ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

কোরআনে সৎকর্মের নির্দেশ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৫২ পিএম, ২ মে ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৫:৫৭ পিএম, ২ মে ২০২০ শনিবার

সৎকর্ম বা আমালে সালেহ হলো ভালো মানুষের অন্যতম গুণ। সৎকর্মের মাধ্যমেই মানুষের ভেতরের সৎগুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আমরা চোখে মানুষের ভেতরটা দেখতে পাই না। মানুষের দোষ-গুণ বা ভালো-মন্দের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই তার কাজকর্ম ও আচার-ব্যবহারের মধ্যে। এক কথায় বলা যায়, সৃষ্টির কল্যাণে কাজ করাই সৎকর্ম। সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা দুনিয়ায় যেমন সম্মানিত হন, তেমনি আল্লাহর কাছেও তাঁরা প্রিয়। 

বিশ্বাসী হওয়ার পর ‘মানবসেবা’ একটি অন্যতম ইবাদত ও সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। ‘মানুষের জন্য মানুষ’-এ স্লোগানে নিজের জীবনকে তৈরি করে অপরের কল্যাণে দৌড়ে যাওয়া, আত্মনিয়োগ করা, তাদের ইমান-আমানের ফিকির করা, অপরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, নিজের স্বার্থের ওপর অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া মানবতার মূল দাবি। রসুল (সা.) সারাটি জীবন মানুষের উপকারে ব্যয় করেছেন। মানবতাকে দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছেন। এছাড়াও দেশের প্রাকৃতিক দূর্যোগ, মহামারিতে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া বড় সৎকর্ম। আর্থিক সাহায্য করতে না পারলে দোয়া করে অসহায়দের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করাও সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। 

সৎকর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ১৭৭নং আয়াতে বলেন, ‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে! বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর, কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর; আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই আল্লাহভীরু।’

সৎকর্মশীলদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে সূরা আলে ইমরানের ১১৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহ ও আখেরাতকে বিশ্বাস করে, সৎকর্মে অন্যদের অনুপ্রাণিত করে, অন্যায় করতে নিষেধ করে এবং তারা সাধ্যমতো সৎকর্ম করে। এরাই সৎকর্মশীল।’

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা আল-বাকারার ১৪৮ নং আয়াতে বলেছেন, ‘প্রত্যেকেরই একটি লক্ষ্য আছে; যা তার কর্মধারাকে পরিচালনা করে। অতএব তোমরা সৎকর্মে (নিজের সাথে) প্রতিযোগিতা করো। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সকলকে সমবেত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। ’

কোরআনে একই সূরার ১৯৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আর আল্লাহর পথে মুক্তহস্তে ব্যয় করো। (মুক্তহস্তে ব্যয় না করে) নিজের হাতে নিজের সর্বনাশ করো না। সৎকর্মে ক্রমাগত লেগে থাকো। কারণ আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন।’

সূরা আল-ইমরানের ১৪৮ নং আয়াতে বলেছেন, ‘তারপর আল্লাহ তাদের পৃথিবীতে পুরস্কৃত করেছেন এবং আখেরাতে পুরস্কৃত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন।’

আল্লাহ তায়ালা সূরা আন-নিসার ১১৪ নং আয়াতে বলেন, ‘অধিকাংশ গোপন সলাপরামর্শই মানুষের কোনো কল্যাণে আসে না। তবে কেউ যদি গোপনে দান-খয়রাত, সৎকর্ম বা মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দূর করে শান্তি স্থাপনের পরামর্শ দেয়, তবে তা নিশ্চয়ই ভালো কাজ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে কেউ যদি তা করে, তাহলে আমি তাকে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবো।’

মহান আল্লাহ সূরা মায়েদার ২নং আয়াতের শেষাংশে বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! সৎকর্মে ও আল্লাহ-সচেতনতা সৃষ্টিতে তোমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। অন্যায় ও শত্রুতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করা থেকে সবসময় বিরত থাকবে। আল্লাহ-সচেতন হও। কারণ আল্লাহ শাস্তিদানেও কঠোর।’

সূরা মায়েদার ৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন, ‘হে নবী! আমি তোমার ওপর সত্য বিধানসহ কিতাব নাজিল করেছি, যা পূর্বে নাজিল হওয়া কিতাবের সত্যতা প্রমাণকারী ও সংরক্ষক। অতএব আল্লাহর বিধান অনুসারে তুমি পূর্ববর্তী কিতাবিদের বিচার-মীমাংসা করো। যে সত্যবিধান তোমার কাছে এসেছে তা বাদ দিয়ে তাদের খেয়ালখুশি অনুসারে কাজ কোরো না। আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্যে (আলাদা) বিধান ও স্পষ্ট পথনির্দেশ প্রদান করেছি। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদের এক উম্মাহ বা জাতিতে পরিণত করতে পারতেন। (কিন্তু তিনি তা করেন নি।) কারণ তিনি তোমাদের যে পথনির্দেশ ও বিধান দিয়েছেন, তার আলোকেই তোমাদের পরীক্ষা করতে চান। অতএব তোমরা সৎকর্মে (নিজের সাথে) প্রাণপণ প্রতিযোগিতা করো। শেষ পর্যন্ত তোমরা আল্লাহর দিকেই ফিরে যাবে। তখন তোমাদের মতভেদের বিষয়সমূহের ব্যাপারে আল্লাহ আসল সত্য প্রকাশ করবেন। [এখানে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে নিজ নিজ ধর্মাচারের পার্থক্য নিয়ে কোন্দল করার পরিবর্তে আল্লাহ সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ প্রদান করেছেন।]’

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সূরা বনী ইসরাইলের ১৬নং আয়াতে বলেন, ‘কোনো জনপদ ধ্বংস করার আগে আমি সেখানকার বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোকদের সৎকর্ম করার নির্দেশ দেই। কিন্তু ওরা আমার আদেশের অবাধ্য হয়ে অন্যায় ও জুলুমে লিপ্ত হয়। তখন ন্যায়সঙ্গতভাবেই আজাবের ফয়সালা হয়ে যায় এবং তারা ধ্বংস হয়।’

পবিত্র কোরআনের সূরা মরিয়মের ৭৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যারা সাফল্যের সরলপথে চলে, আল্লাহ তাদের সৎপথের উপলব্ধি ও চলার ক্ষমতাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে দেন (বাড়িয়ে দেন সৎকর্ম করার আকুতি)। সৎকর্ম তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে স্থায়ী পুরস্কার প্রাপ্তির জন্যে উত্তম, সুফল দানকারী হিসেবেও (শুধু পার্থিব লাভের চেয়ে তা) অনেক ভালো।’

সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ-এর ৪৬নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আসলে যে সৎকর্ম করে, সে নিজের ভালোর জন্যেই তা করে। আর যে অপকর্ম করে, তার প্রতিফলও সে-ই ভোগ করবে। তোমার প্রতিপালক তাঁর বান্দাদের ওপর কখনো জুলুম করেন না।’

মহান রব্বুল আলামীন সূরা জাসিয়ার ১৫নং আয়াতে বলেন, ‘আসলে যে সৎকর্ম করে, সে নিজের কল্যাণের জন্যে তা করে। আর কেউ অপকর্ম করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করবে। শেষ পর্যন্ত তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছেই ফিরে যাবে।’

সূরা বাইয়েনাহ-এর ৭নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,  ‘আর নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্মশীল, তারাই সৃষ্টির সেরা।’

এছাড়াও পবিত্র কোরআনে সূরা হজের ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের দাখিল করবেন জান্নাতে, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত।’ 

সূরা সাদের ২৮ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায়, আমি কি তাদের সমান গণ্য করব? আমি কি মুত্তাকিদের অপরাধীদের সমান গণ্য করব?’ 
সূরা জিলজালের ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তা-ও সে দেখবে।’ 

সুরা 'আসরের ১-৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে...।’ 

সূরা মুমিনুন-এর ৫৭-৬১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আসলে যারা তাদের প্রতিপালকের (বিরাগভাজন হওয়াকে) ভয় করে, যারা তাঁর বাণীকে বিশ্বাস করে, যারা তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করে না, যারা তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে- এই বিশ্বাস নিয়ে কম্পিত হৃদয়ে অন্তর থেকে দান করে, তারাই সৎকর্মে (নিজের সঙ্গে) আসল প্রতিযোগী, তারাই সৎকর্মে অগ্রগামী।’

সূরা লোকমানের ২-৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘প্রজ্ঞাময় কিতাবের এ ঐশীবিধান সৎকর্মশীলদের জন্যে (করুণাময়ের) রহমত ও পথনির্দেশনা। সৎকর্মশীলরা নামাজ কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। তারা অন্তরের গভীর থেকে পরকালে জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে। তারা তাদের প্রতিপালকের হেদায়েতের পথে আছে আর সেজন্যে তারাই অনন্ত কল্যাণ লাভে ধন্য হবে।’

সূরা মূলকের ২নং আয়াতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সৎকর্মে কে অগ্রগামী তা পরীক্ষার জন্যেই তিনি জীবন সৃষ্টি ও মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছেন। (সেইসাথে তোমরা যাতে অনুধাবন করতে পারো) তিনিই মহাপরাক্রমশালী ও সত্যিকারের ক্ষমাশীল।’

সুতরাং সৎকর্ম শুধু অর্থ দান করাকেই বুঝায় না। বরং এমন ১৭টি কাজ আছে যেগুলো ইসলামে সাদাকাহ বা সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। সেগুলো হলো- অন্যের জন্য দোয়া করা, জ্ঞান বিতরণ, সদুপদেশ দেয়া, সুন্দর হাসি (হাসিও দানের কাজ করে), অসহায়কে সাহায্য করা, সময়ের সৎ ব্যবহার, সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলা, কঠিন ও বিপদ- সব মুহূর্তেই ধৈর্য্যধারণ করা, ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা, মিষ্টভাষী হওয়া, ক্ষমা করা, শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের উপর খুশি থাকা, রোগী বা অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, পথে থাকা ময়ালা-আবর্জনা বা কাটা-ঢিলা দূর করা, স্ত্রীর প্রতি উদার হওয়া। 

এনএস/