ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

আবেগ-অনুভূতি ও স্বপ্নের নাম দীপনপুর

প্রকাশিত : ১৮:১২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১২:১১, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

স্বাধীনচেতা ও পরিচ্ছন্ন, সোজাসাপ্টা চিন্তা করতে পারার মানুষের ভীষণ অভাব চারদিকে। মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারাটা সবচেয়ে বড় যোগ্যতা, তবে আমাদের সমাজে সেটা ‘অপরাধ’। এই ‘অপরাধে’ই ঘাতকের চাপাতির নিচে প্রাণ দিয়েছিলেন প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন। একজন তরুণ প্রকাশক হিসেবে, একজন লেখক হিসেবে সর্বোপরি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার জায়গা থেকে ফয়সাল আরেফিন দীপন সাহসী ছিলেন।

নিজের অফিসে বইয়ের প্রুফ কাটা অবস্থায় হামলার শিকার হয়েছিলেন দীপন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তার দেহটি হয়ে যায় প্রাণহীণ, নিথর। কিন্তু তার চিন্তা, কাজ বা স্বপ্নগুলো কী হারিয়ে গেছে? একজন মানুষ না থাকলে কি তার কাজ, চিন্তা বা স্বপ্নেরা হারিয়ে যায়?

এমন চিন্তা তাড়িত করে তার আশপাশের মানুষদের। হৃদয়ের ক্ষত থেকে যখন রক্ত ঝরছে, সেই রক্তগুলোকে জমাট বাঁধিয়ে তারা এক সাহসী ঝুঁকি নেন। দীপনের কাজ, চিন্তা ও স্বপ্নের সমন্বয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করেন দীপনপুর।

বস্তুত দীপনপুর একটি বড় বইয়ের দোকান ও ক্যাফে। কাঁটাবন পেরিয়ে অ্যালিফেন্ট রোডের দিকে যেতেই এর অবস্থান। দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হওয়া  মুক্তমনা লেখক ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি এর প্রধান উদ্যোক্তা। তবে সমমনা বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই কাজ করছেন একসঙ্গে।

দীপনপুরের নান্দনিক নির্মাণশৈলী, পাঠকদের নিয়মিত আড্ডা, বই পড়ার সুন্দর পরিবেশ - মুহুর্তেই মনে হবে আপনি হয়তো এসে পড়েছেন বইয়ের স্বর্গে। ব্যস্ত জীবনের একঘেয়েমি, মানসিক অবসাদ ও ক্লান্তিতে আপনি যখন খানিকের জন্য নিজেকে একা করতে চাচ্ছেন, বইয়ের জগতে ডুব দিতে চাচ্ছেন তখনই ঘুরে আসতে পারেন দীপনপুর।

দীপনপুরেই কথা হলো এ প্রতিষ্ঠানেরই একজন নিপা লায়লার সঙ্গে। নিপা বলেন, যদি পাঠক না থাকে আমি লাখ লাখ টাকার বই রেখে কী করব? তাই বই বিক্রীর পাশাপাশি পাঠক সৃষ্টি করা আমাদের উদ্দেশ্য।

সেজন্যই বই না কিনেও দীপনপুরে বসে সারাদিন বই পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে হ্যাঁ, না কিনে বই বাড়ীতে নেওয়ার সুযোগ নেই। দীপনপুরে নেই কোন মেম্বারশিপের ব্যবস্থা। অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা নিরিবিলি এভাবেই বই পড়ার সুযোগ আর কোথায় পাবেন বলুনতো? দীপনপুরে রয়েছে একটি ক্যাফে শপ। কাউকে বললেই হাতে তুলে দিবে এক মগ কফি। একহাতে প্রিয় লেখকের বই, অন্য হাতে কফি। এমন সময়ের অনুভূতিটাই তো আলাদা।

ক্ষতচিহ্নকে ধরে রাখার সৎ সাহস আছে বলেই ফয়সাল আরেফীন দীপনের স্ত্রী দীপনপুরের প্রবেশ মুখে সাজিয়ে রেখেছেন দীপনের স্মৃতিচিহ্ন। সেই চেয়ার- টেবিল, যেখানে দীপন সব সময় বসতেন, যেখানে বইয়ের প্রুফ দেখতে দেখতে ঘাতকের চাপাতির শিকার হয়েছেন। বইয়ের উপর ছিটকে পড়া রক্তের দাগ এখনো নীরবে প্রতিবাদ করে অন্ধতা, মূর্খতার।

দীপনপুরকে সাজানো হয়েছে কয়েকভাগে। একটি ভাগের নাম দ্বীপান্তর। এটি মূলত শিশুদের রাজ্য। শিশুদের মুখরতা কম বেশী সব সময়ই থাকে। এখানে সাজানো আছে শিশুতোষ অসংখ্য বই। নিচে সবুজ কার্পেট। ভর দুপুরে সবুজ কার্পেটে খালি পায়ে আধশোয়া হয়ে বা হামাগুড়ি দিয়ে বসে বাচ্চারা বই পড়ছে, নেড়েচেড়ে ছবি দেখছে- এটা এখানে স্বাভাবিক দৃশ্য। বই পড়তে পড়তে খিদে পেলে কষ্ট পাওয়ার দরকার কী? আছে ক্যাফে দীপাঞ্জলী।  মনোমুগ্ধকর ডিজাইন ও ঘরোয়া খাবারের স্বাদ এর অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। বাজারের অন্য যেকোনো স্থানের তুলনায় দীপাঞ্জলীর স্ন্যাক্স আইটেমগুলো সস্তা।

দীপনতলা শিল্প- সাহিত্য- সংস্কৃতির যে কোন অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। ভাড়ার মূল্য মাত্র তিনহাজার টাকা। এছাড়া দীপাবলি ও জাগৃতি নামে দুটি আলাদা কর্ণার রয়েছে। মাঝে সারি সারি করে সাজানো আছে হাজার হাজার বই।

মাত্র ১০ হাজার বই দিয়ে যাত্রা শুরু করা দীপনপুরে এখন পাওয়া যায় না তেমন কোনো বই নেই। তবে হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত বিদেশী কোন বই এখানে বিক্রি করা হয় না। `নট ফর সেল` লেখা ব্যতীত অন্য যেকোনো বই আপনি কিনতে পারবেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, ধর্ম এমনকি রান্নার বইও পাওয়া যায়। স্পর্শকাতর, অনুভূতিতে আঘাত করার সম্ভাবনা আছে এমন কোনো বই দীপনপুরে বিক্রি হয় না।

দীপনপুরের আরেকটি বড় বৈশিষ্ঠ্য হলো এখানে অনেক পুরনো সংস্করনের বই পাওয়া যায়। আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ’ বছর আগের বই- অনেক খোঁজ করেও বাজারে পাচ্ছেন না, ভাগ্য ভালো হলে এমন বই পেয়েও যেতে পারেন দীপনপুরে।

দীপনপুরের প্রধান উদ্যোক্তা ডা. রাজিয়া রহমান এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, দীপনপুর আমার কাছে দীপন স্মৃতিঘর। দীপন পড়াশুনা নিয়ে কাজ করতেন। সেই জায়গা থেকে দীপনপুরকে একটা ব্রত হিসেবে নিয়েছি। পাঠক সৃষ্টি করে পাঠকের হাতে বই তুলে দেওয়াই আমাদের ব্রত।

মানুষ মরে গেলেও তার স্বপ্ন মরে যায় না। দীপনের স্বপ্ন আমাদের কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগায়।

/ এআর /

 

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি