ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগিয়ে উন্নত হতে পারে দেশ’

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ২২:৩৭, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২০:২৩, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলে অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্তৃত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠারও অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ।

এ বিপুল সমুদ্র সম্পদকে ঘিরে বাংলাদেশের এ অসীম সম্ভাবনার বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম 

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমুদ্রসীমা জয়ের পর সেখানে বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

জোবায়ের আহমেদ: সমুদ্রসীমা জয়ের ফলে আমাদের জন্য আরও একটা বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা আমাদের দখলে এসেছে। সমুদ্রে যে পরিমাণ সম্ভাবনা আছে তা কল্পনার চেয়েও বেশি। সমুদ্রে প্রধানত দুই ধরণের সম্পদ আছে। প্রথমত নবায়নযোগ্য দ্বিতীয়ত খনিজ সম্পদ।

নবায়নযোগ্য সম্পদের মধ্যে আছে সমুদ্রের বাতাস, সূর্যের আলো, সমুদ্রের ঢেউ ইত্যাদি। এগুলো থেকে বিদ্যুৎসহ মানুষের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই তৈরি হতে পারে। সমুদ্রের স্রোত তো কোনদিন ফুরাবে না। তাই এখান থেকেই আসতে পারে আমাদের বৈদ্যুতিক শক্তি। আর এ ক্ষেত্রে একবার খরচ করলে দ্বিতীয়বার কোন খরচ নেই।

আর খনিজ সম্পদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তেল-গ্যাস। মূলত সমদ্রের তলদেশে লাখ লাখ বছর জমে থাকা কার্বন থেকে এসব তৈরি হচ্ছে।

এছাড়া সমুদ্রে আছে আমাদের বিশাল মৎস্য ভাণ্ডার। এসব মৎস্য আহরণের সঠিক ব্যবস্থা নিলে আমি মনে করি আমাদের বাজেট পরিমান অর্থ শুধু এ সামুদ্রিক মাছ থেকেই আসতে পারে।

এছাড়া সমুদ্রকে ঘিরে আছে আমাদের পর্যটন সম্ভাবনা। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটা জাহাজ এসেছিল পর্যটনের জন্য। জাহাজটিতে প্রায় ১২৬ জন পর্যটক ছিল। তারা ৩৫ লাখ টাকা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়। কেননা পৃথিবীব্যাপী নিয়ম আছে কোন দেশের জাহাজ অন্যদেশে ঢুকলে অর্থ দিতে হয়। এখন অন্যদেশের এমন জাহাজ যদি বাংলাদেশে ঢুকে তো হিসেব অনুযায়ী আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ৭০ লাখ টাকা যোগ হবে। কারণ জাহাজে আসা লোকগুলোর আবাসন ও খাওয়াসহ নানাবিধ খরচ আছে। তাই এ পর্যটনকে কাজে লাগাতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারি।

এছাড়া পরিবহন ক্ষেত্রেও সমুদ্রে আছে বিপুল সম্ভাবনা। পৃথিবীর প্রায় ৮০ ভাগ রফতানি-আমদানি সংক্রান্ত পরিবহন হয় সমুদ্র পথে। আমাদের দেশেও এক্ষেত্রে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। আগামি ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের রফতানি-আমদানি বর্তমানের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হবে। সমুদ্র পরিবহণ ব্যবস্থা ভালো থাকলে এসুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এ বিপুল পরিমাণ সম্পদ আহরণ ও অনুসন্ধানে দেশে কোন গবেষণা হয়েছে কী না?

জোবায়ের আহমেদ: আমাদের জানতে হবে এগুলোর উৎস্য কী, কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে কাজে লাগানো যায়। দু:খের বিষয় হলেও সত্য যে এ বিষয়ে গবেষণা তো দূরের কথা, আমাদের তেল-গ্যাস কী পরিমাণ আছে, ‍তার জন্যও দৃশ্যমান কোনো গবেষণা নেই।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এ বিষয়ে গবেষণার জন্য আমাদের সক্ষমতা কতটুকু আছে?

জোবায়ের আহমেদ: নতুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান বিষয়ক বিভাগ খোলা হয়েছে। এবিষয়ে যারা পড়াশোনা করছে তারা আসলে এখনও সে পর্যায়ে যায়নি। আর আমরা যারা প্রশিক্ষক তাদের অনেকেই সে বিষয়ে লেখা-পড়া নেই। এক একজন এক এক বিষয় নিয়ে পড়েছি। এখন আমাদের পড়ে নিতে হচ্ছে। আগামী ২০-৩০ বছর পর হয়তো বলা যাবে আমাদের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: গবেষণা পর্যায়ে আমাদের পিছিয়ে থাকার কারণ কী?

জোবায়ের আহমেদ: গবেষণা পর্যায়ে আমাদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ হচ্ছে, আমাদের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এ বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কী কী প্রয়োজন হতে পারে?

জোবায়ের আহমেদ: সমুদ্র নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবা শুরু করেছি। আগে তো ভাবনাটা সেইভাবে ছিল না। কিন্তু সমুদ্র বিজয়ের পর এ বৃহৎ এলাকায় তো একটা জাহাজ দিয়ে এ গবেষণা সম্ভব না। আমাদের মৎস্য গবেষণার জন্য একটা জাহাজ, আর বায়োলজিক্যাল অনুসন্ধ্যানের জন্যই দরকার ১০টি জাহাজ।

বায়োলজিক্যাল অনুসন্ধানটা হবে সমুদ্রে কিছু আগাছার ওপর। যেমন নূরি। এটা দিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য হতে পারে। আমরা যেমন একবেলা ভাত না খেলে পারি না। তেমনি জাপানিরা এ নূরী নামের খাদ্য প্রতি বেলাতেই খায়। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানসহ অন্যান্য অনুসন্ধানী কাজের জন্য আমাদের কমপক্ষে ৩১টি জাহাজের দরকার হবে।

অথচ আমাদের তো একটাও নেই। এক্ষেত্রে জার্মান থেকে ৩ মাসের ভাড়া করা জাহাজ আনলাম। আর তারা ঘুরেফিরে গোঁজামিলের প্রতিবেদন দিয়ে চলে গেল। এভাবে আসলে হবে না। সমুদ্র থেকে কিছু পেতে হলে বিনিয়োগটা করতেই হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: গবেষণার কাজ এগিয়ে নিতে এরই মধ্যে দেশে একটি অস্থায়ী ইকোনমি সেল গঠন করা হয়েছে। যেটা স্থায়ী করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটার মাধ্যমে গবেষণা কাজের কতটুকু অগ্রগতি আশা করছেন?

জোবায়ের আহমেদ: সমুদ্র গবেষণায় টাকার অভাব আছে আমি মানতে পারি না। এক্ষেত্রে আমাদের দরকার উদ্যোগ। কিছু দিয়ে তো শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে এখন স্থায়ী ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিছুটা অগ্রগতি হয়তো হবে। তবে কথা হলো যারা ব্লু ইকোনমি বুঝেন, এটা নিয়ে ভাবেন, তাদের নিয়েই যেন এটা গঠন হয়। তাহলে বাস্তবিক অর্থে কিছুটা কাজ আশা করা যেতে পারে। তা না হলে যা, তাই-ই থেকে যাবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: গবেষণার কাজ বিদেশি কোম্পানির ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় কী না?

জোবায়ের আহমেদ: এক একটা অঞ্চল অনুসন্ধান চালাতে দরকার প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এটা বেশ বড় অঙ্কের অর্থ। তাই দেশিয় কিছু অভিজ্ঞকে রেখে বিদেশি কোম্পানির কাছে এ অনুসন্ধানের কাজ দেওয়া যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যাকে এ বিশাল দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তার সততার জায়গাটা কতটুকু স্বচ্ছ। স্বচ্ছ না হলে এ ক্ষেত্রে সরকারের বরাদ্দের সঙ্গে সঙ্গে ভাগাভাগির চিন্তা চলে আসবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: গবেষণার কাজ পিপিপি’র অধীনে করা যায় কী না?

জোবায়ের আহমেদ: এটা করতে দেশের কোন কোম্পানি এগিয়ে আসবে না। আবার আসলেও তা সরকারের জন্য সুখকর হবে না। কারণ এ অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় খরচ ছাড়া লাভ আসবে না। এ অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় প্রায় ২শ’ কোটি টাকা লাগবে। কোনো কোম্পানি আগে থেকে এমন রিস্ক নিবে না। এটা সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব না। আবার রিস্ক নিয়ে গবেষণার পর ফলাফল ভালো হলে যে সম্পদ আসবে তা আবার সরকার চাইবে না কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে দিতে। সেক্ষেত্রে মনে হয় না ওইভাবে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: গবেষণায় এগিয়ে যেতে কোন কোন দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে?

জোবায়ের আহমেদ: আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজ উদ্যোগে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এমওইউ চুক্তি করে একটি অশান সেন্টার করেছি। তবে এটার কোনো রুম নেই। আমরা নিজস্ব রুমে বসে এটার কার্যক্রম চালাই। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় অশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে এটার আলাদা একটা ফ্যাকালটি আছে। ওরা আমাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে ইনফরমেশন সেন্টার ফর ওশান গভর্নমেন্ট নামে। আমরা গবেষণার বিষয় জানতে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসি। এ দেশগুলো ছাড়াও মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে পারি।

 

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: উন্নত দেশগুলো সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগাতে কেমন সময় নিয়েছে?

উন্নত দেশগুলো যে দুই দশ বছরে উন্নতি করেছে তা কিন্তু নয়। আমরা সবে শুরু করলাম। গবেষণা ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সময় নেই। তবে কোনো দেশেই ২০ থেকে ৩০ বছরের আগে হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। উন্নত দেশগুলো গবেষণা করেছে, এখন তাদের দেখে আমাদের গবেষণা সহজ হবে। সে অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোর ৩০ বছর লাগলে আমাদের ১০ বছর লাগার কথা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সমুদ্র বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের দেশে কোথায় কোথায় অধ্যয়নের সুযোগ আছে?

জোবায়ের আহমেদ: সমুদ্র বিজ্ঞান নিয়ে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে একটি বিভাগ আছে। প্রায় ৪৫ বছর থেকে এ বিভাগ চলছে। বিভাগটিতে মূলত সমুদ্রের মৎস্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। মেরিন সায়েন্স এন্ড ফিসারিস পড়ানো হয় বিভাগটিতে। তারা ফিসারিস পড়ালেও এখনও পর্যন্ত সমুদ্র থেকে যে পরিমাণ মাছ আহরণের কথা আমাদের তার ধারে কাছে কিন্তু আমরা নেই। হয়তো এ বিভাগগুলো সরকারকে সেভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগটি-ই প্রথম বিভাগ। যারা তেল, গ্যাসের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে এ বিভাগে আমরা-ই কেবল শুরু করলাম। এছাড়া বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান চলছে। সিলেট ও নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়েও গত বছর থেকে এ বিষয়ে পাঠদান চলছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এ বিষয়ে পাঠদানে নতুন এ বিভাগটি কতটুকু গুছিয়ে উঠতে পেরেছে?

জোবায়ের আহমেদ: বিভাগটির পাঠদান সক্ষমতা অর্জনে যথেষ্ট সহায়তা আমরা পাচ্ছি না। আমাদের কতকগুলো ল্যাব দরকার, ক্লাসরুম দরকার, আমাদের জায়গার বড় সংকট। মাত্র ৩টা ক্লাস রুম নিয়ে আমাদের এ লেখা-পড়া চলে। ল্যাবে পর্যাপ্ত যন্ত্রাংশ নেই। আমাদের কোনো নতুন শিক্ষকদের বসার জায়গা নেই। অথচ গবেষণার জন্য এগুলো খুব দরকার। আর এ গবেষণার জন্য আমাদের চট্টগ্রামে একটি গবেষণাগার দরকার। আমরা কক্সবাজারে একটি গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।  আমাদের বিভাগে ২০ জন শিক্ষক, একটি ফ্লোর, ৫টি ল্যাব পেলে ৫ বছরে সমুদ্র থেকে আমরা ফলাফল দেব। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা হলে এটা অবশ্যই সম্ভব।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

জোবায়ের আহমেদ: আপনাকে ও একুশে টেলিভিশন পরিবারকে ধন্যবাদ।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি