ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

অন্য এক কিশোর কুমারের গল্প

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:৩২ পিএম, ৬ মে ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৩:৩৮ পিএম, ৬ মে ২০২০ বুধবার

বিনা বেতনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা এবং এক টাকায় খাবার, চিকিৎসা, আইনি সহায়তা! শুনলেই আবাক লাগার কথা। এ যুগে এসব কল্পনাতীত ব্যাপার। এক টাকায় মিলছে দুপুরের খাবার! অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন ৪০০ বছর আগের শায়েস্তা খাঁ’র আমলের গল্প বলছি বুঝি! নাহ, হাল আমলের ঘটনা এটি। শুনতে অবাক লাগলেও এমন একটি মানবিক কাজ সম্ভব করেছেন কিশোর কুমার দাশ। 

অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজধানীর পল্লবীতে গড়ে তোলেন সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’।

টাকার অভাবে এসএসসি’র পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় কিশোর কুমার দাশের। টানা ২ বছর নিয়মিত টিউশনির টাকা জমিয়ে আবার নিয়মিত পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। এরপর চুয়েট থেকে সিএসই বিষয়ে পড়াশোনা করে তৎকালীন ওয়ারিদ (বর্তমানে এয়ারটেল) টেলিকমে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি বিদেশ পাড়ি দেন। বিগত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর লিমা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তিনি। একটি বহুজাতিক কোম্পানির কমার্শিয়াল ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন সেখানে। মাঝে মাঝে সময় নিয়ে দেশে আসেন এবং নিজস্ব অর্থায়নই চালাচ্ছেন  ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’।

অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে উঠেছেন তিনি। নিজেই ছিলেন মন্দিরের সামনে ক্ষুধার লাইনে। তখন চিন্তা ছিল, একদিন ফিরিয়ে দিবেন এই খাবার। সেই চিন্তা থেকে মূলত: এই কর্মসূচি চালু। এছাড়া তার বিয়ের পর সংসার টেকেনি। আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। এমনকি জীবন নাশের পরিকল্পনাও মাথায় ছিল তার। তখন মাথায় এলো এমন কিছু করা উচিত যাতে সেই আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। আরেকটা কারণ ছিল খুবই দরিদ্র শিশুদের স্কুলে টানার জন্য, ধরে রাখার জন্য ১টাকায় খাবার বিতরণ।

অসহায় মানুষের বন্ধু এই ত্যাগী মানুষটি মঙ্গলবার সকালে বিদ্যানন্দের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে একটি ঘোষণা দেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিয়েছেন। বিদ্যানন্দের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদ্যানন্দের কাজ বিদ্যা বা শিক্ষা দিয়ে শুরু হলেও বিভিন্ন সময় সংগঠনটির সঙ্গে ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতা খুঁজেছেন এক শ্রেণির ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। আর এ কারণেই প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদ থেকে কিশোর কুমার দাশ সরে গেলেন।

তবে পরবর্তিতে স্বেচ্ছাসেবকদের সংস্থা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাস তার পদত্যাগের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। সেই সঙ্গে বিদ্যানন্দের পক্ষে লিখতে গিয়ে অনুমানভিত্তিক অন্যকে দোষারোপ না করতে সবার প্রতি অনুরোধও করেছেন তিনি। 

বিদ্যানন্দ না ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে মঙ্গলবার রাতে সংস্থার ফেসবুক পেইজে তিনি আবারও স্ট্যাটাস দেন। সেই স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, আমার সিদ্ধান্তগুলোতে পাগলামি এবং আবেগের প্রভাব যুক্তির চেয়ে বেশি থাকে। ক্ষমা চাচ্ছি এই সীমাবদ্ধতার জন্য। আজকে আমার এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আমি বিদ্যানন্দ ছাড়ছি না, পরিচালনা পর্ষদেই থাকছি। শুধু দায়িত্ব পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। পরিচালনা পর্ষদে এখনো সে আবেদন গ্রহণ করেনি। যদি আমার আগের বক্তব্যে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে, আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চাই। 

একুশের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কাজের পরিধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে কিশোর কুমার দাশ বলেন, ‘এটি একটি শিক্ষা সহায়ক প্রতিষ্ঠান। পড়ব, খেলবো, শিখবো এই স্লোগানে বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানো হয় এখানে। প্রতিদিন শিশুরা নিয়মিত এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিয়ে থাকে। এখানে বেতনভুক্ত শিক্ষক নিয়োজিত রয়েছেন। রাজবাড়িতে একটি এতিমখানা, রামুতে আদিবাসীদের এতিমখানা ও একটি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। এটি মূলত: একটি সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১ টাকায় চিকিৎসা ও আইনি সহায়তাও দিয়ে যাচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, ‘সুবিধাবঞ্চিত পথ শিশুদের মাঝে এক টাকায় খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি নিয়েছে বিদ্যানন্দ। রাজধানী ঢাকাসহ ৬টি জেলায় সুবিধাবঞ্চিত ১২ বছরের নিচে শিশু ও ৬০ বছর কিংবা তদোর্ধ্ব বৃদ্ধ, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের মাঝে ৩৬৫ দিন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় যেমন - মিরপুর, গাবতলী, কমলাপুর, টঙ্গিতে দুপুরের খাবার বিতরণ করা হয়। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকগণ ঢাকায় প্রতিদিন পথশিশুদের মাঝে খাবার বিরতণ করে। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী, রামুতে এক টাকায় খাবার প্যাকেট বিতরণ করা হয়।

কিশোর কুমার দাশ বলেন, ‘আমরা ২০১৬ সালের মে মাস থেকে আহার দেওয়া শুরু করি। প্রথম প্রথম দাতা ও গ্রহীতাদের বিশ্বাস ও যোগ্যতার অভাব ছিল। অনেকে এটাকে মিশনারিজ প্রতিষ্ঠান মনে করে বাধা প্রদান করেছে। অনেকে বলেছেন - এই কর্মসূচি ধর্মান্তরিত করতে কাজ করছে। এছাড়া হাসি ঠাট্টা করে বিদ্রুপ করত অনেকে। স্থানীয় রাজনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। পরে অবশ্য সেটা কাটিয়ে উঠতে সম্ভব হয়েছি।’

আহারের টাকার উৎস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ার ফলোয়ারদের টাকায় মূলত এই কর্মসূচি চলে। এছাড়া আমাদের স্বেচ্ছাসেবরা সেচ্ছায় অর্থ প্রদান করেন সামর্থ্য অনুযায়ী। কিছু প্রতিষ্ঠান আমাদের মাঝে মাঝে সহযোগিতা করে থাকেন। যেমন - এলিট ফরস, প্রাণ, কাজী ফার্ম, ইউনিলিভার ইত্যাদি।’

কিশোর কুমার দাশ বলেন, ‘চ্যারিটি করে দেশ পরিবর্তন করা যায় না। তবুও আমি পারিপার্শ্বিক মানুষের প্রতি আমার দায়িত্বটুকু পালন করছি মাত্র। আমি একা নই, এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শত শত তরুণ অবদান রাখছে। অনেকে হয়ত ভালো অবস্থানের কারণে নিজে এই ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে নাই। হয়ত তারা অপেক্ষায় ছিল একটি ফ্লাটফর্মের জন্য। এছাড়া এই কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত আছেন সমাজের নানা পেশার মানুষ যেমন- ডাক্তার, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক। ফলে আমি এককভাবে কৃতিত্ব দাবি করব না। সবাই চেয়েছে বলে এটি সম্ভব হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু আমি নিজেই দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে আসছি, ক্ষুধার কষ্ট কেমন আমি জানি? আবেগ এখন আর কাজ করে না। ওরা খেতে পারছে, এটাই বড় কথা। এবং যত দিন পারব দিয়ে যাব।’

তিনি জানান, পেরু’র রাজধানী লিমাতেও এক টাকায় আহার প্রজেক্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেখানে প্রতি সপ্তাহে বস্তির সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। পেরুতে তার একটি হোটেল ব্যবসা আছে। সেখান থেকে অর্জিত মুনাফা দিয়ে এটি পরিচালনা করা হয়। রান্নার আয়োজন হয় হোটেলের রান্নাঘরে। রান্নায় অংশ নেন হোটেলের অতিথি হিসেবে আসা বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা।

কিশোর কুমার স্বপ্ন দেখেন, তার এই প্রোজেক্ট একদিন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। অভুক্ত থাকবে না পৃথিবীর কোনো শিশুই। কারণ, ছোটবেলায় খাবারের আশায় মন্দিরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন তিনি। বোঝেন ক্ষুর্ধাত মানুষের বেদনা। তাই পাশে দাঁড়াতে চান সুবিধাবঞ্চিত মানুষের।

শুধু তাই নয়, করোনার এই সঙ্কটকালে মানুষ যখন ঘরের মধ্যে বন্দি। অসহায় জীবন কাটাচ্ছে শ্রমজীবী পরিবারগুলো। অথচ সমাজের বিত্তবানদের অনেকেই ঘরের মধ্যে খাদ্য মজুদ করে অবকাশে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু এমন দিনে কিছু মানুষ সমাজের কাছে নিজের দায়বদ্ধতাকে উপলব্ধি করে মানবতার হাত প্রসারিত করছেন নিরবে। শুরুর দিকে দেশে যখন করোনা হানা দিয়েছে তখন অনেকেই এটি নিয়ে হাসি তামাশায় লিপ্ত থেকেছেন। অথচ কেউ কেউ এসময় এসেছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। কিশোর কুমার দাশ তাদেরই একজন। যিনি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। করোনা প্রতিরোধে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন তারা। 

করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ লাখ লাখ শ্রমজীবী পরিবারের সদস্যদের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, চিকিৎসা সমগ্রী, চিকিৎসদের পিপিই প্রদানও করছেন তারা। যতটুকু পারছেন তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এ কাজে সহযোগীতা করতে অনেকেই নিরবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, দিচ্ছেন।

কে এই কিশোর কুমার দাস?
কিশোর কুমার দাস। চাকরির সুবাদে ঘুরছেন দেশ-বিদেশ। বর্তমানে আছেন সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। কর্মজীবনে সফল এই পেশাদার কর্মকর্তার জীবনের পেছনের গল্পটা এমন নয়। শৈশব কেটেছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ২৪ বছর আগের চট্টগ্রাম নগরীর কালুরঘাটের এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠান শেষে খাবার বিতরণ হচ্ছিল। তখন ১৪ বছরের কিশোর অন্যদের মতো লাইনে দাঁড়িয়েছিল এক প্লেট খাবারের আশায়। কিন্তু সেখানে অসংখ্য মানুষের ভিড় ঠেলে ফিরে আসতে হয়েছিল খালি হাতে। তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, একদিন এমন কিছু করবেন যাতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা খাবারের জন্য কোনো কষ্ট না পায়। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কলাপাতার ওপর সামান্য খাবার পেয়েছিলেন একবার। তা নিয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছুটেছিলেন বাড়িতে। মা’কে নিয়ে একসঙ্গে খাবেন তাই। পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে সব খাবার নষ্ট হয়ে যায়। আজ তার ক্ষুধার কষ্ট নেই। কিন্তু, ভোলেননি সেই অতীত। অতীতকে স্মরণ করেই তিনি দাঁড়িয়েছেন দেশের শ’ শ’ ক্ষুধার্ত সুবিধাবঞ্চিতের পাশে। তারই প্রতিষ্ঠিত বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এখন প্রতিদিন দুই বেলা ‘এক টাকায় আহার’ বিতরণ করে দেশের হাজার পথশিশুর মধ্যে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের রামুতে প্রতিদিন দুপুরে ও রাতে শিশুরা সংগ্রহ করে এক টাকায় আহার।

এসএ/