ঢাকা, বুধবার   ০৬ নভেম্বর ২০২৪

‘কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে?’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ২২:২৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

সাম্প্রতিক সময়ে সতীর্থ ৬৯-এর বন্ধুরা আমাদের সময়ের নানান সাদা-কালো ছবি অবয়বপত্রে দিয়ে সে সময়টাকে প্রতিফলিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। সেগুলো দেখে আমাদের উত্তরসূরীরা নানানভাবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যদি কিছু মনে না করেন, তাঁদেরকে ক’টা কথা কইতে চাই।

প্রথমত: সে সব ছবি দেখে অভিভূত হয়েছেন অনেকে। নানান মন্তব্য করেছেন - ‘কি সুন্দর ছিলেন আপনারা’, ‘আহা, কি সোনালী সেই সব দিন ছিল!’, ‘কেন যে আমি আপনাদের কালে জন্মাই নি’। খুশী হয়ে যাওয়ার মতো মন্তব্য সব। আপনাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দেই, আমার এই সব সতীর্থ এক একটি আগুনের ফুলকি - আন্দোলন করেছেন নানান নিমিত্তের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, সংগ্রাম করেছেন কতগুলো সুনন্দ মূল্যবোধ স্থাপনার জন্যে, লড়েছেন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যে। সুতরাং অনুগ্রহ করে শুধুমাত্র তাঁদের সৌন্দর্য্যের প্রশংসায় নিজেদের আবদ্ধ রাখবেন না, শুধুমাত্র সেই অতীতের হিরণ্ময়তা নিয়ে হাহাকার করবেন না। ছবিগুলোর গভীরতর মূল্যবোধগুলো সামনে নিয়ে আসুন, এইসব মানুষগুলোর নিষ্ঠা ও বিশ্বাসগুলোকে উপলব্ধি করুন এবং সেগুলো থেকে শক্তি নিয়ে সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হোন। আপনাদের কালেও সোনালী দিন সম্ভব এবং দিনবদলের চাবিকাঠি আপনাদেরই হাতে।

দ্বিতীয়ত: যখনই কোন পরিবর্তনের কথা তুলে ধরি, তখনই দু’টো প্রশ্ন পাই - ‘কেন হলো, স্যার?’ এবং ‘সমাধান কি, বলে দিন আমাদের।’ এমন কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন- ‘আপনাদের কি মনে হয়?’ আপনারা চিন্তা করা এড়াতে পারবেন না, অন্য কেউ আপনাদের জন্যে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আসবেনা, সে সব প্রশ্নের উত্তর আপনাদেরই বার করতে হবে। মনে রাখবেন, মানুষ সবচেয়ে বেশী নির্ভর করতে পারে তাঁর নিজের ওপরে এবং আপনাদেরও নির্ভর করতে হবে নিজেদের ওপরে। সমাধানের কথা পূর্বসূরীদের কাছে জিজ্ঞেস করা অর্থহীন - আগামী কালের সমাধান গতকালের মানুষ দিতে পারে না। আপনাদের জাতির বর্তমান হতে অনুরোধ করছি, অনুগ্রহ করে জাতির ভবিষ্যত হয়ে থাকবেন না।

চিত্র কৃতজ্ঞতা: হাসিব সুমন

তৃতীয়ত: কোন বিষয়ের অবতারণা করলে আপনাদের অনেকেই কেবল সমস্যার কথা বলেন এবং ‘কিছুই করা যাবে না’ বলে হতাশ হয়ে পড়েন। শুধু ‘সমস্যার’ ভাঙ্গা রেকর্ড না হয়ে ‘সমাধানের’ মুখপাত্র হোন। হতাশার রাষ্ট্রদূত হবেন না - নিরাশার কোন ইতিবাচক দিক নেই। হতাশা একটি সংক্রামক ব্যধি এবং হতাশ মানুষ দিয়ে পৃথিবীর কোন বড় কাজ হয়নি।

চতুর্থত: আপনাদের অনেকেই আমাদের প্রজন্মকে বলেন, ‘আপনারা এগিয়ে যান স্যার আমরা আছি আমাদের সঙ্গে’। না, আপনারা নেই। আপনাদের সাথে থাকার কথা নয়, আপনাদের সামনে থাকার কথা। সংগ্রামের দায়িত্ব আপনাদের, নেতৃত্বও আপনাদের - আপনারাই পথ দেখাবেন। জীবনের প্রান্ত সীমায় উপনীত হওয়া মানুষদের এগিয়ে নিতে পারবে না, এগিয়ে যেতেও পারবে না- তাঁদের যা করার, তাঁরা তা করেছে তাঁদের কালে।

পঞ্চমত: অবয়বরত্রে লেখালেখি করেই আপনার দায়িত্ব পালিত হয়ে গেছে বলে মনে করবেন না। তরুণ সমাজের এমন নিস্পৃহতার কারণে ট্রাম্পের মতো মানুষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন এবং ব্রেক্সিট সম্ভব হয়েছে। খুঁজে বার করুন, কার্যকর আর কি কি পন্থা আছে, যার মাধ্যমে অপ:শক্তিকে রোখা যায়। না, আমাদের জিজ্ঞেস করবেন না। নিজেদের মধ্যে আলাপ করুন, একে অন্যের সঙ্গে সংযোগ ঘটান, পথ পেয়ে যাবেন।

শেষের কথা বলি। অনেক তেতো কথা বলেছি আপনাদের। ক্ষমা করবেন। আমরা না বললে কারা বলবে এবং এখনই না বললে কখন বলবো। বড় সৎভাবে কথা ক’টি আপনাদের বলতে চেয়েছি। সব সময়েই মনে রাখবেন, সততা এমন একটি উপহার যা আপনাদের সত্যিকারের শুভাকাঙ্খী একজন মানুষই আপনাদের দিতে পারে।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি