ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

রাসেল-জয়ের জুতো ও নুরুজ্জামানের পুরস্কার

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ১১:৪৫, ৮ আগস্ট ২০২২ | আপডেট: ১১:৫২, ৮ আগস্ট ২০২২

ডেভিস ইউজিন বোস্টার (বামে) ও হেনরি কিসিঞ্জার।

ডেভিস ইউজিন বোস্টার (বামে) ও হেনরি কিসিঞ্জার।

৮ আগস্ট। শুক্রবার। সকাল ১০টায় প্রথম ও দ্বিতীয় কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। সকাল সাড়ে ১০টায় রেল প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আলতাফ হোসেন সাক্ষাৎ করেন। সাড়ে ১১টায় দেখা করলেন পানি, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী মোমিনউদ্দিন আহমদ। এরা দুজনই মোশতাক সরকারের মন্ত্রী হন। সৈয়দ আলতাফ ছিলেন ন্যাপ মুজাফফর-এর নেতা।

এদিন জার্মানিতে ব্যস্ত সময় কাটান দুইবোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। 

এদিনের কথা এম এ ওয়াজেদ মিয়া লিখছেন, ‘বিকেলে হাসিনা, রেহানা ও বাচ্চাদের নিয়ে কার্লসরুয়ে শহরের বিপণীকেন্দ্রে পরিদর্শনে যাই। প্রথমে এদের সবার জন্য জামা-কাপড় কেনা হয়। অতঃপর একটি জুতোর দোকানে গিয়ে সেখানে হ্রাসকৃত মূল্যে সুন্দর সুন্দর জুতো পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যেকের জন্য জুতো নির্বাচন করার সময় হাসিনা জয়ের জুতোর একই ডিজাইনে ও রংয়ের একজোড়া জুতো নেয় রাসেলের জন্য।’

কিসের পুরষ্কার পেয়েছিলেন নুরুজ্জামান?

রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে ছিলেন না। তিনি যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পথে লন্ডনে ছিলেন। 

১৯৭৫। ১৪ আগস্ট। রাষ্ট্রদুত ইউজিন বোস্টারের পাঠানো বার্তায় বলা হয়েছে, রক্ষীবাহিনীর প্রধান এএনএম নুরুজ্জামান ১১ আগস্ট, সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। তার ভিসার জন্য আবেদনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়লের তরফে লেখা হয়েছে, নুরুজ্জামান অফিশিয়াল ডিউটিতে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন। তার অফিশিয়াল ডিউটি কী ধরনের জানতে চাইলে আমাদের বলা হয়, তিনি সেখানে একমাসের শিক্ষা সফরে যাচ্ছেন। এরপর দশদিনের ছুটি কাটাবেন। যতদূর জানা গেছে. নুরুজ্জামান সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কারও সঙ্গে থাকবেন। 

খালেদ মোশাররফ।

১৯ জানুয়ারি। ১৯৭৬। ফরেন অফিসে হেনরি কিসিঞ্জার বরাবর পাঠানো তারবার্তায় বোস্টার জানালেন, ‘১৯ তারিখ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন আমাকে ফোন করে একটি অতিগোপন অনুরোধ রাখার ইচ্ছে জানান। জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সাবেক প্রধান এএনএম নুরুজ্জামান ভারতে আশ্রয় নেওয়াদের একজন। সেখানে বাংলাদেশে অভ্যুথানের জন্য একটি বাহিনী গঠন করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অভিভূত হয়ে তিনি ভারত ত্যাগ করার ইচ্ছে জানিয়েছেন। সরকারও তাই চাচ্ছে। যেহেতু তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, তাই যুক্তরাষ্ট্রে তাকে বছর খানেকের জন্য কোনো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হোক। যেন পরে তাকে ফিরিয়ে এনে কূটনৈতিক পদে কাজে লাগানো যায়। তাকে ইংল্যান্ডে পাঠানোর কথাও ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে বাঙাালি অভিবাসীদের সংখ্যা বেশি বলে কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি।’ 

পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন অনুরোধ করেন, সিআইএ নুরুজ্জামানকে যেন তাদের তত্ত্বাবধানে নেয় এবং কোনো মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর খানেকের জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেয়।

উত্তর দিলেন ইউজিন বোস্টার, ‘অনুরোধটা আমি জায়গা মত জানাবে।’

পাশাপাশি কিছু সমস্যার কথা জানান বোস্টার, ‘বিশেষ করে নুরুজ্জামানকে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মার্কিন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে যা বিব্রতকর।’

উত্তর দিলেন তবারক হোসেন, ‘ব্যাপারটা বাংলাদেশ সরকারই সামাল দেবে। এটা এমনভাবে সারা হবে যাতে অস্বাভাবিক মনে না হয়। অন্য দশজন বিদেশি ছাত্রের মতোই নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাবেন। তার পড়াশোনার খরচের ব্যাপারে তবারক জানান যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমস্যা হলে বাংলাদেশ সরকার তা বহন করবে।’

দিল্লির মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্নেইডার আপত্তি জানিয়ে একটি বার্তা পাঠালেন। স্নেইডার জানান, ‘বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বিতর্কিত নুরুজ্জামানকে যুক্তরাষ্ট্র বাদে অন্য কোনো দেশে পাঠানো। অস্ট্রেলিয়া বা ফিলিপাইনের মতো নিরপেক্ষ দেশের নাম সুপারিশ করে স্নেইডার জানান, নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে গেলে ভারত সন্দেহ করবে।’

২৭ জানুয়ারি। এই তারবার্তার উত্তর দিলেন কিসিঞ্জার। বললেন, এ বিষয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে ভারত থেকে আমেরিকা যাওয়া এবং তার পড়াশোনার খরচের দায় বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে। আমেরিকার বাংলাদেশ মিশন নুরুজ্জামানের পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করবে। প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করা হবে।’ 

হেনরি কিসিঞ্জার।এবার কিসিঞ্জার দিল্লি দূতাবাসের সুপারিশমতো নুরুজ্জামানের জন্য অস্ট্রেলিয়া ফিলিপাইন বা অন্য কোনো দেশের নাম বিবেচনা করার জন্য ঢাকাকে অনুরোধ করেন।

২৮ জানুয়ারি। বোস্টার তারবার্তায় জানান, ‘পুরো ব্যাপারটা অতি-গোপনীয় বলেই এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ মিশনের কাউকে জড়িত করা সম্ভব হচ্ছে না। একই প্রেক্ষাপটে অন্য কোনো দেশেও তাকে পাঠানো যাচ্ছে না। কারণ ওই দেশগুলো এই গোপন তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারে। পুরো ব্যাপারটা খুব কম মানুষ জানেন। বাংলাদেশে জেনারেল জিয়া, মিসেস নুরুজ্জামান, যিনি স্বামীর হয়ে মধ্যস্থতা করছেন এবং তবারক হোসেনই জানেন বিষয়টা এবং তা আর কেউ জানুক তারা চান না। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধর্ণা দেওয়ার একটাই কারণ, গোপনীয় বিষয় এবং সম্পূরক ব্যাপারগুলো সম্পর্কে তাদের উপর আস্থা রাখা যায়।’

৫ ফেব্রুয়ারি। তারবার্তায় বোস্টার তবারককে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা দেন।
তবারক উদ্বেগ প্রকাশ করেন, বছরের এই সময়ে কোনো প্রতিষ্ঠান নুরুজ্জামানকে ভর্তি নেবে কিনা?  

১২ আগস্ট। লন্ডন থেকে জানানো হয় নুরুজ্জামান সম্ভবত ২১ জুলাই ইংল্যান্ড ত্যাগ করেছেন। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছেন কিনা? ২০ আগস্ট আরেকটি তারবার্তায় জানা যায়, বিষয়টি অতি-গোপনীয়, তাই বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সম্ভব না।

২৫ আগস্ট। কিসিঞ্জারের বার্তা বলছে, ‘নুরুজ্জামান চার সপ্তাহ হলো আমেরিকায় পৌঁছেছেন। তিনি থাকছেন ভগ্নিপতি হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। তবে এই মুহূর্তে পূর্ব আমেরিকায় ঘুরতে গেছেন।’ এরপর নুরুজ্জামান আর দেশে ফিরে আসেননি।

বিদেশেই কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন মিশনে। ১৯৯৩ সালের ১৫ মার্চ সুইডেনের স্টকহোমে মৃত্যু হয় তার। 

১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাতে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকারের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থানটি হয়, তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন নুরুজ্জামান। ৬ নভেম্বর তার বাসা থেকে সামরিক পোশাক বদলে, তারই জামা-কাপড় পরে বের হন খালেদ মোশাররফ এবং সাভার যাওয়ার পথে গ্রেফতার ও পরে নিহত হন।

এটা কী জিয়ার সঙ্গে গোপন সমঝোতার পুরষ্কার? কারণ, ২ নভেম্বর। ১৯৭৫। রাত। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে খন্দকার মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের অন্যতম ব্যক্তি নুরুজ্জামান। আর ৬ নভেম্বর নুরুজ্জামানের বাসা থেকে সামরিক পোশাক পাল্টে নুরুজ্জামানের পোশাক পরে বের হন খালেদ মোশাররফ। সাভার যাওয়ার পথে গ্রেফতার হন। পরে নিহত হন খালেদ মোশাররফ। খালেদ মোশাররফকে ধরিয়ে দেয়ার পুরষ্কার দিয়েছিলেন জিয়া?

তবে 'নুরুজ্জামান কেস' নামে কিছু তারবার্তা আবারও গোপনীয় হয়ে যায়, কেন? আবার, বেশ কিছু তারবার্তা মুছে ফেলা হয়। কারণ, এসব অত্যন্ত ‘স্পর্শকাতর’।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও বঙ্গবন্ধু গবেষক। 

এসি
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি