার প্রতিপালক মহান দয়ালু। তিনি মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন কলমের। আর মানুষকে শিখিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সূরা আলাক : ১-৫)। আমি পড়লাম। 

জিবরাইল আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমি অস্থির ভাবনায় ডুবে গেলাম। উস্কোখুস্কো কবিদের আমার মোটেই পছন্দ না। আমার মনে হলো, কোরাইশরা সব শুনলে আমাকে ওদের (কবিদের) দলেই ফেলে দেবে। নানা ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে আমি পাহাড়ের ওপরদিকে উঠতে শুরু করলাম... হঠাৎ ওপর থেকে শুনি শব্দ ভেসে আসছে–‘আমি জিবরাইল। মুহাম্মদ, আপনি আল্লাহর রসুল।’ আমি ওপরদিকে তাকালাম, আমি জিবরাইলকে দেখলাম মানুষের রূপে– পা মাটিতে আর দেহ দিগন্তবিস্তৃত। সে আবার বলল, ‘মুহাম্মদ, আপনি আল্লাহর রসুল। আর আমি জিবরাইল।’ আমি স্থাণুর মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নড়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেললাম। দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু যেদিকে তাকাই দিগন্তবিস্তৃত তাকেই দেখতে পাই। একসময় সে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। আমি ঘরে ফিরে এলাম।’

মুহাম্মদ গুহা থেকে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে এলেন। স্ত্রী খাদিজাকে বললেন, ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। অনেকক্ষণ পর কাঁপুনি থেমে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায় এলে তিনি বিস্ময়ের সাথে খাদিজাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার কী হয়েছে?’ পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করে তিনি বললেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে’।  খাদিজা উত্তরে বললেন, ‘আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনি বিশ্রাম নিন। আল্লাহ আপনার কোনো অমঙ্গল করতে পারেন না। কারণ আপনি সত্যবাদী, দানশীল, অতিথিপরায়ণ ও ভালো কাজে এবং অন্যের প্রয়োজনে সাহায্যকারী। আপনি ঠিক দেখেছেন। আমি বিশ্বাস করছি, আপনি আল্লাহর রসুল।’ 

এরপর খাদিজা মুহাম্মদকে নিয়ে মক্কায় বসবাসকারী তার চাচাতো ভাই প্রাজ্ঞ ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। মুহাম্মদের জবানিতে সব কথা শুনে বর্ষীয়ান অন্ধ ওয়ারাকা বললেন, ‘নিঃসন্দেহে তুমি তওরাত ও বাইবেলে উল্লেখিত সেই প্রতিশ্রুত রসুল! এই বাণীই মুসার ওপর নাজিল হয়েছিল। বড় ইচ্ছা হয়, আমি যদি তরুণ হতাম তাহলে এই নগরের অধিবাসীরা যখন তোমাকে নগর থেকে বের করে দেবে, তখন আমি তোমার পাশে থাকতাম।’ বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে তিনি ওয়ারাকাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নগরবাসী আমাকে বের করে দেবে কেন?’ ওয়ারাকা বললেন, ‘আসলে শত্রুতার মুখোমুখি না হয়ে কোনো নবীই সত্যবাণী প্রচার করতে পারেনি। আমি যদি ততদিন বেঁচে থাকি আমি অবশ্যই তোমাকে সমর্থন করব।’ কিন্তু কয়েকদিন পরই ওয়ারাকা মারা গেলেন।

সূরা আলাকের প্রথম পংক্তিমালা নাজিলের পর বেশ কিছুদিনের নীরবতা। জিবরাইল আর কোনো বাণী নিয়ে আসছেন না। অস্থিরতা সৃষ্টি হলো তাঁর মনে। আসলে ঘটনাটা কী? মাথা ঠিক আছে তো? উন্মাদ হয়ে যাইনি তো? একধরনের সন্দেহ সংশয়ের দোলাচলে যখন তাঁর মন দুলছিল, তখন নাজিল হলো সূরা কলমের এক থেকে ছয় আয়াত: ‘নূন। ভাবো কলম নিয়ে। আর তা দিয়ে যা লিপিবদ্ধ করা হয়। তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি উন্মাদ নও। নিশ্চয়ই তোমার জন্যে রয়েছে অশেষ পুরস্কার। কারণ তুমি নিশ্চিতভাবেই নির্মল চরিত্রে অধিষ্ঠিত। শিগগিরই তুমি দেখবে এবং (যারা অপপ্রচার করছে) তারাও দেখবে, কারা বিকারগ্রস্ত।’ (সূরা কলম: ১-৬)

আবার নীরবতা। আগের চেয়ে দীর্ঘসময় ধরে নীরবতা। আর কোনো ঐশীবাণী আসছে না। আবার সংশয়ে ডুবে যাওয়া। আবার হতাশা নিয়ে ফিরে আসা খাদিজার কাছে। আমার প্রভু কি আমাকে পরিত্যাগ করেছেন? খাদিজা আগের মতোই তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, আপনি এমন কিছুই করেন নি, যাতে প্রভু অসন্তুষ্ট হতে পারেন। সূরা দোহা নাজিলের মধ্য দিয়ে নীরবতার অবসান হলো। ‘ভাবো সকালের সোনালি আলো আর রাতের নিকষ অন্ধকার নিয়ে। (হে নবী!) তোমার প্রতিপালক কখনো তোমাকে ত্যাগ করেন নি। না তিনি কোনো ব্যাপারে তোমার ওপরে অসন্তুষ্ট। নিঃসন্দেহে তোমার পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে পরবর্তী সময় অনেক ভালো। অচিরেই তোমার প্রভু তোমাকে এমন নেয়ামত দান করবেন, যাতে তুমি পরিতৃপ্ত হবে। তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পাননি এবং তারপর তোমাকে আশ্রয় দান করেন নি? পথহারা অবস্থা থেকে তিনি কি তোমাকে সত্যপথের সন্ধান দেননি? নিঃস্ব অবস্থা থেকে তিনি কি তোমাকে অভাবমুক্ত করেন নি? অতএব তুমি এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না। কোনো সাহায্যপ্রার্থীকে তিরস্কার কোরো না। আর সবসময় তোমার প্রতি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করতে থাকো।’ (সূরা দোহা: ১-১১)

এরপর একের পর এক নাজিল হতে শুরু হলো সূরার পর সূরা। মক্কার বণিক-পুরোহিতদের প্রচারিত ভোগবাদী ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি সংশোধনই ছিল এর লক্ষ্য। কোরআনের বাণী খুব সহজসরল। কিন্তু সত্য-মিথ্যা নিরূপণে সুস্পষ্ট। ন্যায়-অন্যায় বর্ণনায় আপসহীন, শাশ্বত। তারপরেও সমকালীন ও উত্তর আধুনিক। ছোট্ট একটি বাক্য, ‘আল্লাহ এক। তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।’ অর্থাৎ স্রষ্টা এক। সকল মানুষ তাঁরই সৃষ্টি। অতএব মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ করা চলবে না। সব মানুষ সমান। জন্মের কারণে কেউ অভিজাত নয়, কেউ অচ্ছুত নয়। একজনের মর্যাদা নির্ধারিত হবে তার কর্ম দ্বারা। যে যা করবে সে তার ফল ভোগ করবে। তোমরা শুধু এক আল্লাহর উপাসনা করবে। কোনো কল্পিত দেবতা, কোনো মূর্তির উপাসনা করবে না। অর্থ, ধনসম্পদ, খ্যাতি বা ক্ষমতাকে দেবতা বা উপাস্য বানাবে না। কোনোকিছুকেই আল্লাহর সাথে শরিক করবে না বা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার অংশীদার বানাবে না।

আর একটি ছোট্ট বাক্য, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল।’ অর্থাৎ মানুষের পরিত্রাণের জন্যে আল্লাহর দিক-নির্দেশনা পৌঁছে দিচ্ছেন মুহাম্মদ। এই বাণীর আলোকে ভালো কাজগুলো করবে, খারাপ কাজগুলো বর্জন করবে। সবসময় শোকরগোজার থাকবে। জীবনকে শান্তি-সুখে ভরপুর করার জন্যে রসুল বা বাণীবাহককে অনুসরণ করবে। তুমি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়ে যাওনি। এক স্রষ্টা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। জ্ঞান দিয়েছেন। বুদ্ধি দিয়েছেন। শক্তি দিয়েছেন। ক্ষমতা দিয়েছেন। দিয়েছেন কর্মের স্বাধীনতা। কিন্তু তুমি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নও। তোমার মেধা, শক্তি ও ক্ষমতাকে কী কাজে ব্যবহার করেছ, তার হিসাব দিতে হবে। তোমার কর্ম অনুসারেই নির্ধারিত হবে কর্মফল।

অন্যদিকে, বেনিয়া শোষকদের কথা ছিল- খাও-দাও-আয়েশ করো। জুলুম করো। লুট করো। শোষণ করো। প্রতারণা করো। ঠকাও। মাল কামাও। যত পারো ভোগ করো। জুয়া মাদকে ডুবে যাও। ফুর্তি করো। পরকীয়া করো। ব্যভিচার করো। একবার মরে গেলে সব শেষ। পচাগলা হাড়মাংসে কেউ প্রাণ দিতে পারবে না। পরকাল! সেটা তো সেকেলে কল্পকাহিনী। তাই শক্তিমানদের সাথে থাকো। মনে রেখো, জোর যার মুল্লুক তার। ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। যত আমাদের দালালি করবে, তোমরা তত মাল পাবে, তত ক্ষমতাবান হবে, তত ফুর্তিতে থাকবে। 

কিন্তু আল্লাহ বাণী পাঠালেন- মরে গেলে সব শেষ নয়। বোকার মতো কেন ভাবছ, যিনি তোমাকে একবার সৃষ্টি করেছেন, তিনি তোমাকে পুনঃসৃজন করতে পারবেন না! আসলে তোমার পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী। আর মরে গেলে তুমি প্রবেশ করবে অনন্ত জীবনে। দুনিয়ার জীবনে যেমন কাজ করেছ তার পুরো ফল তোমাকে দেয়া হবে। ভালো কাজ করলে চিত্তহারী পুরস্কার পাবে। আর অন্যায় জুলুমের শাস্তিও পাবে যথাযথ। অতএব জুলুম শোষণ অন্যায় করবে না। চুরি করবে না। লুটপাট করবে না। প্রতারণা করবে না। পরকীয়া, ব্যভিচার করবে না। খুন করবে না। আত্মঘাতীও হবে না। মানুষকে ভালবাসো। প্রতিবেশীকে ভালবাসো। অভাবীকে দান করো। দুর্বলকে মায়া করো। নিজের কল্যাণে ও অন্যের কল্যাণে কাজ করো। তোমাকে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। তখন তুমি অনন্ত আনন্দলোকে থাকবে।

হেরা গুহার একটি ঘটনায় তাঁর জীবন পুরোপুরি পাল্টে গেল। তিনি বুঝলেন, যদি মানুষ আল্লাহতে সমর্পিত হয়, সকল কাজের জবাবদিহিতা অর্থাৎ আখেরাতে বিশ্বাসী হয়, তাহলেই সে জুলুম শোষণ থেকে দূরে থাকবে। অন্যের কল্যাণে আগ্রহী হবে। তাই কোমলমনা নির্বিরোধ ভালো মানুষটি শুরু করলেন আল্লাহতে সমর্পিত অকুতোভয় জীবন। শুরু করলেন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ বদলানোর কাজ। নির্দেশ পেলেন ফজর ও আসরে দুই রাকাত করে নামাজ পড়ার। জিবরাইল তাঁকে ওযু করতে ও নামাজ পড়তে শেখালেন। তিনি শেখালেন খাদিজাকে। একদিন তাঁরা দুজনই নামাজ পড়ছিলেন। চাচাতো ভাই আলী (বয়স তখন ১০) হঠাৎ তাঁদের নামাজরত অবস্থায় দেখে বিস্মিত হলেন। আলীর কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদ (স) বললেন, আল্লাহ আমাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন মানুষকে সত্যপথে ডাকার জন্যে। 

এরপর তিনি আলীকে আহ্বান জানালেন পৌত্তলিকতা বর্জন করে এক আল্লাহর ইবাদত করার পথে। পিতা আবু তালিবের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে আলী সময় নিলেন। কিন্তু আলীর অন্তরে তখন ঝড় বইতে শুরু করল। রাত পোহাতেই পিতাকে জিজ্ঞাসা করা ছাড়াই তিনি সত্যকে গ্রহণ করলেন। নবীজীকে এসে বললেন, ‘আল্লাহ আমার পিতা আবু তালিবের সাথে পরামর্শ ছাড়াই আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তাহলে আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে আমাকে কেন পিতার পরামর্শ নিতে হবে?’ আলীর পরই ইসলাম গ্রহণ করলেন পালকপুত্র জায়েদ ইবনে হারিসা।

ওয়ারাকার (মৃত্যুর আগে) সাথে আলাপ করার পরই নবীজী আঁচ করতে পেরেছিলেন ভবিষ্যৎ প্রবল বিরোধিতার। বুঝলেন, সত্যবাণীর প্রচার করতে হবে নীরবে গোপনে। প্রকাশ্য প্রচারের আগে সমমনাদের নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নতুন বিশ্বাসে বলীয়ান করতে হবে। নতুন বিশ্বাসের জন্যে যে-কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত করতে হবে। তাহলেই তারা যে-কোনো বিরোধিতা মোকাবিলায় অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে, যে-কোনো নির্যাতন সহ্য করতে পারবে। 

পরিবারের বাইরে প্রথমেই শাশ্বত ধর্মের কথা বললেন বন্ধু আবু বকরকে। আবু বকর ইসলাম গ্রহণ করলেন শোনামাত্রই। আবু বকর অভিজাত কোরাইশদের একজন। তিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, জ্ঞানী, সৎ, সদালাপী ও সদাচারী। আবু বকর ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন নীরবে, তিনি যাদের আস্থাভাজন তাদের কাছে। এরা অধিকাংশই ছিল তার ব্যবসায়িক বন্ধু ও অভিজাত ভালো মানুষ। যারাই ইসলাম গ্রহণ করত, তিনি তাদেরকে একজন একজন করে গোপনে নবীজীর কাছে নিয়ে যেতেন। সেখানে তারা ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা দিত এবং উপদেশ নিয়ে যেত। এইভাবে উসমান ইবনে আফফান, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, তালহা, জুবায়ের সংযুক্ত হলেন নতুন বিশ্বাসের সাথে।

এরপর একে একে ইসলাম গ্রহণ করলেন আবু উবায়দা, আবু সালামা আবদুল্লাহ, আরকাম ইবনে আবুল আরকাম, উসমান ইবনে মাজউন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, সাঈদ ইবনুল আস, আমর ইবনে আনবাসা, উবায়দা ইবনে হারিস, খালিদ ইবনে সাঈদ, সাঈদ ইবনে জায়েদ, আম্মার, বেলাল। মহিলাদের মধ্যে উম্মুল ফদল, নবী-তনয়া জয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতেমা, আবু বকর তনয়া আসমা ও (ওমরের বোন) ফাতেমা ইসলাম গ্রহণ করলেন। প্রথম তিন বছরে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা মাত্র ৩০ জন। এর একটা বড় অংশই ছিল সমাজের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষ।

সাফা পাহাড়ে আরকাম মাখজুমির বাড়ি ইসলাম প্রচারের গোপন কেন্দ্রে পরিণত হলো। আরকামের বাড়িকে গোপন কেন্দ্র করার মধ্য দিয়ে আমরা নবীজীর দূরদৃষ্টির ও প্রজ্ঞার পরিচয় পাই। প্রথমত আরকাম ছিলেন বনু হাশিমের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বনু মাখজুম গোত্রের। চারপাশেই আবু জেহেলের বনু মাখজুম গোত্রের ঘরবাড়ি। তাছাড়া আরকাম ছিলেন বয়সে তরুণ এবং তিনি মুসলমান হওয়ার কোনো প্রকাশ্য ঘোষণা দেননি। ফলে নবীজী গোপন কাজের পুরো সময়ই এখানে নির্বিঘ্নে বৈঠক ও প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। আবু জেহেল কখনো আঁচই করতে পারেনি তার দুর্গের ভিতরেই মুহম্মদ ধর্মীয় প্রশিক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মুসলমানরা তখন মক্কার বাইরে গিয়ে গোপনে নামাজ পড়তেন।

নবুয়তের প্রথম তিন বছর জীবনদৃষ্টি বদলানোর জন্যে প্রয়োজনীয় মৌলিক সূরা নাজিল হতে থাকে। অধিকাংশ সূরাই ছিল ছোট ছোট। এই সূরাগুলো মূর্তি ও কল্পিত দেবতার পূজা আর পিতৃপুরুষের সংস্কারের অন্ধ অনুসরণের অসারত্ব তুলে ধরে। প্রতিটি আয়াতের বাণী ও ধ্বনির ব্যঞ্জনা বিশ্বাসী-অন্তরকে আপ্লুত করে এক স্রষ্টার উপাসনায়—নিজের সবকিছু স্রষ্টার কাছে সমর্পণের। অবশ্য তাদের ইসলাম গ্রহণ ও অনুসরণে অনুঘটক ছিল নবীজীবন। তিনি একাধারে ছিলেন দয়ালু ও ক্ষমাশীল। বিনয়ী তারপরও পৌরুষদীপ্ত। মিষ্টভাষী কিন্তু ন্যায়নিষ্ঠ। প্রত্যেককেই তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে তৎপর। দুর্বল, এতিম, বঞ্চিত ও নিপীড়িতের প্রতি অফুরন্ত সমমর্মী। রাতের প্রায় পুরোটাই কাটাতেন ধ্যানে, নামাজে ও কোরআন তেলাওয়াতে—জীবন পরিচালনায় এর মর্ম অনুধাবনে। ঐশীবাণীর মূর্ত প্রতীককে নিজেদের মাঝে পাওয়ায় সংখ্যায় কম হলেও অনুসারীদের বিশ্বাসের গভীরতা যেমন বাড়ল তেমনি বিশ্বাসের জন্যে সর্বস্ব ত্যাগেও উদ্বুদ্ধ হলো তারা।

নবুয়তের তৃতীয় বছর শেষ। বিশ্বাসের জন্যে যে-কোনো ত্যাগ স্বীকারে এখন কিছু মানুষ প্রস্তুত ও সঙ্ঘবদ্ধ। অতএব আর গোপনে নয়। আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন প্রকাশ্যে মানুষকে সতর্ক করার জন্যে। তিনি প্রথমে সকল আত্মীয়কে বাসায় দাওয়াত দিলেন। সবাই এলো। খাবার শেষে তিনি যখন সবাইকে মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে এক আল্লাহর উপাসনার কথা বলতে শুরু করলেন, তাঁর চাচা আবু লাহাব উঠে দাঁড়ালেন এবং মজলিশ থেকে সবাইকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। মক্কাবাসীকে নবীজী এবার সরাসরি ইসলামের দাওয়াত দেয়ার উদ্যোগ নিলেন। একদিন তিনি সাফা পাহাড়ের ওপর দাঁড়ালেন এবং সবাইকে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানালেন। সবাই জড়ো হলে তিনি বললেন, ‘যদি আমি তোমাদের বলি যে, এই পাহাড়ের ওপারে বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী মক্কা আক্রমণের জন্যে সমবেত হয়েছে, তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?’ সবাই একবাক্যে জবাব দিল, ‘অবশ্যই! কারণ আপনি সত্যবাদী। কখনো আপনাকে আমরা মিথ্যা বলতে শুনিনি।’

নবীজী তখন বললেন, ‘তাহলে শোনো, আমি একজন সতর্ককারী! আমি তোমাদের সতর্ক করছি মহাবিচার দিবসের ভয়াবহ শাস্তি থেকে। এক আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নাই— এই ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত দুনিয়া বা আখেরাতে আমি তোমাদের কোনো কল্যাণ করতে পারব না।’ ধনাঢ্য বিলাসী বদমেজাজী আবু লাহাব সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল, ‘তোমার বিনাশ হোক! এই উদ্ভট কথা শোনাতে তুমি আমাদের ডেকেছ!’
সমবেতরা আবু লাহাবের পক্ষ নিয়ে তাকে গালাগালি করতে করতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর মুহাম্মদ (স) দেখলেন পাহাড়ে তিনি একাই দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলেন, আসন্ন সময় হবে কত কঠিন!

প্রাথমিক পর্যায়ে কোরাইশরা দৃশ্যত ইসলামকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়নি। এ নিয়ে হাসি-তামাশা ঠাট্টা বিদ্রুপেই বিরোধিতা সীমিত ছিল। তারা একে একটা বিচ্ছিন্ন ভিন্নমত মনে করেছিল। এরকম ভিন্ন মতাবলম্বী আগেও ছিল। কিন্তু শোষিত-বঞ্চিতরা কোরআনের বাণীর মধ্যে মুক্তির আলো দেখতে পেল। নতুন ধর্মের প্রতি তাদের আকর্ষণ বাড়তে লাগল। কোরাইশরা তখন প্রমাদ গুনল। তারা সুস্পষ্টত বুঝতে পারল এই নতুন ধর্ম বিস্তার লাভ করলে তাদের ধর্মকেন্দ্রিক ব্যবসা-শোষণ বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের বিশেষ সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা বিলুপ্ত হবে। 

আসলে মক্কা তখন শুধু একটা বাণিজ্য কেন্দ্র নয়। হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক কেন্দ্র। কোরাইশরা ছিল মূল অর্থ লগ্নিকারক। ফটকাবাজারী ও সব ধরণের লেনদেনের নিয়ন্ত্রক। এডেন থেকে গাঁজা, দামেশক থেকে ইরাক পর্যন্ত যে-কোনো বিনিয়োগে নিঃশঙ্ক। তারা শুধু মক্কার অভিজাতদেরই নয়, চারপাশের গোত্রগুলোর অভিজাতদেরও এই বিনিয়োগ, মুনাফা ও ঋণের জালে আবদ্ধ করে ফেলেছিল। আরব ও পার্শ্ববর্তী এলাকা- দামেশক, আলেকজান্দ্রিয়া, গাজা, ইরাক, সানা, এডেনের ব্যবসার নিয়ন্ত্রক ছিল এই বেনিয়া সিন্ডিকেট। আর এই শোষকদের রক্ষাকবচ ছিল কাবার ধর্মীয় মর্যাদা। আসলে কোরআন কোনো বিচ্ছিন্ন মরু জনপদে নাজিল হয় নি। বরং নাজিল হয়েছিল এক রমরমা বিকাশমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কেন্দ্রে, ঘনবসতিপূর্ণ শহরে।

কোরআন যে তাদের শোষণের মূল কাঠামোয় আঘাত হানছে, তা শোষকদের বুঝতে বাকি থাকল না। প্রথম আবু তালিবের মাধ্যমে তারা তাঁকে সত্যের বাণী প্রচার থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল। এরপর তারা চেষ্টা করল তাঁকে কিনে ফেলার। প্রস্তাব দিল, ‘তুমি যদি সম্পদ চাও, তবে আরবের শ্রেষ্ঠ ধনী না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে সম্পদ দিতে থাকব। যদি সম্মান ও ক্ষমতা চাও, তোমাকে আমাদের সর্বোচ্চ প্রধান মনোনীত করব এবং তোমার অনুমতি ছাড়া কোনোকিছুই হবে না। যদি রাজা হতে চাও, তোমাকে রাজ-মুকুট পরাতে বিলম্ব করব না। আর যদি নারী চাও, আরবের সেরা সুন্দরীরা তোমারই হবে।’ তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘আমার এক হাতে সূর্য আর অপর হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি সত্যে অটল থাকব’। আবু তালিব ভ্রাতুষ্পুত্রের বিশ্বাসের অটলতায় মুগ্ধ হলেন। বললেন, ‘তুমি তোমার বিশ্বাসের কথা বলে যেতে পারো। আমি কখনো তোমাকে তোমার শত্রুদের হাতে তুলে দেবো না।’

কোরাইশরা এবার শুরু করল সম্মিলিত নির্মম নির্যাতন। পথেঘাটে হেনস্থা করা হয়ে উঠল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কাবার আশেপাশে পেলে তো কথাই নেই। আবু লাহাব ও তার পত্নী এ-ক্ষেত্রে সবসময়ই ছিল এক ধাপ এগিয়ে। নবীজী ধর্মপ্রচার শুরু করার আগে আবু লাহাব উদ্যোগী হয়ে নবী-তনয়া রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের সাথে তার দুই পুত্র উতবা এবং উতাইবার বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন। নবীজী প্রস্তাব গ্রহণ করেন। বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু ইসলামের বাণী প্রচারের পর আবু লাহাব দুই পুত্রকে বাধ্য করলেন নবী দুহিতাদের তালাক দিতে। স্বামীগৃহে গিয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করার আগেই তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হলো।

আবু লাহাব পুত্র উতাইবা নবী দুহিতাকে তালাক দেয়া ছাড়াও নবীজীকে দৈহিকভাবে লাঞ্ছিত করল। আবু লাহাবের স্ত্রী নিজ ঘরের সকল ময়লা আবর্জনা নবীজীর ঘরের দরজায় নিক্ষেপ করত। কেউ কেউ রাতে পালাক্রমে ঢিল মারত নবীজীর ঘরে। আবু বকর একদিন প্রস্তাব করলেন এখন কাবা প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যেই প্রচারের উদ্যোগ নেয়া যায়। কয়েকবার বলার পর নবীজী রাজি হলেন। পরিকল্পনা অনুসারে কাবা চত্বরে মুসলমানরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ গোত্রের লোকদের সাথে বসলেন। নবীজী বসেছেন। আবু বকর দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবাইকে আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের আহ্বান জানালেন। ব্যস! সত্য অস্বীকারকারীদের জন্যে এটুকুই ছিল যথেষ্ট। তারা উন্মাদের মতো মুসলমানদের প্রহার শুরু করল। নবীজী আহত হয়ে মূর্ছিত হলেন। উতবা ইবনে রাবিয়া দুই শক্ত জুতো দুই হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আবু বকরের ওপর। তার নাক ভেঙ্গে গেল। জুতোর তীক্ষ্ণ আঁচড়ে মুখ কেটে গেল।

রক্তাক্ত ও মৃতপ্রায় অবস্থায় তার গোত্রের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করল। বাড়িতে নিয়ে গেলেও তার জ্ঞান ফিরতে ফিরতে বিকেল পার হয়ে গেল। জ্ঞান ফেরার পর তার প্রথম বাক্য ছিল, ‘আল্লাহর রসুল কেমন আছেন?’ স্বগোত্রীয়রা যারা এতক্ষণ জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল, তারা আবু বকরের জ্ঞান ফিরে আসায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও তার আচরণকে বুদ্ধিহীনতা বলে ভর্ৎসনা করতে শুরু করল। তার মাকে খাবার ও পানির ব্যবস্থা করার কথা বলে আত্মীয়রা চলে গেল। মা খাবার ও পানি নিয়ে এলেও আবু বকর নবীজীর খবর না জানা পর্যন্ত তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেন। মা বললেন, তাঁর কোনো খবর আমি জানি না। আবু বকর তখন মাকে বললেন, তুমি উম্মে জামিলের কাছে যাও। তাহলে খবর পাবে।

মা উম্মে জামিলের কাছে গেলেন। উম্মে জামিল নবীজী বা আবু বকর সম্পর্কে কোনোকিছু জানার কথা অস্বীকার করলেন। তবে বললেন, আপনি চাইলে আমি আপনার ছেলেকে দেখতে যেতে পারি। আবু বকরের মা প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেন। মা উম্মে জামিলকে নিয়ে এলেন ছেলের কাছে। আবু বকর উম্মে জামিলের কাছে নবীজীর কথা জানতে চাইলেন। উম্মে জামিল সেখানে উপস্থিত মায়ের দিকে তাকালেন। আবু বকর আশ্বস্ত করলেন, তার দিক থেকে ভয়ের কিছু নেই। তখন উম্মে জামিল বললেন, নবীজী ভালো আছেন এবং নিরাপদে আরকামের ঘরে অবস্থান করছেন। আবু বকর তখন বললেন, আমি আল্লাহর নামে শপথ করেছি যে, নবীজীকে না দেখা পর্যন্ত আমি পানি বা খাবার গ্রহণ করব না।

রাত গভীর হয়ে লোকজনের সামনে পড়ার সম্ভাবনা কমে গেলে এই দুই নারী আবু বকরকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। আবু বকর দুই পাশে দুই নারীর কাঁধে ভর দিয়ে কোনোরকমে হাঁটতে হাঁটতে আরকামের ঘরে উপস্থিত হলেন। নবীজী দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। উপস্থিত মুসলমানরাও তাকে উষ্ণ সম্বর্ধনা জানাল। নবীজী তার অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, আমি ভালো আছি। শুধু আমার মুখমণ্ডলের আঘাত ছাড়া। তিনি এরপর মাকে দেখিয়ে বললেন, আমার মা তার পুত্রের ভালো যত্নই নিচ্ছেন। আপনি তার জন্যে দোয়া করুন। তাকে মুসলমান হওয়ার আহ্বান জানান। আপনার দোয়ার উছিলায় আল্লাহ যেন তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন। নবীজী দোয়া করলেন এবং ইসলাম সম্পর্কে বললেন। কয়েকদিন পরই মা ইসলাম গ্রহণ করলেন। বিকাশলগ্নের প্রচারকরা কতটা সতর্কতা অবলম্বন করতেন

এ ঘটনা থেকে তিনটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে- এক. ইসলামের বিকাশলগ্নে মুসলমানরা নিজেকে ইসলামের সাথে শনাক্ত করতে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তখন পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত দেয়া হতো খুব গোপনে। তাই উম্মে জামিল আবু বকরের মাকে নবীজী সম্পর্কে কোনো তথ্যই দেন নি। তিনি যে নবীজী বা আবু বকর সম্পর্কে কিছু জানেন, তাও অস্বীকার করেছেন। এমনকি তিনি যখন আবু বকরকে দেখেন, তখনও তার মায়ের উপস্থিতিতে নবীজীর কোনো তথ্য দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। আবু বকর যখন তাকে আশ্বস্ত করলেন যে, তার মায়ের সামনে কথা বললে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই, তখনই উম্মে জামিল নবীজীর তথ্য তাকে জানান।

দুই. হিজরতের দশ বছর আগেও আবু বকরের নবীপ্রেমের গভীরতা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।যে সময় আবু বকরের জন্যে খাদ্য ও পানির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, সে সময়ও তিনি নবীজীর সাথে দেখা হয়ে তাঁর নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত খাবার গ্রহণ করেন নি। 

তিন. ঘটনা আরো বলে দেয়, সত্য অস্বীকারকারীরা যখনই সুযোগ পেয়েছে তারা বিশ্বাসীদের ওপর আঘাত, আক্রমণ, প্রহার এমনকি হত্যা করতেও দ্বিধান্বিত ছিল না। আবু বকর কোরাইশদের তায়িম গোত্রভুক্ত ছিলেন। তার গোত্রের সদস্যরা তার সুরক্ষায় প্রস্তুত ছিল। তারাই প্রহার থেকে তাকে উদ্ধার করে এবং কাবা প্রাঙ্গণে শপথ নেয় যে, আবু বকরের মৃত্যু হলে তারা উতবা ইবনে রাবিয়াকে খুন করে এর বদলা নেবে। অভিজাত আবু বকরের ওপরই যখন এমন নৃশংস হামলা তখন সাধারণ বিশ্বাসীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা যে-কেউ আঁচ করে নিতে পারে। 

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে- মক্কার অভিজাতরা কেন ইসলামের চরম বিরোধিতা করেছিল? এই বিরোধিতার একটি প্রধান কারণ ছিল পরকালীন শাস্তির ভয়। মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের ও বিচারের কথা শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে উঠত তারা। আরব পৌত্তলিক ধর্মবিশ্বাসে পরকালে কর্ম অনুসারে শাস্তি বা পুরস্কারে বিশ্বাসের কোনো স্থান ছিল না। নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই ছিল না। ভোগবিলাস-বিনোদনই ছিল জীবন। বেনিয়া নিয়ন্ত্রিত সমাজে অর্থই ছিল দেবতা। মাল কামাও। আর ভোগ করো। যত খুশি অন্যায় অত্যাচার পাপাচার করো। যেভাবে পারো স্বার্থ উদ্ধার করো। কোনো অমঙ্গলের আশঙ্কা করলে দেবতার সন্তুষ্টির জন্যে বলিদান করো। কাবা চত্বরে তাওয়াফ করো। পুরোহিতকে দক্ষিণা দাও। অমঙ্গল দূর হয়ে যাবে। পাপমোচন হয়ে যাবে। দয়ামায়া সেবা এগুলো করে কোনো লাভ নেই। মরার সাথে সাথে সব শেষ। তাই যা পারো ভোগ করো। একটাই জীবন। পরকাল বলে কিছু নেই। 

কিন্তু কোরআন একের পর এক সূরায় পরকালের, পুনরুত্থানের মহাবিচার দিবসে পরম প্রভুর সামনে হাজির হওয়ার এবং সকল কাজের জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ, সৎকর্মের পুরস্কার, অন্যায়ের কঠোর শাস্তির বিষয় এমন ভাষায়, এমন বাণী ও ধ্বনির ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করল যা ওদের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিল- ‘যখন সূর্য অন্ধকারে ঢেকে যাবে, যখন তারকারাজি নিজেদের আলো হারাবে, যখন পর্বতমালা মরীচিকার ন্যায় উধাও হবে, যখন পূর্ণ গর্ভবতী উটনী পরিত্যক্ত হবে, যখন সকল বন্যপশুকে একত্র করা হবে, যখন সমুদ্রের জলরাশি স্ফীত হবে, যখন দেহে আবার আত্মা সংযুক্ত হবে, যখন জীবন্ত কবর দেয়া শিশুকন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?

যখন প্রত্যেকের আমলনামা দেখানো হবে, যখন আকাশের আবরণ সরানো হবে, যখন জাহান্নামের আগুন গনগনে লাল করা হবে, যখন জান্নাতকে দৃশ্যমান করা হবে, সেদিন প্রত্যেকেই জানতে পারবে, কী পরিণতির জন্যে সে নিজেকে প্রস্তুত করেছে (বুঝতে পারবে কী করা উচিত ছিল, আর কী করা উচিত হয় নি)।’ [সূরা তাকভির: ১-১৪]

সূরা আবাসা: ‘যখন গগনবিদারী ধ্বনির সাথে কেয়ামত হবে, সেদিন প্রত্যেকে নিজের ভাই, মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে চাইবে। সেদিন প্রত্যেকে শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। সেদিন অনেক চেহারা হবে আনন্দোচ্ছল, হাস্যোজ্জ্বল, পরিতৃপ্ত ও উপচে পড়া সুখী। এবং অনেক চেহারা হবে বিষণ্ন মলিন ধূসর ও কালিমাচ্ছন্ন। এরাই সত্য অস্বীকারকারী, পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত।’ (সূরা আবাসা: ৩৩-৪২)

সূরা মা’আরিজ: ‘সেদিন আকাশ হবে গলিত তামার মতো, পাহাড়-পর্বত হবে রঙিন ধুনা পশমের মতো। সেদিন চোখের সামনে থাকলেও বন্ধু বন্ধুর খোঁজ নেবে না। সেদিন অপরাধীরা শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে মুক্তিপণ হিসেবে দিতে চাইবে সন্তানসন্ততি, স্ত্রী, ভাই ও আশ্রয়দানকারী আত্মীয়স্বজনকে। নিজেকে বাঁচানোর জন্যে সে দিতে চাইবে পৃথিবীর সবকিছু। না, কোনোকিছুই তাকে রক্ষা করতে পারবে না
তার জন্যে অপেক্ষমাণ গনগনে আগুন থেকে, যা চামড়া ঝলসে শরীর থেকে খসিয়ে নেবে। জাহান্নাম সেদিন উচ্চস্বরে ডাকবে তাদের, যারা ন্যায় থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, যারা ধনসম্পত্তি সংগ্রহ করে (সৎ কাজে ব্যয় না করে) কৃপণের মতো সংরক্ষিত করে রেখেছি (সূরা মা’আরিজ: ৮-১৮)

সূরা হাক্কা: ‘সেই দিন তোমরা মহাবিচারের সম্মুখীন হবে। তোমাদের কোনোকিছুই গোপন থাকবে না। তখন যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, সে আনন্দিত হবে। বলবে, এই নাও আমার আমলনামা পড়ে দেখ। আমি জানতাম যে, একদিন আমাকে আমার প্রতিটি কাজের হিসাব দিতে হবে! সুতরাং সে থাকবে উপচে পড়া সুখের মধ্যে সুউচ্চ জান্নাতে, সেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ রকমারি ফল ঝুলে থাকবে হাতের নাগালের মধ্যে। 
(আল্লাহর এই রহমতপ্রাপ্তদের বলা হবে) দুনিয়ায় তুমি যে সৎকর্ম করেছিলে, তারই পুরস্কার হিসেবে পানাহার করো পূর্ণ তৃপ্তির সাথে। মহাবিচার দিবসে যার আমলনামা বাম হাতে দেয়া হবে, সে আর্তনাদ করে বলবে, ‘হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা দেয়া না হতো আর আমি যদি আমার রেকর্ড না দেখতাম! হায়! আমার দুনিয়ার মৃত্যুই যদি চূড়ান্ত হতো! আমার ধনসম্পত্তি তো কোনো কাজে এলো না। আর আমার ক্ষমতাও তো হাতছাড়া হয়ে গেছে। তখন ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দেয়া হবে, ওকে ধরো, গলায় বেড়ি লাগাও আর নিক্ষেপ করো জাহান্নামে। কারণ সে আল্লাহকে বিশ্বাস করে নি, অভাবীকে অন্নদানে অন্যকে উৎসাহিত করে নি। অতএব এখানে সে হবে বন্ধুহীন। ক্ষতনিঃসৃত পুঁজ ছাড়া তার জন্যে কোনো খাবার থাকবে না, .......।’ (সূরা হাক্কা: ১৮-৩৭)

সূরা নিসা: ‘যারা আমার বিধান মানতে অস্বীকার করবে তারা আগুনে পুড়বেই। ত্বক একবার পুড়ে গেলে আবার নতুন ত্বক সৃষ্টি করা হবে। আবার তা পুড়বে। এভাবেই তারা পুরোমাত্রার শাস্তি ভোগ করবে।’ (সূরা নিসা: ৫৬) 

সূরা হুমাজাহ: ‘দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে, যে সামনাসামনি দুর্ব্যবহার করে এবং পেছনে নিন্দা করে। (দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে) যে (কৃপণের মতো) অর্থ জমায় আর বার বার তা গণনা করে এবং একে নিজের রক্ষাকবচ মনে করে। সে মনে করে তার অর্থ তাকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখবে। না, কখনো নয়। সে-তো (পরকালে) ‘হুতামা’য় নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জানো ‘হুতামা’ কী? হুতামা হচ্ছে বিশাল প্রজ্বলিত চুল্লি যার আগুন হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দহন করবে। বিশাল স্তম্ভসমূহ পরিবেষ্টিত চুল্লির মুখও ঢেকে দেয়া হবে (দহনযন্ত্রণাকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার জন্যে)।’ (সূরা হুমাজাহ: ১-৯)

আসলে সত্যের একটা আলাদা শক্তি রয়েছে। আর কোরআনের বাণী ও ধ্বনির ব্যঞ্জনা শাশ্বত জ্ঞানের প্রকাশকে করেছে অন্তর্ভেদী। এমনকি কোরাইশ নেতাদের ওপরও এর প্রভাব যে কত গভীর ছিল একটি ঘটনা থেকে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। একরাতে পারস্পরিক কোনো আলাপ ছাড়াই আবু সুফিয়ান, আবু জেহেল ও আল আখনাস ইবনে শরিক পৃথক পৃথকভাবে মুহাম্মদের (স) ঘরে উপস্থিত হলেন তাঁর আলোচনা শোনার জন্যে। প্রত্যেকেই অন্ধকার কোনা দেখে বসে পড়লেন। তারা আলোচনা প্রার্থনা ও গভীর রাতে তার আকর্ষণীয় কণ্ঠে কোরআনের তেলাওয়াত শুনলেন। অন্ধকার থাকতেই তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। হঠাৎই মুখোমুখি হলেন পরস্পরের। কারোই বুঝতে বাকি থাকল না তারা কোথায় গিয়েছিলেন। প্রত্যেকে একে অপরকে দোষারোপ করলেন এমন ক্ষতিকর কৌতূহলের জন্যে। তারা বললেন, সাধারণ কোরাইশরা এই ঘটনা জানলে তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়বে। তারা পরস্পরের কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন, এমন কাজ তারা আর কখনো করবেন না। 

কিন্তু পরের রাতে নির্ধারিত সময়ে প্রত্যেকেরই মনে হলো, কি যেন তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে মুহাম্মদের (স) বাড়িতে। কিছুতেই নিজেকে তারা থামাতে পারছে না। সারারাত একইভাবে কাটাল তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ফেরার পথে আবার পরস্পরের সাথে দেখা। আবার পরস্পরকে দোষারোপ। আবার প্রতিজ্ঞা। কিন্তু লাভ হলো না। তৃতীয় রাতেও ঘটলো একই ঘটনা। আবার রাস্তায় তিনজনের দেখা। এবার অলঙ্ঘনীয় প্রতিজ্ঞা। না! আর কখনো নয়। সমাজপতি হওয়ার পর আমরাই যদি নিজেদের এ বাণী শোনা থেকে ফেরাতে না পারি, তবে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হবে!

এনএস/