ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৪ মে ২০২৪

রেইড এ্যাট ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ (পর্ব-১)

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ১৭:৫৯, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ | আপডেট: ১৮:২১, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

‘স্যার, উত্তম আজ সন্ধ্যায় বাড়ি এসেছে’-ফিসফিস করে বললো বাজারে থাকা সোর্স। বাজারে সেই আমার  ‘সিসিটিভি ক্যামেরা’। ভাইবোন ছড়া বাজারে এই সোর্সের একটা ঔষধের দোকান আছে। আমি ওর দোকানে ঔষধ কেনার ছলে ঢুকলে ও আমাকে জানায় আমার হাই ভ্যালু টার্গেট (এইচ ভিটি) উত্তমের বাড়ি ফেরার তথ্যটি।
‘তুমি কিভাবে জানলে?’-আমি নিশ্চিত হতে চাই। 
‘স্যার ও আমার দোকান থেকে ঔষধ নিয়েছে’।
‘কী ঔষধ’-আমি জানতে চাই।
‘সেকলো স্যার’।

আমার মনের ফোল্ডারে থাকা উত্তমের প্রোফাইলের সাথে মিলে যায় ঔষধের নামটি। হ্যাঁ, অনেকদিন থেকেই উত্তমের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে। অতএব তথ্য সঠিক মনে মনে বলি।

একপাতা প্যারাসিটামলের ‘দাম’ ৫০০ টাকা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে খুব দ্রুতই জিপে চড়ে বসি। ড্রাইভারকে খুব ছোট্র করে আদেশ দিলাম-‘ফরেস্ট টিলা’। ওখানেই উত্তমের মাটির দেয়াল আর টিনের চালের ঘর। 
আমার আজ রাতে ভাইবোনছড়া ক্যাম্পে রাত্রি যাপনের প্রোগ্রাম। তা সে পথে যেতেই  সোর্সের ফার্মেসীতে ঢুঁ মারা। আর তাতেই মিলে গেল আমার জন্য ওসামা বিন লাদেন সম উত্তমের সংবাদ।
বাজারের ঢালু টিলা শেষে হাতের বা দিকে দ্রুতই টার্ন করলো সদ্য বরাদ্দকৃত নতুন ফোর হুইল টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার জিপটি। 

খাগড়াছড়ি-পানছড়ি পাকা সড়ককে একটি সরু মাটির রাস্তা দিয়ে সংযুক্ত করেছে ফরেস্ট অফিসটি। এর কারণেই এটা ফরেস্ট টিলা নামে পরিচিত। এ টিলারই এক প্রান্তে উত্তমের ঘর।

একসময় উত্তম ছিল শান্তি বাহিনীর (জেএসএস) সশস্ত্র দলের স্কাউট বা অগ্রগামী সেনা। শান্তিচুক্তির পর বেশ ক’বছর স্বাভাবিক জীবনেই ছিল সে। কিন্তু ২০০৪ সালে এসে আবার উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে।
আমার ক্যাম্পের গোল ঘরে বসে ওর অতীত জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার কথাই শুনিয়েছে। সেটাও  ছ’মাস আগের কথা। ইউপিডিএফ গঠনের পর এলাকার আধিপত্য ও চাদাঁর হিস্যা নিয়ে ওর সাথে প্রতিপক্ষের বিরোধ ছিল। ওকে পরামর্শ দিয়েছি এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে। আমাকে কথাও দিয়েছিলো-
‘স্যার আমি রাঙামাটিতে শ্বশুর বাড়ির দিকে চলে যাব’।

‘কেও কথা রাখেনি’ সুনীলের কবিতার মতো সেও ফেরত যায়নি। ফিরে গিয়েছিল তার পুরাতন দলের আদর্শহীন রক্তক্ষয়ী পথে। চাদাঁর টাকার স্বাদ কি সহজে ভোলা যায়। আজ বোধহয় তারই মূল্য দিতে যাচ্ছে সে। 

ওর ঘরের সামনের উঠোনে জিপটি থামে। গাড়ীর ইঞ্জিনের শব্দ আর হেডলাইটের তীব্র আলো ওর ঘুম কেড়ে নেয়। আমি দরজায় কড়া নাড়ি- ‘উত্তম ঘরোত আঘেনি’?

নিরবতার একটা প্রহর কাটছে। মনে হলো আমার ম্যাসেজ দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে রিসিভ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর নেটওয়ার্ক পেল।

ভেতর থেকে কম্পিত কণ্ঠে জবাব দেয় উত্তমের স্ত্রী কল্যাণী- ‘নাদে (না), সে ঘরত নেই’।
আমি বললাম-‘তুই ন ডরিস, মূই ক্যাম্পো থন এইচ্ছোন। উত্তমোর লগে একখান কথা আঘে। দরজা হান খোল। মূই জানং, সে ঘরত আঘে।’

উত্তম বের হয়ে আসে। হালকা গড়নের ত্রিশোর্ধ এক তরুণ। ওর স্ত্রীর শঙ্কা দূর করতে বলি ওর সাথে কথা আছে ক্যাম্পে যাবে। তুমি ঘুমে পড়। কল্যাণীর সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে শঙ্কার স্পষ্ট ছাপ।

আমি উত্তমকে জিপের সামনের আসনে বসিয়ে আমি চালকের আসনে বসে পড়ি। দ্রুতই গাড়ি চালিয়ে ক্যাম্পের গোল ঘরে ওর মুখোমুখি হই।

এরপর কিছু সময় নেই উত্তমকে বোঝাতে, কেন ওকে এভাবে তুলে আনা হলো।

আমি নিরবতা ভেঙে সরাসরি উত্তমকে বললাম-‘উত্তম, তুমি আজ যেখান থেকে এসেছো আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে’।

উত্তম গত ২/৩ মাস আমার এলাকায় অনুপস্থিত ছিল। প্রতিপক্ষের ওপর কয়েকটি হামলায় সে নেতৃত্ব দিয়েছে তা বিভিন্ন মারফত আমার কাছে খবর আসতো। পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য সন্ধ্যার একটু পরে বাড়িতে আসে। রমজান মাসে ইফতারির সময় আর্মি কিছুটা শিথিল থাকে তাই ঐ সময়টা সে বেছে নেয় বাড়িতে প্রবেশ করার।

কিন্তু ওর গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা ওকে বাজার থেকে ঔষধ কিনতে বাধ্য করায় ওর এলাকায় উপস্থিতি আমার ‘সিসি ক্যামেরায় ধরা পরে। রাত ন’টার দিকে পানছড়ি জোন থেকে আমিও যাচ্ছিলাম ভাইবোন ছড়া ক্যাম্পে পূর্ব নির্ধারিত নাইট স্টে করার জন্য। ওর গ্যাস্ট্রিক পেইন আর আমার নাইট স্টে প্লান দুটোই অদৃশ্য ইঙ্গিতে এক হওয়ার ফলাফল : উত্তম আমার মুঠোয়।

আধো আলোতে দেখতে পেলাম ওর চোখে মুখে শঙ্কার ছাপ। আর আমি অনুভব করলাম আমার রক্তে ‘ওসামা বিন লাদেন’ বধের আশু উত্তেজনায় পারদের ঊর্ধ্বমুখী চাপ।

উত্তম আমাকে ধোকা দেওয়ার চেষ্টা করে, ‘স্যার, আমি রাঙ্গামাটি থাকি, আমিতো ওদের খবর জানি না’। 
আমি অনড় থাকিঃ আমাকে নিতে হবে তোমার বন্ধুদের আস্তানায় নতুবা...
উত্তম বুঝলো ইঙ্গিতময় ইশারা। চারিদিকে তখন নব গঠিত ‘একটি বিশেষ বাহিনীর’ জয়জয়কার। ওরা জানি কি সব কায়কারবার করে আর তা পাবলিক ভীষণ ‘লাইক’ করে। 

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জুনিয়র জর্জ বুশ কর্তৃক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে আফগানিস্তানে হামলার আগে যেমন করে বলেছিল আমিও তার অনুকরণে বললাম- 
‘হয় তুমি আমার সাথে আছো, না হয় শত্রুদের সাথে আছো’।
‘স্যার, ওরাতো আমাকে মেরে ফেলবে যদি আমি আপনাকে ওখানে নিয়ে যাই’-উত্তমের ভেঙ্গে পড়ার লক্ষণ। 

এরপর চললো চূড়ান্তভাবে ওর মনের সংশয় দূর করার। ‘পড়েছিস মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে একপাতে’-ও সম্মতি দিলো আমাদের গাইড করে নিয়ে যাবে ওদের অস্থায়ী আস্তানায়-যা দিঘীনালা-পানছড়ি জোনের আন্তঃসীমানায় অবস্থিত। এটি একটি ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’। 

দুই জোন থেকে খুব একটা সেনা টহল এখানে আসে না। এই রিজ লাইনের চূড়াগুলো ঘন জঙ্গলাকীর্ণ। এখানে কোন পাহাড়ি জুম করতে আসে না।

এটা মাঝারি উচ্চতার (গড়ে ৮শ ফিট) একটি রিজ লাইন। যা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। পশ্চিমে পানছড়ি প্রান্তের দিক থেকে খাড়া, আরোহণ কষ্টকর। কিন্তু পূর্বে দিঘীনালার দিক থেকে সহজ। এ রিজ লাইনে বসে দিঘীনালার সমতল এলাকায় কোন সংঘবদ্ধ দলের চলাচল সহজেই চোখে পড়ে। এ রিজ লাইন থেকে অসংখ্য ঝর্ণা বা ছোট নালা বের হয়ে বর্ষা ভয়ঙ্কর চেঙ্গী নদীর সাথে মিশেছে।

এসব ছোট নালা বা ছড়ার পাশেই পাহাড়ি পাড়াগুলোতে থাকে স্থানীয়রা। রিজের চূড়ায় বসবাস করলেও উত্তমের সহযোগীরা রসদ এবং তথ্য দুটোর জন্য রিজের নীচে ছড়ার পাশের বাসিন্দাদের উপর নির্ভর করে।

পার্বত্য চট্রগ্রামে রেইড একটি কঠিন ধরনের অপারেশন। লক্ষ্যবস্তুর সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা এবং ওখানে পৌঁছানোর জন্য বিশ্বস্ত গাইড না থাকলে সফলতা পাওয়া দুষ্কর। উত্তম সফলতার সে রকমই এক উপাদান।

অধিনায়ককে জানালাম। উনি রাজী। কিন্তু সমস্যা ছিল লোকেশনটা আন্তঃজোন বাউন্ডারির উপর। অতএব ব্রিগেডের পারমিশন লাগবে। তার উপর ঐ ধরনের অপারেশনে যে লোকবল লাগবে তা আমার নেই। পার্শ্ববর্তী রেজামনি ক্যাম্প থেকেও সৈনিক নিতে হবে। মিনিমাম দুটো বি’ টাইপ পেট্রোল লাগবে। রাত তখন দশটা, সারাদিনের রোজার পর ক্লান্ত সৈনিকরা বিশ্রামরত। এদেরকে প্রস্তুত করে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে রওনা দিতে হবে। এই অপারেশন রাতেই শুরু করতে হবে। দিনের আলোতে পেট্রোল বের হলে এর গোপনীয়তা রাখা যাবে না। আর সকাল হলেই উত্তমের আটকের খবর গোপন রাখা যাবে না। আজ রাতে অপারেশনে গেলে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা ১০০% ভাগ। এসব নানাদিক কোর্সমেট সিও নাঈমকে জানানো হলো। অধিনায়ক সময় নিলেন কমান্ডারের সাথে আলাপ করার জন্য।

আমি উত্তমকে নিয়ে আবার ব্যস্ত হলাম-
টার্গেটের বিশদ বর্ণনা শুনে শুনে স্কেচ তৈরি করলাম। কোথায় সেন্ট্রী থাকে, কোন পথ দিয়ে টার্গেটে উঠতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

যাহোক আমাকে হতাশ করে কোর্সমেট অধিনায়ক নাঈম বললো, ‘দোস্ত, কাল সকালে ব্রিগেড কমান্ডার তোর আর আমার সাথে কথা বলবেন’।
‘উনি রিস্ক নিতে চান না’।
‘তুই আজ রাতে নাকে তেল দিয়ে ঘুমা’।

শেয়ার মার্কেটের দরপতনের মতন মনটা গেল চুপসে। 
উত্তম আটকের খবর যেন ভাইরাল না হয় তার চেষ্টা হিসাবে ক্যাম্প জেসিও ছুটে গেল বাজারের দুটো মোবাইল দোকানে। টিভির এ্যান্টিনা লম্বা বাশেঁর আগায় বেধেঁ একটা ডিজিটাল যুগের সেবা (৫ টাকা মিনিট) বিক্রি করত দু’দোকানি। পরদিন সকালে সেবা নিতে আসা গ্রাহকরা জানতে পারলো ‘নেটওয়ার্ক নেই’। 

সকাল ৮টার দিকে সদ্য রাজভবন (বঙ্গভবন) থেকে ফেরা প্রেসিডেন্টের এক্স -এডিসি মেজর জাহাঙ্গীর এসে হাজির ‘স্যার, আমিও যাচ্ছি আজকের পিকনিকে’। সিও, আমাকে থাকতে বলেছে বি. কমান্ডারের ব্রিফিংয়ে।
ব্রিগেড কমান্ডারের দেখা মিললো। উনি প্রথমেই বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না তার এলাকায় জেএসএস এর এ রকম একটি ক্যাম্পের অস্তিত্ব থাকার কথা। নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করে যাচাই করতে চাইলেন। অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়েও মতানৈক্য কিছু সময় নিয়ে চললো।

উনি চাইছিলেন দীঘিনালার দিক থেকে অপারেশনটি শুরু করা হোক। আমি উত্তমের বয়ান দিয়ে বললাম দীঘিনালা থেকে অপারেশন শুরু করলে গোপনীয়তা রক্ষা করা যাবে না। কারণ ঐ হাইড আউট থেকে সব মুভমেন্ট স্পষ্ট দেখা যায় তাছাড়া এতো এতো পাড়ার পাশ দিয়ে গেলে গণ লাইনের মাধ্যমে খবর পৌঁছে যাবে।
আর পানছড়ির দিক থেকে এগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছড়া এবং খাড়া পাহাড় অতিক্রম করতে হবে, তবে এতে গোপনীয়তা বজায় থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে শত্রুর ক্যাম্পে উঠার খাড়া পথটি এদিকেই।

‘Ok, In that case, you will be the first man in the patroll’.-ব্রিগেড কমান্ডার আমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন।
‘If not me, who else’-আমার দৃঢ় উত্তর।
স্পষ্টতই শারীরিক ঝুঁকির বিষয়টি আমার উপর চাপাতে চাইলেন। মনে মনে ভাবলাম- মাছ ধরতে নেমেছি, আর পানিতে নামবো না তাই কী হয়।
‘I wish you a good luck’- কমান্ডার আমাদের দু’জনের সাথে করমর্দন করে বিদায় নিতে নিতে ব্রিগেড মেজর শামীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আলমগীর টিলা বরাবর একটি ব্লকিং পজিশন বসাও।
এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাচঁলাম। জিপের ড্রাইভিং সীটে বসা জাহাঙ্গীর’ You will be the first man...কথাটি নিয়ে মজা করতে করতে বললো স্যার তবে কি আমি  second man হিসাবে থাকছি? 
‘তুমিতো প্রেসিডেন্টের পিছনে পিছনে সেকেন্ড ম্যান হিসাবেই থাকতে এবারো তাই।’-আমার পাল্টা উত্তর।

‘তুমি ক্রীম খাওয়া লোক, তোমার তো কমপক্ষে সেনাসদরে থাকার কথা, তুমি কী করে পানছড়ির জোঁক-জঙ্গলে এলে?- আমি ফোড়ঁন কাটি।
‘স্যার, কপালে যদি পিকনিক (অপারেশনের ছদ্মনাম) লেখা থাকে তবে আর কী করা’-জাহাঙ্গীরের সরল স্বীকারোক্তি। 

পিকনিকে আমাদের জন্য কী মেনু আছে সেটা রাতেই বোঝা যাবে, এসব ভাবতে ভাবতে আর অপারেশনের বিশদ পরিকল্পনার খুটি-নাটি দিকগুলো আলোচনা করতে করতে জোন সদরে ফিরে এলাম। তিনটে বি টাইপ পেট্রোল- ভাইবোনছড়া, রেজামনি ও গঙ্গারাম ক্যাম্প থেকে যাবে। তৃতীয় পেট্রোলের দায়িত্বে থাকবে সদ্য মর্টার কোর্স করা লেফটেনেন্ট ইমরান। রাত ৮ টার পর যার যার লোকেশন থেকে পেট্রোল গুলি বের হয়ে মিলনস্থান ‘প্রদীপ পাড়ায়’ আসলে সেখান থেকে উত্তমের পথ নির্দেশে চূড়ান্ত লক্ষ্যবস্তু ‘কোনারায় পাড়ায় যাব। এ পাড়ার সন্নিকটবর্তী উঁচু টিলাতেই আছে জেএসএস’র ১৫ জনের একটি দলের আস্তানা।

সারাদিনই নানা রকম প্রস্তুতির পর অপেক্ষার পালা। কিন্তু সন্ধ্যায় ইফতারির পর সবাইকে চূড়ান্ত হতাশায় ডুবিয়ে নামলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। মনের আয়নায় দেখতে পাচ্ছিলাম ফুলে ফেঁপে উঠা ছড়া গুলোর ভয়ঙ্কর রূপ: কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ঘোলা পানি তীব্র বেগে ছুটে চলেছে, খড়ঁ-কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে উপড়েপরা কোন গাছের কাণ্ড, বাঁশের চাই, শুকনো ডালপালার আস্তরণ।

শেয়ার মার্কেটের অব্যাহত দরপতনের মতো আমার উত্তমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যেরও মূল্য কমতে থাকলো মনে হয়। গতকাল যে তথ্যের সূচক ১০০তে ছিল আজ রাত পেরোলে তা অর্ধেকে নেমে আসবে। প্রকৃতির ইচ্ছার কাছে হার মেনে সে রাতের জন্য পিকনিক স্থগিত করা হলো। কারণ কোন অবস্থাতেই রাতের আধাঁরে বর্ষা ভয়ঙ্কর খোরশ্রোতা ছড়া পার হয়ে শত্রুর আস্তানায় আঘাত হানার চিন্তা আত্মহত্যার সামিল।

চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে উত্তম আমাদের অতিথি। ওকে নানাবিধ উপঢৌকনে আর ব্যাঞ্জনে মোটামুটি জামাই আদরে আপ্যায়িত করা হচ্ছে। কল্যাণীকে উত্তমের হাল হকিকত জানিয়ে তাকে প্রবোধ দেওয়া হয়েছে। 

দ্বিতীয় সন্ধ্যায় একই ঘটনা। সারাদিন রোদ্র করোজ্বল। ইফতারির পর আবার বৃষ্টি। অদৃষ্টকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কী বা করার আছে। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম কত সব বড় বড় সামরিক অভিযান বাতিল হয়েছে বৈরী প্রকৃতির কারণে। আর এতো সামান্য একটা রেইড।

তৃতীয় দিনে সিও কে নিয়ে বসলাম। আমরা কি হাল ছেড়ে দেব? 
‘প্রশ্নই আসে না’-কোর্সমেট সিও’র কণ্ঠে দৃঢ় অভিব্যক্তি। টার্গেট না পেলে, না পাবি ওদের টিলায় প্রস্রাব করে আসবি সবাই মিলে। ওদেরকে বুঝতেই হবে ‘মাইটী সিক্সার্স’ (৬, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) কি জিনিস। 

তারপর কার একটা কোটেশন ধার করে বললো- ‘If you can’t get them in bed, spoil their bed’. আর যায় কোথায়, এমনিতেই নাচুনী তার উপর ঢোলের বাড়ি। ‘বহু কষ্ট করে গিয়ে টার্গেট যদি না পাই’-এ রকম সংকোচটা গেল ঘুচে।

নাঈম আরো বলতে থাকলো- আর্মির কাছে খবর পৌঁছার পর আর্মি বসে থাকবে না- এই ম্যাসেজ দূষ্কৃতিকারীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। ‘ও কথা আমারও ছিল মনে, বেটা পারিলো পারিলো কেমনে জানিতে’- আত্মবিশ্বাস গেল বেড়ে।

সে রাতটা ছিলো পঁচিশ রমজানের। মধ্য ভাদ্রের মেঘলা আকাশটা। গুমোট গরম। রাতের খাবার খেয়ে সবাই তৈরি। উত্তমকে সাজানো হলো কম্ব্যাট ড্রেসে। যাত্রা শুরুর পূর্বে ওকে কাছে টেনে খুব কঠিনভাবে বললাম, ‘উওম এমন রাস্তায় নেবে যেন টার্গেট এলাকায় পৌঁছাতে পথ না হারাই, ওরা যেন টের না পায়, আর কোন ধরনের চালাকির আশ্রয় নিবে না’।

ওর হাতে তুলে দেওয়া হলো একটি দা। পথ চলতে জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য। শুরু হলো অপারেশন- রেইড এ্যাট নো ম্যান্স ল্যান্ড। ভাইবোনছড়া থেকে দু’ঘণ্টা চলার পর এসে হাজির হলাম প্রদীপ পাড়ায়। প্রায় আধঘণ্টা পর দেখা মিললো জাহাঙ্গীরের। তারও কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন ইমরানের দলের। এখানে আবার নিজেদের মধ্যে কিছু সমন্বয়ের পর এবং চলার ধারাবাহিকতা ঠিক করে চূড়ান্ত পথ চলা- লক্ষ্যস্থল কোনারায়পাড়া। ওখানে পৌঁছে দলগুলি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে টার্গেটে হিট করবে।

ইমরানের গ্রুপ থেকে ৬০ মিলি মিটার মর্টারের ডিটাচমেন্ট সার্জেন্ট মোজাম্মেলের নেতৃত্ব আমাদের ফায়ার সাপোর্ট দিবে যদি শত্রু আমাদের উপর আগেই ফায়ার করা শুরু করে। ইমরান টার্গেটের দক্ষিণ দিকে ব্লকিং পজিশনে থাকবে। আমি এবং জাহাঙ্গীর পাহাড় বেয়ে উঠে উত্তর থেকে দক্ষিণে চার্জ করে নামব।

চলবে...

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি