ঢাকা, মঙ্গলবার   ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

যোগাযোগ মানেই সংযোগ নয়

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১১:৩১, ২৫ আগস্ট ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

মুখোমুখি বসে ছিলাম আমরা-চিলির সবচেয়ে জননন্দিত দৈনিকের খ্যাতনামা এক তরুণ সাংবাদিক আমি। আমার একটি সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন তিনি। এ প্রশ্ন-সে প্রশ্নের পর জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘গতকালের উন্মুক্ত বক্তৃতায় আপনি বলেছেন যে মানুষে-মানুষে যোগাযোগ বাড়ছে, কিন্তু সংযোগ কমে যাচ্ছে। পার্থক্যটা কোথায়, কি বোঝাতে চেয়েছেন আপনি’?
 
পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালাম তাঁর দিকে। কত বয়স হবে- বড় জোর পঁয়ত্রিশ। ‘আপনি কি সান্তিয়াগোর’? জিজ্ঞেস করি আমি। ‘না, লম্বা চিলির প্রায় শেষ মাথায় আমার শহর’, হেসে জবাব দেন তিনি। ‘মা-বাবা আছেন? ক’ ভাই-বোন আপনারা?’, জানতে চাই আমি। তিনি একটু অবাক হন এ প্রশ্নে - নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। তবু ভদ্রতার খাতিরেই হয়তো জবাব দেন, ‘মা নেই, বাবা আছেন। তিন ভাই, এক বোন আমরা’। 

‘বাবার সঙ্গে কথা হয়?’, আমার প্রশ্ন চলতে থাকে। এবার বেশ বিভ্রান্ত মনে হয় তাকে। ‘সপ্তাহে একদিন তো কথা হয়ই।’ কণ্ঠে তাঁর সুপ্ত বিরক্তি। ‘সুপুত্র আপনি। কবে আপনি শেষ বাড়ীতে গেছেন?’ আমার প্রশ্নের রেলগাড়ী থামে না। ‘আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আমরা সব ভাই বোন গত বড়দিনেই বাবার ওখানে গিয়েছিলাম।’, বিরক্তি সুস্পষ্ট তাঁর কণ্ঠে এবার।

‘ক’ দিন ছিলেন?’, আমি নির্বিকার। আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকান তিনি - বুঝতে চেষ্টা করেন আমার উদ্দেশ্যটা কি। আমার সাক্ষাৎকার তাঁর নেয়ার কথা, এখন মনে হচ্ছে আমিই তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। ‘তিন দিন’, গলায় কাঠিন্য এনে তিনি বলেন।

‘খুব ভালো কথা। তা ওই তিন দিনে বাবার কাছে বসেছিলেন সময় করে? হাত ধরেছিলেন? চোখে চোখ রেখে কথা কয়েছিলেন’? এবার আর কথা বলেন না তিনি। চেয়ে দেখি মাথাটি একটু নত করে তিনি তাঁর কোলের ওপর রাখা খাতায়  আঁকি-বুঁকি আঁকছেন। ‘বাবার পাশে বসে, তাঁর হাত ধরে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি সত্যি সত্যিই কেমন আছে ‘? শেষ প্রশ্ন আমার। তিনি একটু উদাস হয়ে যান, দৃষ্টি ছড়িয়ে দেন জানালার বাইরে তিনি। বিন্দু বিন্দু ঘামও যেন দেখতে পাই তাঁর কপালে।

‘না, না, আপনার লজ্জিত হওয়ার কোন কারন নেই’, আশ্বস্ত করি আমার সামনে উপবিষ্ট  চিলির সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিকের খ্যাতনামা তরুণ সাংবাদিকটিকে। ‘আমরা সবাই একই রকম। কিন্তু আপনি জানতে চেয়েছিলেন না, যোগাযোগ আর সংযোগের মধ্যে তফাতটা কোথায়? আপনার বাবার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে, কিন্তু সংযোগ নেই।’ আলাপ আর জমে না তারপর। দু একটা টুকিটাকি প্রশ্ন করে তিনি উঠে যান। আর আমি ভাবতে বসি।

যোগাযোগ হচ্ছে কথার, তথ্য বিনিময়ের, সংবাদ নেয়ার। সংযোগটা হচ্ছে মনের, হৃদয়ের, চোখে-চোখ রাখার, স্পর্শের। যোগাযোগের জন্য সামনা সামনি উপস্থিতির প্রয়োজন নেই, সংযোগের জন্য সেটা বড় প্রয়োজন। এই তো নানান সামাজিক মাধ্যমের কারণে কতজনের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে, কিন্তু সংযোগের জন্য লাগবে সামনা সামনি বসা, চোখে-চোখ রেখে গল্প করা, হাতে হাত রেখে হৃদয়ের উষ্ণতা অনুভব করা। যোগাযোগ সংযোগের জন্য আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্ত পর্যাপ্ত শর্ত নয়।

এই তো একই ঘরের চালার নীচে বসে বাবা হয়তো টেলিভিশনে বিশ্বসংবাদ দেখছেন, মা হয়তো মুঠোফোনে দূরেরই কোন বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলছেন, ছেলেটি অবয়ব পত্রে ব্যস্ত। যোগাযোগ রাখছেন তাঁরা বাইরের বিশ্বের সঙ্গে, কিন্তু পারিবারিক কোন সংযোগ নেই। যে সংযোগে মন ভরে ওঠে, হৃদয় আপ্লুত হয়, সম্পর্কের উষ্ণতায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সারা চেতনা, এ গৃহে সে সংযোগ কোথায়?

বিশ বছর আগে যখন পূর্বী নদী পার হতে গিয়ে ঝুলন্ত বগিতে থাকতাম, তখন পারস্পরিক গল্পের প্রাবল্যে কান পাতা দায় হত। একে অন্যের খোঁজ নিচ্ছেন, বাচ্চাদের ইস্কুলের কথা হচ্ছে, ভাগাভাগি হচ্ছে সুখ-দু:খের গল্প। তৈরি হয়েছে কত বন্ধুত্ব, গড়ে উঠেছে কত সখ্যতা। মানুষে-মানুষে তখন একটা সংযোগ তৈরি হত।


লোকবক্তৃতারত, চিলির সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার প্রদান, চিলিতে জাতিসংঘ প্রধান সহকর্মী ও দীর্ঘদিনের বন্ধু সিলভিয়া রুকসের সঙ্গে লেখক।

আর এখন বগিতে উঠলে মনে হয়, একটা মৃতপুরীতে প্রবেশ করেছি। সারা বগিতে কোন কথা নেই, একজন অন্যদনের দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। সবার চোখ মুঠোফোনের পর্দায়- খুটখুট শব্দ হচ্ছে শুধু। সবাই যোগাযোগ স্হাপন করছেন সারা বিশ্বের সঙ্গে, কিন্ত ঐ ছোট্ট বগির ৫০ জন মানুষের মধ্যে কোন সংযোগ নেই- একদিন ছিল, আজ তা হারিয়ে গেছে।

শুধু যোগাযোগের প্রাবল্য তো অনেক সময়েই আমাদের ভাবলেশহীন যান্ত্রিক এক স্বত্ত্বায় পরিণত করে। তাই বন্ধুর পিতৃবিয়োগের সংবাদ যখন অবয়বপত্রে বেরোয়, তখন অনেকেই কিছু না দেখেই সম্পূর্ণ যান্ত্রিকভাবেই ‘ভালো লেগেছে’ কিংবা ‘পছন্দ হয়েছে’ লিখে দেন। ‘কি ভালো লেগেছে - পিতৃবন্ধুর মৃত্যু, কি পছন্দ হয়েছে - অন্য বন্ধুরা যে শোকবাণী পাঠিয়েছে তা’?

যোগাযোগ আমরা নিশ্চয়ই রাখব, কিন্তু মানুষে-মানুষে সংযোগ যেন হারিয়ে না যায়। ওটা হারিয়ে গেলে মানুষের আর রইলো কি?

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি