ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্বাস সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করে

প্রকাশিত : ২০:৩২, ১০ এপ্রিল ২০১৯ | আপডেট: ২০:৩৭, ১০ এপ্রিল ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

একজন মানুষের আসল শক্তি তার হাত নয়, পা নয়, দেহ নয়, তা হচ্ছে মন। যিনি এই মনের শক্তিকে অনুভব করতে পারেন এবং তা বিশ্বাস করতে পারেন, তিনি তার প্রতিটি চাওয়াকে পাওয়ায় রূপান্তরিত করতে পারেন। যদিও আজ পর্যন্ত মনকে দেখা যায় নি, ধরা যায় নি, ছোঁয়া যায় নি। কোনো বিজ্ঞানী একে টেস্টটিউবে নিয়ে গিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন নি। তেমনি বিশ্বাসকেও ধরা-ছোঁয়া যায় না, একে নিয়ে গবেষণা করা যায় না। কিন্তু মনের শক্তির ওপর বিশ্বাসের প্রকাশ যখন ঘটে, তখন একজন মানুষ বলেন, আমি পারি, আমি পারব। ছোট্ট কথা, কিন্তু এ কথাটিই যখন কাজে রূপ নিয়েছে তখন তা যুগে যুগে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘আমি পারব’এই দৃঢ় বিশ্বাসই সকল সাফল্যের ভিত্তি। আর পারব বলে বিশ্বাস করলে যে অবশ্যই পারা যায়, তার বাস্তব উদাহরণ রয়েছে অগণিত। বিজ্ঞান বলি, শিল্প বলি, সাহিত্য বলি, নিরাময় বলি, প্রাচুর্য বলি, খেলা বলি সবক্ষেত্রেই রয়েছে বিশ্বাসের বিজয়ের উদাহরণ।

গত ৩ মার্চ দৈনিক প্রথম আলো-র স্বপ্ন নিয়ে-তে চারো চার চারজন নিয়ে একটি দারুণ সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে সিজিপিএ চারে চার পেয়ে যে চার জন মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন তাদের নিয়েই ছিল সাক্ষাতকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলে এই চার জনের একটি বারের জন্যেও ফোর মিস হয় নি। অথচ চারটি বছরে চার জন যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা যে-কোনো শিক্ষার্থীর জীবনকে টালমাটাল করে দিতে পারে। কিন্তু তারা কেউ হাল ছাড়েন নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে মেয়েটি ফোর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্বর্ণপদক নিচ্ছিলেন, তিনি সেদিন বার বার চোখ মুছে প্রয়াত বাবাকে বলছিলেন যে, তুমি খুশি হয়েছ তো বাবা? কারণ, ভর্তিযুদ্ধে আর কোথাও চান্স না পেয়ে মেয়েটি বাধ্য হয়ে যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, জেদ চেপে গেল মনে। ভাবলেন পরের বছর আবার ভর্তি পরীক্ষা দেবেন। কিন্তু বাবা বললেন যে, না, এখানেই এমনভাবে পড়ো যেন তুমি শিক্ষক হতে পারো। শেষ বর্ষে যখন তিনি, বাবা ক্যান্সারের সাথে লড়াইয়ে হেরে যান। সেদিন মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে এই প্রতিজ্ঞাই করেছিলেন যে, বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না, ঠিক আছে, বাবার স্বপ্নটা তো বাঁচাতে পারি। শুরু করলেন প্রস্তুতি। প্রচণ্ড চড়াই, উতরাই। তারপর একসময় সেই ফলাফল পেলেন এবং শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। 

যে ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি থেকে স্নাতকে সিজিপিএ-৪ পেয়েছেন, তিনি আক্রান্ত এক বিরল এবং জটিল রোগে। প্রথম বর্ষে যখন ভর্তি হয়েছেন, তখনই ধরা পড়ে মায়াস্থেনিয়া গ্রাভিস নামক রোগটি তার দেহে দানা বেঁধেছে। দেশের বাইরে গিয়ে অপারেশন করিয়ে ক্লাসে আসতে আসতে ততদিনে ১৭ দিন পার হয়ে গেছে। এ রোগের কারণে তিনি সবসময় ডাবল ভিশন (দুটি প্রতিবিম্ব) দেখতে পান। শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও তার কম। প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’ তার বলার কথা। কিন্তু তিনি নিজেকে ক্লান্ত হতে দেন না। পরীক্ষার ফলাফলে কোনো ছাড় না দিয়েই পাশাপাশি যুক্ত থেকেছেন আরো অনেক কাজে। বায়োলজি অলিম্পিয়াড, গণিত অলিম্পিয়াড একাডেমিক দলে কাজ করেছেন। ৩৩টি দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ১০ দিনের ক্যাম্পে অংশ নিতে থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে। এখন আরো কাজ, আরো স্বপ্ন দেখে এগোচ্ছেন সামনে।

সবচেয়ে চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ফোর অর্জন করা মেয়েটি। আর্থিক সংকটের কারণে চাকরি নিয়েছেন প্রথম বর্ষেই। চাকরি, ক্লাস-এত কাজের চাপে পড়তেন কখন? এর উত্তরে তিনি ধন্যবাদ দিয়েছেন ঢাকার যানজটকে। কারণ অফিস থেকে ক্লাসে আসতে তাকে তুরাগ বাসে উঠতে হতো। বাস যখন জ্যামে দাঁড়িয়ে তখনই পড়াগুলো একে একে সেরে ফেলতেন। সবার যেখানে স্নাতক শেষ করতে চার বছর লাগে, তার লেগেছিল সাড়ে তিন বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সাতটি সেমিস্টারে ফি দিলেও তারপর থেকে একটি টাকাও খরচ হয় নি। কারণ চমৎকার ফলাফলের কারণে তিনি ফুল স্কলারশিপ পেয়েছিলেন।

ব্যর্থ মানুষেরা নেতিবাচক মানসিকতা পোষণ করে। তারা বিশ্বাসই করতে পারে না যে, বড় কিছু করার জন্যে তাদের জন্ম হয়েছে। একবার ব্যর্থ হলে তারা আরো মুষড়ে পড়ে। তারা সবসময় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সন্দেহ-সংশয়ে ভোগে। আর সফল মানুষেরা ইতিবাচক চিন্তা-চেতনার অধিকারী। শত প্রতিকূলতার মাঝে নিজ বিশ্বাসে অটল থাকে। চারপাশের মানুষ কে কী বলল না বলল সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তারা নিজের লক্ষ্য এবং কাজের প্রতি বেশি মনোযোগী থাকেন। তারা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করেন না, নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই রচনা করেন। ব্যর্থতা তাদের সম্ভাবনাকে আরো ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে। আপাত ব্যর্থতার ছাই থেকেই তারা সাফল্যের সোপান নির্মাণ করে ইতিহাসে স্মরণীয়-বরণীয় হন।

আসলে সফল জীবনের পথে যাত্রা শুরুর জন্যে অনেক প্রস্তুতির কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন : অর্থ-বিত্ত, বংশমর্যাদা, শান-শওকত, জ্ঞান গরিমা, ডিগ্রী-পদবি না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। যদি শুধু মুক্ত বিশ্বাস থাকে। নিউরোসায়েন্টিস্টরা গবেষণায় দেখেছেন, বিশ্বাসের প্রথম প্রভাব পড়ে মনে। মন প্রোগ্রাম পাঠায় মস্তিষ্কে। তখন মস্তিষ্কের নিউরোনে নতুন সংযোগপথ রচিত হয়। বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো। তখন মস্তিষ্ক আপনার পারার ইচ্ছাটা বাস্তবতায় রূপান্তরিত করে। সহজ স্বতঃস্ফূর্ততায় আপনি আপনার কাজ সম্পন্ন করতে পারেন।

পবিত্র কোরআনে সূরা আলে ইমরান-এর ১৩৯ আয়াতে আল্লাহ বলেছেনÑ‘(তোমরা) হতাশ হয়ো না! দুঃখ কোরো না! তোমরাই জয়ী হবে যদি বিশ্বাসী হও!’ ঋগবেদে আছে‘ বিশ্বাসীর হৃদয়েই প্রভু বসবাস করেন’। আর প্রভু যার সাথে থাকেন তার ভয় কীসে? আমাদেরও বিশ্বাস প্রথমত স্রষ্টার ওপরে, তারপরে স্রষ্টা আমাদেরকে যে মেধা ও সামর্থ্য-সম্ভাবনা দিয়েছেন তার ওপরে। যে কারণে কখনো মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আসতে নিলেও আমরা যখন বলি “শোকর আলহামদুলিল্লাহ! আমি বিশ্বাসী, আমি বিশ্বাসী, আমি বিশ্বাসী” তখন বিশ্বাসের অনুরণন আবার আমাদের মনের মধ্যে বইতে শুরু করে।

আজকের আলোচনাকে আমরা শেষ করতে পারি এইভাবে আসলে সাফল্য এবং ব্যর্থতা, রোগ এবং সুস্থতা, অশান্তি এবং প্রশান্তি এর মাঝখানে যদি কোনো দেয়াল থাকে সেটি হচ্ছে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের। বিশ্বাস সাফল্য সৃষ্টি করে, অবিশ্বাস দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, সন্দেহ, সংশয় সৃষ্টি করে; বিশ্বাস নিরাময় করে, অবিশ্বাস মানুষকে রোগগ্রস্ত করে তোলে, অসুস্থ করে তোলে। বিশ্বাস প্রশান্তি দেয়, আর অবিশ্বাস অশান্তি সৃষ্টি করে। তবে এ বিশ্বাস হতে হবে সন্দেহ-সংশয় থেকে মুক্ত বিশ্বাস, এ বিশ্বাস হতে হবে দ্বিধা-ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত বিশ্বাস, এ বিশ্বাস হতে হবে নেতিবাচকতা থেকে মুক্ত বিশ্বাস, এ বিশ্বাস হতে হবে ভয় ও আশঙ্কা থেকে মুক্ত বিশ্বাস। তাহলেই যুগে যুগে কালে কালে যারা সফল হয়েছেন, স্মরণীয় হয়েছেন, বরণীয় হয়েছেন তাদের মতো আমরাও বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সফল হবো, সুস্থ থাকব, প্রশন্তি পাবো।


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি