ঢাকা, শনিবার   ১০ মে ২০২৫

ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয়ে উপেক্ষিত শিক্ষা খাত

প্রকাশিত : ১৫:০০, ২৭ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১০:৫৪, ২৮ মার্চ ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

ব্যাংকগুলোকে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) সবচেয়ে বেশি ব্যয় শিক্ষা খাতে করার নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু গত ছয় মাসে ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয়ে উপেক্ষিত হয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া সেই খাতটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা উপেক্ষিত হওয়ায় চ্যালেঞ্জে পড়ছে দেশকে উন্নয়নশীলের কাতারে নেওয়ার চেষ্টা। কেননা দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উত্তরণের তিন সূচকের মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়ন অন্যতম। আর মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপসূচক হচ্ছে শিক্ষা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ব্যাংকগুলোকে তাদের সিএসআর খাতের মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ শিক্ষা খাতে, ২০ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে এবং ১০ শতাংশ জলবায়ু ঝুঁকি বা দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। দেখা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকগুলো বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ খাতে তাদের মোট ব্যয়ের অর্ধেকও বেশি ব্যয় করেছে। এতে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থ বছরের প্রথম ষান্মাসিকে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪১৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা সিএসআর ব্যয় করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। যার মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয় করা হয়েছে। এ খাতে ২৩৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। যা মোট ব্যয়ের ৫৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তফসিলী ব্যাংকগুলোর সিএসআর খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় ছিল শিক্ষা খাতে, এ খাতে মোট ৭৬ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। যা মোট ব্যয়ের মাত্র ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংকসমূহের সিএসআর খাতে উল্লেখযোগ্য ব্যয়ের খাতসমূহের মধ্যে ছিল অন্যান্য খাতে ৬১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা (১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ), স্বাস্থ্য খাতে ২২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা (৫ দশমিক ৪৫), সংস্কৃতি খাতে ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা (৩ দশমিক ৩২ শতাংশ) এবং পরিবেশবান্ধব খাতে টাকা ৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা (১ দশমিক ৬৩ শতাংশ)। আলোচ্য সময়ে তফসিলী ব্যাংকগুলোর সিএসআর খাতে ব্যয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতে টাকা এক কোটি ২২ লাখ টাকা, আয় বর্ধক কর্মসূচীতে ৩২ লাখ টাকা ব্যয় হয়।

তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বেশি ব্যয় বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলোচ্য সময়ে মূলত দেশে স্মরণকালের তীব্র শীত থাকায় শীতার্ত জনগণের কষ্ট নিবারণের উদ্দেশ্যে নিজস্ব উদ্যোগে বা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের মাধ্যমে শীতবস্ত্র বিতরণের লক্ষ্যে অনুদান প্রদানের উদ্দেশ্যে এ খাতে সিএসআর ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছিল। তাছাড়া উত্তরাঞ্চলের বন্যাদূর্গত অঞ্চলে সহায়তা ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদান করায় উক্ত ষান্মাসিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে সিএসআর ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য ছিল।

এদিকে ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উপেক্ষিত হওয়া এবং ব্যয়ের বেশিরভাগ দূর্যোগ মোকাবেলায় চলে যাওয়ার বিষয়টি চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশকে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণ প্রচেষ্টায়। কেননা এলডিসি উত্তীর্ণের জন্য নির্দিষ্ট তিনটি সূচকে ভালো করতে হবে বাংলাদেশকে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসক) এর মানদণ্ড অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মানবসম্পদ সূচকে ৬৪ পয়েন্টের প্রয়োজন; বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭২। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশ নূন্যতম সূচকের উপরে অবস্থান করছে তথাপি উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিতে আগামী ছয় বছর বাংলাদেশকে পর‌্যবেক্ষণে রাখবে ইকোসক। ২০২৪ সাল পর‌্যন্ত দুই মেয়াদে পর‌্যবেক্ষণকালে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হবে। সেগুলো হচ্ছে- মাথাপিছু গড় আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। এর মধ্যে মানবসম্পদ সূচকে ভালো করতে হলে শিক্ষার হার বাড়াতে হবে, ঝড়ে পড়া কমাতে হবে। সেজন্য শিক্ষা খাতে সিএসআর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর সিএসআর যদি বেশিরভাগ প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা অন্য খাতে চলে যায়, সেক্ষেত্রে মানবসম্পদ সূচকের প্রধান উপসূচক শিক্ষা পিছিয়ে পড়তে পারে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মাবনসম্পদ সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ সূচকটি আরো এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাত সর্বাধিক গুরুত্ব রাখে। আর বেসরকারি খাতের অন্যতম খাত ব্যাংকিং খাত। এখন তাদের সিএসআর যদি দুর্যোগ মোকাবেলায় চলে যায় তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্ব কমে যাবে এটা স্বাভাবিক। আবার দূর্যোগ প্রবণ এই দেশে বিপর্যয় একেবারেই হবে না তাও প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। তাই সরকারের উচিত হবে শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও গুরুত্ব দেওয়া। ব্যাংকগুলোকেও এ ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানোর জন্য তাগিত দেওয়া। সেক্ষেত্রে দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষগুলোর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে উৎপাদনের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসা।

এদিকে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের প্রতিবছরের মতো গত বছর ‘গ্লোবাল হিউম্যন ক্যাপিটাল রিপোর্ট-২০১৭ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে মানব সম্পদ উন্নয়নের সূচকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ১৩০টি দেশের মধ্যে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এ বছর নেমে এসেছে ১১১তম অবস্থানে। গতবছর বাংলাদেশ ছিলো ১০৪তম। দুই বছর আগে ২০১৫ সালেও ৯৯তম অবস্থানে ছিলো বাংলাদেশ। ।

 প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষা খাতে দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার মান খুবই দুর্বল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষার মান ভালো মনে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা অনেক নিম্নমানের। খুব স্বল্প বিষয়ে এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া কর্মসংস্থান উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে বড় ফারাক রয়েছে। এই সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, ভারত ও নেপাল। বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে রয়েছে শুধু পাকিস্তান। সূচকে ভারত ১০৩তম অবস্থানে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলংকা ৭০তম। এছাড়া নেপাল রয়েছে ৯৮তম অবস্থানে। বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান ১২৫তম অবস্থানে।

শিক্ষার মান ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম  বলেন, এ কথা ঠিক যে আমাদের অর্থনীতি যে হারে বিকশিত হচ্ছে সে হারে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না। তাছাড়া বাজার চাহিদাভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেলেও এটি চাহিদা মেটাতে পারছে না। সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর্মসংস্থান উপযোগী শিক্ষা ছাড়াও দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রয়েছে। তাছাড়া কোন্ কোন্ খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে তা নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

 মূলত জনসংখ্যার সঙ্গে সাক্ষরতার হার, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষাসহ কারিগরি শিক্ষার বর্তমান অবস্থার বিভিন্ন দিক ছাড়াও কর্মসংস্থান উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা এবং দক্ষতার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এই সূচক তৈরি করা হয়েছে। একটি দেশের মানব সম্পদের পরিস্থিতি নিয়ে নীতি নির্ধারকদের ধারণা দেওয়া এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে নিজেদের অবস্থা তুলনা করতে এই সূচক সাহায্য করবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে গত এক প্রজন্ম ধরে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে জনসংখ্যা বিবেচনায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শিক্ষা ও দক্ষতা পরিস্থিতি অনেক নিচে রয়েছে। দুদেশেরই কর্মসংস্থানে নারী-পুরুষ ব্যবধান অনেক বেশি। ভারত এক্ষেত্রে শিক্ষার মানে অনেক এগিয়ে রয়েছে।

 শূন্য থেকে একশ’ পর্যন্ত স্কোর দিয়ে এই সূচকটি তৈরি করা হয়েছে। যে দেশ একশ’র যত কাছাকাছি সেদেশ ততটা এগিয়ে রয়েছে। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৫১ দশমিক ৭৫, তুলনামূলক কম স্কোর রয়েছে দক্ষতার উন্নয়নে। সূচকে সর্বোচ্চ ৭৭.১২ স্কোর নিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে নরওয়ে। এর পরে রয়েছে ফিনল্যন্ড, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, স্লোভেনিয়া, অস্ট্রিয়া, সিঙ্গাপুর, এস্তোনিয়া, নেদারল্যান্ড, কানাডা, বেলজিয়াম, রাশিয়া, জাপান, ইসরাইল। সূচকে মালয়েশিয়া রয়েছে ৩৩তম অবস্থানে, ভিয়েতনাম ৬৪, কেনিয়া ৭৮, মিয়ানমার ৮৯তম অবস্থানে। বাংলাদেশের পরেই রয়েছে আফ্রিকার আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মোজাম্বিক, সিয়েরালিয়নের মতো দেশ।

আরকে// এআর


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি