ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

বিপদ আমাদেরই

শামীম আজাদ

প্রকাশিত : ০৪:২৫ পিএম, ১০ মে ২০২০ রবিবার

বর্তমান অবস্থা এমন হয়েছে যে কোভিড ১৯ মহামারীতে মৃত্যু ও মৃতের সংখ্যা শ’য়ের ঘরে থাকলে অবাক হয়ে বলি, ওমা এত কম মানুষ মরলো? কিভাবে? কোন দেশে? সে কোন দেশ যে তার দেশকে এত সুন্দর সুরক্ষা করতে পারছে? দেশটা কি ছোট না বড়? নাকি দেশটার নেতা অনেক অনেক বিত্তবান, শক্তিমান দেশের নেতার চেয়েও বিচক্ষণ ও দূরদর্শী?

যেখানে একটি অযাচিত মৃত্যুও আমাদের সহস্র প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিতো আজ তা শ’য়ের কোঠায় এসে ঠেকেছে। এটাই এখন বাস্তব। কি অদ্ভূত! এখন দেখি হাজার নিয়ে কথা। দেশ থেকে দেশে চলছে হাজার মানুষের মৃত্যু সংখা নিয়ে কথাবার্তা। গত দু'মাসে ইংল্যান্ড করোনা মৃতের সংখ্যা ৩১ হাজারের উপর ছাড়িয়ে গেছে। আর সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং হচ্ছে লন্ডনে।

আমরা থাকি সে লন্ডনেরই সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা আক্রান্ত ও মৃতের স্থান নিউহাম বারার ঠিক সীমানার উপরে। নিউহ্যামেই এদেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বহুজাতিক অভিবাসীদের আবাস। তারপরেই স্থান টাওয়ার হ্যামলেটস বারার। সংখ্যা ও স্বভাবে এ দুই বারার মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে টাওয়ার হ্যামলেটস এ বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। একদিকে নিউহামে লী নদীর পাড়ে আমার কাজের জায়গা হাউস মিল মিউজিয়ামটি আর অন্যদিকে টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় আমাদের কন্ডো ও কাজ। সব চেয়ে বড় কথা এখানেই আমাদের বাংলাটাউন ও ব্রিকলেন।

বিলেতের করোনা সংক্রমিত ও মৃতদের মধ্যে দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভুত মানুষের সংখ্যাই সব চেয়ে উপরে। এর সম্ভাব্য কারণ জানতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ডানকান বার্টলেট আমার এক সাক্ষাতকার গ্রহন করেন। উত্তর করতে হয়েছিলো ইমেলে। শ্বেতাঙ্গ বা কম মিশ্র এলাকার চেয়ে আমাদের মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার যে সম্ভাব্য কারনগুলো আমার মনে ও সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে তা পাঠানোর আগে পড়ে নিজেরই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। এর সবই সাংঘাতিক ঘনবসতিপূর্ণ ঠিক বাংলাদেশের মত। এবং তা অন্যান্য আফ্রিকান ও এশীয় দেশেরও একই অবস্থা। এসব দেশের মানুষের থাকা খাওয়া স্বভাব সবই এক রকম। কিন্তু কোভিডের সঙ্গে লড়াইর জন্য বাংলাদেশে নাইটেঙ্গেলের মত শুধু অত্যধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত এন এইচের মত সেবাদানকারী সুসংগঠিত কোন প্রতিষ্ঠান নেই। নেই পর্যাপ্ত পিপিই কিট। আছে বিশাল সংখ্যক বেবুজ, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। আর আছে এই দূরবস্থায়ও সুবিধা খোঁজা, স্বার্থপর আরো কিছু মানুষ।

যদি আমেরিকার মৃত্যুহারের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো সেখানে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৭৫ হাজার মানুষের। নিউইয়র্কেই হয়েছে ২৪ হাজারের ঊর্ধ্বে।  নিউইয়র্কে বাংলাদেশি অভিবাসীরা ঠিক লন্ডনের মতই থাকেন খান। আনন্দে বেদনায় তারা আমাদের মতই একই তারে বাঁধা। তাই সেখানেও মৃত্যু হার ভয়াবহ।

কেন যে আমরা বিদেশে এসেও প্রচুর সুযোগ সুবিধা পেয়েও বদলাই না জানি না। এ কি আমাদের ভাষা হারাবার ভয়? নাকি সংস্কৃতি হারাবার ভয়? নাকি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে হারাবার ভয়? একটা ভয়তো আছে নিশ্চয়ই।  দরিদ্র দুর্বলের থাকে ভয়। ধনী সবলের থাকে আশংকা। আমরা সে ভয় থেকেই আমরা ধনার্জন করতে এসেও দেশ থেকে লাগেজে করে আনা তামাদি ধারনা সযত্নে বয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের আছেই অল্প- তাই মুঠোতে এমন ভাবে আকড়ে ধরে থাকি যেন পৃথিবীর সবাই ওঁৎ পেতে আছে  তা কেড়ে নেবার জন্য। কিন্তু কথা হল অভিবাসী হিসেবে অনেক অবদান রেখে আমরা এখনো এতো  গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠিনি যে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার সময় মানুষের আছে। বরং মুঠো খুলে দিয়ে খোলাখুলিভাবে নিজেদের আশংকাগুলো নিয়ে পরের প্রজন্মের সঙ্গে আলোচনা করলে বিড়ম্বনা এড়ানো সম্ভব। তার জন্য নানান অজুহাতের দরকার নেই। এ গেল একটি দিক। আরেকটি দিক হল আমাদের  খাদ্যাভ্যাস। খাবারে তেল ঘি মশলা, পান, কড়া ভাজাভুজি ও মাংসের আধিক্য ও নিয়মিত শরীর চর্চা না করার ফলে  এশীয়দের মধ্যে অনেক বেশি উচ্চরক্ত চাপ, হৃদরোগ, ডায়বেটিস ও কিডনীর অসুখ। আর কোভিদের পছন্দ তাদেরই যাদের বয়স ষাটের অধিক ও উল্লিখিত রোগের কোন একটি বা একাধিক রয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা সহজেই কোভিডের শিকার হচ্ছেন। 

বাংলাদেশি যৌথ পরিবারের সকল সদস্যের সমান সংগতি না থাকা  এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য এ দেশে আমাদের অধিকাংশই এক বাড়ীতেই তিন প্রজন্ম থাকেন। এক পরিবারে অনেক পূর্ণ বয়ষ্ক বাস করেন বলে অনেক সময় কাউন্সিলও  দুই ফ্ল্যাটের মধ্যের দেয়াল ভেঙে এক করে দিয়ে একটা বড় বাড়ি করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সে বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার বা লন্ডনেই হোক। বা লন্ডনেরই কেমডেন, নিউহাম বা টাওয়ার হ্যামলেটসেই- সে একই কাহিনী, সমিল কারণ। একই বাড়িতে  দলবেঁধে থাকা, খাওয়া ও বিনোদন চলে। চলে প্রচলিত প্রথানুযায়ী এক সংগে ধর্মাচারণ ও উপাসনা এবং দলবেঁধে ঈদের বাজার ও পরম্পরায় আহারের ব্যাপক প্রস্তুতি। আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম বিনোদনই হল খাদ্যবিলাস। কোন কোন এশিয়ান পরিবারগুলোতে বৃদ্ধ বৃদ্ধারো নেই কোন নিজস্ব রুম। রাতের বেলা বসার ঘরেই বিছানা পাতা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপারও না। আর এসব নানান কারণেও  সম্ভব হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা।

বিলেতের দক্ষিণ এশীয়রা মূলত নিম্ন আয়ের মানুষ। করোনার কারনে ঘরে থাকার মত বিলাসিতা করার উপায় তাদের নেই।  পেশাগুলো হচ্ছে ট্যাক্সি চালনা, নার্সিং, বৃদ্ধদের কেয়ারার, হাসপাতালের কিচেন স্টাফ, ওয়ার্ড বয়, ডিনার লেডী, বাস ড্রাইভার, উবার চালক, মুদির দোকান সহকারী, ক্লাসরুম সহকারী, ক্লিনার, ডেলিভারি বয় এবং মোবাইল দোকানদার ধরনের আরও যা যা আছে। আর এদের বেশির ভাগই তাই এখন কোভিড যুদ্ধের অগ্রণী সৈনিক। এরা প্রতিদিন উপরে উক্ত পরিবেশ থেকে  কোভিদ ছড়ানো বিশ্বে বেরিয়ে কাজ করে দিন শেষে ঐ ঘনবদ্ধ পরিবারেই ফিরে আসেন। এদের  অনেকেরই ইংরাজী ভাষা ততটা আয়ত্বে নেই বলে কোভিদ সতর্কীকরণজনিত নানান তথ্য সম্পর্কে তারা অবগত নন। উল্লিখিত পেশা ছাড়াও উচ্চ আয়ের পেশাদারীরা বড় বাড়িতে থাকলেও  একই তারে বাঁধা বলে জীবন যাপন ও আহারে আয়াশে তারাও সমান। তাই করোনা যুদ্ধের অগ্রণী সৈনিকদের মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের বেশি ভাগ তাই এশিয়ান।

সুযোগ ও সুবিধার কিছু তারতম্যের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আর ইংল্যান্ডে বসবাসকারী সাধারণ বাংলাদেশিদের জীবন যাপনের মধ্যে নজরে পরার মত কোন গুণগত বিভেদ চোখে পড়ে না। তাই আমার দেশ বাংলাদেশের আপন জন ও সারাদেশের মানুষের সামনে কি আছে ভেবে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর আমি যে এখনো জীবিত আছি সেটাই এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা মনে হচ্ছে!

এমবি//