ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

রিজার্ভেই ভরসা রাখছেন অর্থনীতিবিদরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৫৮ পিএম, ৬ মে ২০২০ বুধবার

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও ঋণের অনুপাত এবং ঋণ পরিশোধ পরিসেবায় যে সক্ষমতা রয়েছে তাতে কোভিড-১৯ প্রার্দুভাবের কারণে অর্থনীতিতে সৃষ্ট অভিঘাত বাংলাদেশ মোকাবেলা করতে সক্ষম বলে মনে করেন দেশের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদগন। তবে তারা এও বলছেন, এত বড় মহামারির অভিঘাত মোকাবেলায় উন্নয়ন সহযোগিদের নিকট থেকে আরো বেশি সহায়তার প্রয়োজন হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান মনে করেন, কোন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের শক্তিশালী অবস্থান অতিরিক্ত তারল্য তৈরিতে সহায়তা করে। বাংলাদেশ এখন সেই অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ঋণ এবং জিডিপি অনুপাত এখনও ৩০ এর কোটায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২০০। এর মানে আমাদের কাছে কিছু হেড রুম রয়ে গেছে। আমরা আরো বেশি বৈদেশিক ঋণ নিতে পারি, সরকারও আরো পাবলকি ঋণ করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যদি বেশি থাকে, তাহলে তখন তারল্য সৃষ্টি করা যায়। আমরা এখন সেই অবস্থায় আছি।’

গত এক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক যে শক্তিমত্তা অজর্ন করেছে তা দিয়ে কোভিড-১৯ এর অভিঘাত মোকাবেলা করা সম্ভব, কেন্দ্রিয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের এই বক্তব্যের সাথে অনেকাংশে একমত পোষন করেন পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাজিুর রহমান।

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশকে উদীয়মান দেশের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে সম্প্রতি বিখ্যাত অর্থনীতি বিষয়ক সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দেশের এই তিন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এসব কথা বলেন।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে পত্রিকাটি কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ৬৬টি সবল অর্থনীতির দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ৯ম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলো যথার্থ এবং এসব উদ্যোগ এই মহামারি মোকাবেলায় অন্য অনেক দেশের তুলনায় আমাদেরকে এগিয়ে রেখেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি নগদ অর্থ প্রদানের উদ্যোগ অত্যন্ত যৌক্তিক বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক এই সভাপতি বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ভাল শক্তিমত্তা অর্জন করেছে সেটি সঠিক কিন্তু এখন দেখতে হবে কোভিডের প্রাদুর্ভাব কতদিন স্থায়ী হয়। এটি দীর্ঘ মেয়াদি হলে তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সচল রাখার জন্য বৈশি^ক উন্নয়ন সহযোগিদের নিকট থেকে সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষাখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ।

সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কিছু ব্যাপারে বাংলাদেশের শক্তিমত্তা কোভিড ১৯ মোকাবেলায় সহায়তা করবে। যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, জিডিপি-ঋণের অনুপাত ৩০ এর কোটার মধ্যে আছে। এর পাশাপাশি রফতানি ও রেমিটেন্স এত দিন ভাল ছিল। এসব আমাদের কোভিড মোকাবেলায় সহায়তা করবে।’

তবে এর পাশাপাশি কোভিড মোকাবেলায় অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে-যেমন প্রনোদনা প্যাকেজ এবং স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো একটা চ্যালেঞ্চ। তিনি মনে করেন, অতিরিক্ত অর্থের জন্য স্থানীয় সম্পদ আহরণের সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং স্থানীয় সম্পদ আহরণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করতে হবে।

কেন্দ্রিয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন,‘ইকোনমিস্ট পত্রিকা বাংলাদেশকে নিয়ে যে এ্যাসেসমেন্ট করেছে, তাতে আমি অবাক হয়নি। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আমরা এমন কিছু অর্থনেতিক নীতি ও কৌশল নিয়েছি-যেটা দুই দিকে ইম্প্যাক্ট করেছে, একটা হলো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এবং অপরটি হলো ম্যাক্রো অর্থনীতিতে অর্থাৎ আমরা অনেক মানুষের কাছে পেীঁছাতে পেরেছি। সে কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আছে এবং থাকবে। ’

তিনি বলেন, ইকোনমিস্ট উল্লেখ করেছে- করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের ডেট ম্যানেজমেন্ট, ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট, ডেট পেমেন্ট এগুলো শক্ত অবস্থায় থাকবে। এটা বলার ভিত্তি হলো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কারন ২০০৯ সালে যেটা ছিল সাড়ে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেটা ৩৩ বিলিয়নে পৌঁছে গেছে, এখান থেকে আমাদের অর্থনীতি শক্তি সঞ্চয় করেছে।

কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় আতিউর রহমান অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এর জন্য সরকারি ট্রেজারি বন্ড বিক্রির পাশাপাশি অন্যান্য যেসব বন্ড আছে যেমন ওয়েজ আর্নার্স বন্ড, ইনভেস্টমেন্ট প্রিমিয়াম বন্ড সেগুলো বিক্রি করতে হবে। প্রয়োজন হলে সরকার আরো বন্ড তৈরি করতে পারে বলে তিনি মত দেন। তিনি বলেন,যে সব সার্মথ্যবান অনাবাসী বাংলাদেশী রয়েছে, তারা এগুলোতে বিনিয়োগ করবে।

করোনা পরিস্থিতিতে ফিসক্যাল ও মানিটারি পলিসিতে অনেক কিছু করার আছে বলে আতিউর রহমান মনে করেন। তিনি বলেন, আমরা ফিসক্যাল পলিসিতে বরাবর ৫ শতাংশের মত ঘাটতি বাজেট রাখি। ৫ শতাংশের মধ্যে রাখি কারণ বেশি রাখলে মূল্যস্ফীতি হতে পারে। তবে আজকের পরিস্থিতিতে সারাবিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও তাই, তেলের দাম কমে গেছে গৃহবন্দী অবস্থার কারণে পণ্য পরিবহন না হওয়ায় পণ্যের মুল্য কমে যাচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভয় পাওয়ার সময় হয়নি বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, সেই কারণে ফিসক্যাল ঘাটতি ৫ শতাংশের জায়গায় আরো ৩ থেকে ৪ শতাংশ বাড়ালে ভয়ের কিছু নেই। অর্থাৎ সরকার আরো বেশি ঋণ নিতে পারে, তবে তিনি মনে করেন সেই অর্থটা বানিজ্যিক ব্যাংক থেকে না নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিতে পারে সরকার। এর জন্য প্রয়োজন হলে কেন্দ্রিয় ব্যাংক তার ব্যালেন্স শিট সম্প্রসারণ করতে পারে।

কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন বৃহৎ ও এসএমই শিল্প এবং কৃষিখাতের জন্য প্রনোদনা প্যাকেজ ঘেষাণা করেছে। এর প্রেক্ষিতে কেন্দ্রিয় ব্যাংক বেশ কিছু পুনঃঅর্থায়ন স্কীম চালু করেছে। এ প্রসঙ্গে আতিউর রহমান বলেন, পুনঃঅর্থায়নের যে স্কীমগুলো চালু হয়েছে,তা আরো সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। একই সাথে তিনি এই কাজে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। এছাড়া কর্মহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে ব্যাংক ও অন্যান্য করপোরেট প্রতিষ্ঠান যেন সিএসআর নিয়ে দাঁড়ায় সেই ব্যবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে নিতে হবে বলে তিনি মন করেন।

তিনি বলেন, ঈদের আগে কর্মহীনদের নগদ টাকা দেয়ার চিন্তা করছে সরকার। মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে এই টাকা প্রদানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন,যাদের মোবাইল একাউন্ট নেই, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের একাউন্ট খোলার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারেন।

আতিউর রহমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে জনস্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন।

সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাজিুর রহমান বলেন, আমাদের বৈদেশিক ঋণ পরিসেবা ভাল কিন্তু আমরা এখন মধ্য আয়ের দেশ সুতরাং সহজশর্তে ঋণ পাব না। এখন ঋণ পেতে হবে ২ থেকে ৪ শতাংশ হারে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে যেন সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায়, সেজন্য উন্নয়ন সহযোগিদের সাথে আলোচনা করার পরামর্শ দেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি উল্লেখ করেন বিশ্বের ধনী দেশগুলোর জোট জি-২০ সম্প্রতি বলেছে, তারা কোভিড মোকাবেলায় আমাদের মত দেশগুলোকে সহায়তা করবে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ঋণ মওকুফ করবে। সেই সুযোগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।

এসি