ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভেলোর টিপু সুলতানের দুর্গ যেখানে লেগে আছে রক্তের দাগ

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ১৮:১৪, ১৮ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১৮:২৮, ১৮ আগস্ট ২০১৯

চেন্নাই থেকে ১৪৫ কিমি দূরে চার পাশে পাহাড় বেষ্টিত ছোট্ট শহর ভেলোর। এই শহরেই ১৯০০ সালে গড়ে তোলা হয় সিএমসি (ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ) নামক হসপিটাল। যাকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা যায়। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষ জীবন বাঁচাতে ছুটে আসে এই হাসপাতালে। এর পাশেই রয়েছে বিয়োগান্তক ঘটনার এক মহান নায়ক টিপু সুলতানের দুর্গ। যেখানে তার পরিবারের রক্তের দাগ লেগে আছে। ইংরেজরা এই বীরকে হত্যার পর তার পরিবারকে এই দুর্গে নিয়ে এসে বন্দি করে রাখে। পরবর্তীতে অনেককে এখানে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়।

যারা দূর দূরান্ত থেকে এই শহরে চিকিৎসা নিতে আসেন তারা অন্তত একবার হলেও জায়গাটি ঘুরে যান। ভাতিজার চিকিৎসার জন্য আমিও সিএমসিতে এলাম। এখানে আসার পর দুর্গটি দেখার জন্য মন চটপট করতে লাগলো। ডাক্তার দেখানোর পর তৃতীয় দিন দুর্গ পরিদর্শনের সুযোগ এলো। আমি আসিফ ভাই (মাকে নিয়ে সিএমসিতে এসেছেন) আর ছোট ভাতিজা আবদুল্লাকে নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে দুর্গটি দেখতে গেলাম। সিএমসি থেকে হেঁটে গেলে সময় লাগে মাত্র বিশ মিনিট। আর অটোতে গেলে পঞ্চাশ রুপি গুনতে হয়।

দুর্গটি দেখতে দৃষ্টিনন্দন। দুর্গে প্রবেশ করতেই পড়ে পাথরের তৈরি ফটক। ভেতরে একপাশে রয়েছে বিশাল আকারের জলকণ্টেশ্বর মন্দির; যেখানে এখনো পূজা অর্চনা হয়। মন্দিরটির সামনে গিয়ে অবাক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কিভাবে এতবড় একটি মন্দির এত নকশা করে তৈরি করা হয়েছে, ভাবতে গেলে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মূলত এই দুর্গটি স্থাপন করেছিলেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজা বিজয়নগর। অসংখ্য দেব দেবীর প্রতিকৃতি পাথরে খোদাই করে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী বয়ে গেলেও সবকিছু এখনো অক্ষত রয়ে গেছে। মন্দিরের ভেতরের আঙ্গিনায় ছোট ছোট আরও অসংখ্য মূর্তি রয়েছে। পুরনো আমলের আরাধনার স্থান ও বৈঠক খানার রং ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও শিল্পীর সুনিপুণ আঁচড় ভাবনার যোগান দেয়। আমরা ঘুরে ঘুরে পুরো মন্দিরের স্থাপত্যশৈলি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম চারশ বছর আগেও শিল্পচর্চায় তারা কত অগ্রগামী ছিল।

                                                        জলকণ্টেশ্বর মন্দির, নির্মাণ ১৫৬৬ সাল

মন্দির থেকে বের হয়ে হেঁটে একটু সামনে গেলেই দেখতে পাই খ্রিস্টানদের একটি গীর্জা। জানা যায়, বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত অসংখ্যা সৈনিকদের গীর্জার পাশেই সমাহিত করা হয়। এর পাশেই রয়েছে সরকারি অফিস। অন্যপাশে রয়েছে টিপু সুলতানের সময়ে করা পাথরের তৈরি একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। তবে গত দশ বছর ধরে মসজিদটি বন্ধ রয়েছে। পাহারায় থাকা একজন সিপাহীর কাছে মসজিদটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ঝামেলা এড়ানোর জন্য মসজিদটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।' তবে মসজিদ বন্ধ করার পর এ অঞ্চলের মানুষেরা রাস্তায় নেমে আসে। তারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুর রহমান বলেন, 'হাজার হাজার মানুষ রাস্তা বন্ধ করে মসজিদ খুলে দেওয়ার জন্য প্রতিবাদ করে। গন্ডগোলের ভয়ে কেন্দ্র থেকে খুলে দিতে বললেও স্থানীয়রা রাজি না হওয়ায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।' দুর্গের মধ্যভাগে রয়েছে গোল আকৃতির একটি খোলা মাঠ। যেখানে সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হতো। 

এছাড়া দুর্গের চারপাশে রয়েছে বিশাল আকারের পরিখা। যা ৬০ থেকে ১২০ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ত। এর দৈর্ঘ্য ২:৬৫ কিমি। শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতেই এই পরিখা খনন করা হয়। পাথর দিয়ে তৈরি সুউচ্চ দেয়ালগুলো এতটাই মজবুত যে সামান্যতমও ক্ষয়ে যায়নি। বছরের পর বছর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুর্গের চারপাশে রয়েছে চারটি ওয়াচ টাওয়ার। এর মাধ্যমে ওই সময় শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করা হতো। সিঁডি বেয়ে দেয়ালের উপরে উঠলে পুরো দুর্গটি এক নজরে দেখা যায়। আমরা ওয়াচ টাওয়ারে উঠে চার পাশের স্থাপত্যশৈলি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রতিদিন শত শত মানুষ দুর্গ দর্শন ও মুক্ত বায়ু সেবনে এখানে এসে থাকেন। দুর্গের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য নিম গাছ আর পরিখার স্বচ্ছ হিম শীতল বাতাস যা মানুষের অন্তরকে ঠান্ডা করে।

দুর্গের পশ্চিম পাশে কয়েকটি কামান তাক করা রয়েছে। জং ধরা কামানগুলো পুরনো ইতিহাসকে স্বরণ করিয়ে দেয়। কামানগুলোর উপর আলতো করে হাত বুলালাম। এক সময় টিপু সুলতানের ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে কেঁপে উঠতো পুরো এই অঞ্চলের মাটি। এখন সেখানে পড়ে আছে খন্ড খন্ড তার কিছু স্মৃতি চিহ্ন।

ইতিহাস এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, টিপু সুলতান ছিলেন মহীশূর রাজ্যের শাসনকর্তা। বাবা হায়দার আলীর মৃত্যুর পর ১৭৮২ সালে তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তার বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতার কারণে শের-ই-মহীশূর বা মহীশূরের বাঘ নামে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। ইংরেজরাই তাকে এই উপাধি দেয়। শত্রুর মোকাবিলায় তিনি বিশ্বের প্রথম রকেট আর্টিলারি এবং বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করেছিলেন।

টিপু সুলতান মূলত বেঙ্গালুরের শ্রীরঙ্গপত্তনম অঞ্চলের একটি দূর্গ থেকে রাজ্য শাসন করতেন৷ তার একপাশে বয়ে গেছে কাবেরী নদী। বর্তমানে সেটি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলায় অবস্থিত। যেখানে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তার গড়ে তোলা রাজপ্রাসাদ।

এখান থেকেই বিভিন্ন জায়গায় তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। তার ভয়ে ওই সময় বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খেত। যেখানে অন্যায় সেখানে টিপুর তলোয়ার গিয়ে ব্র্যঘ্রের মতো হাজির হতো। ইংরেজদের জন্য তিনি ছিলেন ঝমের মতো। টিপু সুলতানের একটি প্রবাদ বিখ্যাত হয়ে আছে-

তিনি বলতেন, 'ভেড়া বা শিয়ালের মতো দু'শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু'দিন বেঁচে থাকাও ভালো'

তাই তো তার পোশাক আশাক সব কিছুতে বাঘের চিহ্ন পাওয়া যেত। টিপু সুলতানের বাবা হায়দার আলী ছোটবেলা থেকেই তাকে বাঘের গল্প শুনাতেন। তারপর কিশোর বয়সে তিনি বাঘ পোষা শুরু করলেন। জানা যায়, টিপু সুলতান ক্ষমতায় আসার পর ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ কারিগরদেরকে দিয়ে কাঠের ফ্রেমের উপর সোনার পাত বসিয়ে তার উপর মণিমুক্তা ও রত্নখচিত একটি সিংহাসন তৈরি করেন। আসনের ঠিক মধ্যখানে তিনি একটি বাঘ বসিয়ে দেন। এটাকে "ব্যাঘ্রাসন"ই বলা যায়। এরপর আট ফুট চওড়া আসনটিতে স্থাপন করা হয় আটটি বাঘের মাথা। এছাড়া পুরো সিংহাসনটি বাঘের ডোরাকাটা ছোপ দিয়ে তৈরি করা হয়।

বাঘের মতো ক্ষীপ্র হওয়ার কারনেই ইংরেজরা তাকে ভিষন ভয় করতেন। ভেলোরের দুর্গের মতো তিনি এরকম অসংখ্য অঞ্চল জয় করে নিজের পতাকা উড়িয়ে ছিলেন। তবে এই দুর্গে তার পরিবারের লোকজনকে বন্দি করার কারণেই বিখ্যাত হয়ে আছে।

ভেলোর টিপু সুলতানের দুর্গের মসজিদের সন্নিকটে একটি ছোট্ট জাদুঘর রয়েছে। আমরা পশ্চিম পাশ থেকে হেঁটে পূর্ব পাশে জাদুঘরটি দেখতে গেলাম। টিকিটের মূল্য একশ রুপি আর ভারতীয় হলে দশ রুপি। সেখানে ইতিহাসের কিছু চিহ্ন সংরক্ষিত আছে। রয়েছে নানা ধরণের মূর্তি ও টিপু সুলতানের যুদ্ধাস্ত্র। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন তার গায়েও ছিলো ডোরাকাটা দাগ এবং হাতলে খোদাই করা বাঘের মূর্তি। তার পোশাক, ব্যবহৃত রুমালও ছিলো বাঘের মতো ডোরাকাটা। তার যুদ্ধাস্ত্রে ভেসে উঠে বাঘের প্রতিচ্ছবি।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, টিপু সুলতান জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত এভাবে বাঘের মতোই লড়াই করে নিজের জীবন দিয়েছেন। তাকে ভারতের স্বাধীনতাকামিদের প্রতিক বলা হতো। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য একমাত্র তিনিই অবশিষ্ট ছিলেন। তাই ভারত দখলে বার বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ইংরেজরা আশ্রয় নেয় কূটকৌশলের। নিজ সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাস ঘাতকতায় অবশেষে ভারতের সূর্যের শেষ আলোটা ১৭৯৯ সালে চিরতরে নিভে যায়। আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় পুরো ভারত বর্ষ।

টিপু সুলতান নিহত হওয়ার পর ইংরেজরা চরম হত্যা যজ্ঞের মাধ্যমে হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি করে। চারিদিকে ব্যাপক লুণ্ঠন চালায়। যা বিভিন্ন ঐতিহাসিকের লেখনীতে উঠে আসে। ভগবান এস গিদোয়ানী তার 'দি সোর্ড অব টিপু সুলতান' বইতে উল্লেখ করেন, ওই সময় ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের পরিচালক রিচার্ড ওয়েলেসলি ‘মহীশূরের বাঘ’ টিপু সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর উল্লাস করে মন্তব্য করেন, ‘গোটা ভারতবর্ষই এখন আমাদের’। পরবর্তীতে টিপুর পরিবার, স্ত্রী সন্তানদের বন্দি করে নিয়ে আসা হয় ভেলোরের এই দুর্গে।

তবে দুর্গের কোথাও টিপু সুলতানের নাম দেখা যায় নি। অন্যান্য স্থাপত্যে সবার নাম লিপিবদ্ধ থাকলেও হারিয়ে গেছে টিপুর নাম। এ বিষয়ে একজন স্থানীয়র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানকার লোকজন এটাকে টিপু সুলতানের দুর্গ বলতে নারাজ। তারা ভেলোর ফোর্ট বলে থাকে। টিপুর নাম নিতে তাদের ঘোর আপত্তি আছে।’

টিপু সুলতানের পরিবারের লোকজনকে যেখানে বন্দি রাখার পর কারো কারো মতে অনেককে হত্যা করা হয়, (টিপু সুলতানের চার স্ত্রী এবং পনেরোটি সন্তান, আত্মীয় ও মন্ত্রী পরিষদের অনেককেই এখানে বন্দি রাখা হয়) সেই জায়গাটি কখনোই খোলা হয় না। বছরের পর বছর তালাবদ্ধই থাকে। একজন স্থানীয় জানান, 'পঞ্চাশ বছর পর একবার খোলা হয়েছিল। এরপর আর কখনো খোলা হয়নি।' টিপু সুলতানের সন্তানদের আত্বচিৎকার এসব দেয়ালের অন্ধকারে মিশে যায়। বেগম মহলের বেগমদের অশ্রু আর রক্তের স্রোতধারা যেসব পাথরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে তা আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। আমরা বেগম মহলের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কল্পনায় দেখতে পেলাম সুলতানের শিশু সন্তানগুলো জড়োসড়ো হয়ে যেন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সূর্য ডুবে গিয়েছে, চারদিকে অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকারে পথ হাতড়ে আমরাও সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। আর ভাবছিলাম এমন অন্ধকারেই হারিয়ে গেছে একটি পরিবার, একটি ইতিহাস, একটি বাঘের গর্জন।

টিপু সুলতানকে নিয়ে স্থানীয়দের মাঝেও ভিষন রকমের আবেগ কাজ করে। তারা তাকে এখনো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। দুর্গ পরিদর্শনের পর স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মাইশুর মঞ্জিলের (লজ) মালিক মোহাম্মদ আকরামের সঙ্গে নানা আলাপচারিতার মাঝে টিপু সুলতান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার নানা এখানে প্রথমে একটি বাড়ি তৈরি করেন। টিপু সুলতান যেন আমাদের থেকে হারিয়ে না যান সে জন্য এর নাম করন করেন মাইশুর মঞ্জিল নামে। টিপু সুলতানের এলাকার নামেই নাম রাখা হয়েছে। আমরা এই মহান বীরকে সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বরণ করি। 

আকরাম আরও বলেন, টিপু সুলতানের পরিবারকে বন্দি করার পর যারা মারা যায় তাদেরকে এখানে আমাদের পাশেই সমাহিত করা হয়। যেখানে সুলতানের মা, স্ত্রী, দুইকন্যাসহ অসংখ্য কবর রয়েছে। এটাকে টিপু সুলতান মসজিদ বা বড় মসজিদ বলা হয়। এখানে প্রতিবছর ওরস হয় এবং আমরা তাদেরকে আবেগ দিয়ে স্মরণ করি।

কবরের বিষয়টি জানার পর ভাবলাম একবার দেখে আসবো। পরের দিন সিএমসিতে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে আসা মীর হোসেন ভাই ও শাহজাহান ভাইসহ রওয়ানা দিলাম। সিএমসি হাসপাতালের পূর্ব পাশেই দশ মিনিটের পথ, আমরা হেঁটেই চলে গেলাম। গেট দিয়ে প্রবেশ করার পর পুরাতন আমলের স্থাপত্যে অনেকগুলো কবর দেখতে পেলাম। শুরুতেই ডান পাশে রয়েছে টিপু সুলতানের স্ত্রী বালখা বেগমের কবর। ১৮৩৪ সালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর অন্যপাশে অনেকগুলো কবর রয়েছে যারা টিপু সুলতানের জামাতা, আত্মীয় ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্য ছিলেন। এর পরেই রয়েছে টিপু সুলতানের মেয়ে ফাতেমার কবর। একেবারে শেষ প্রান্তে মসজিদের পাশে রয়েছে সুলতানের মা হায়দার আলীর স্ত্রী বাকশি বেগমের কবর। তিনি ১৮০৪ সালে মৃত্যু বরন করেন। এছাড়া মন্ত্রী আফতাব খাজা, জামাতা মির্জা হাসান রাজাসহ অনেকেই এখানে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।

                                                                    টিপু সুলতানের মা বাকশি বেগমের কবর

আমরা ঘুরে ঘুরে সুলতানের পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিচ্ছিলাম। সেখানকার একজন তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলে এর ইতিহাসের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলাম। জানা যায়, ভেলোরে রাজ পরিবারের সদস্যদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করার পর ১৮০৬ সালে একটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। সেই বিদ্রোহে ভেতর এবং বাহিরের প্রচন্ড আক্রমণে শতাধিক ইংরেজ সৈন্য সেদিন নিহত হয়। এমন ঘটনা ইংরেজদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার করে। পরবর্তীতে মাদ্রাজ এবং আশ পাশের সৈন্য নিয়ে তারা আবার দুর্গটি দখল করে নেয়। ইংরেজরা ওই সময় ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায়। প্রতিশোধের নেশায় প্রায় ছয় শতাধিক মানুষকে তারা হত্যা করে বলে জানা যায়। ইংরেজরা এই হামলার জন্য টিপুর পরিবার এবং রাজপুত্রদের সন্দেহ করে। কিন্তু বিদ্রোহে তাদের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ তারা উপস্থাপন করতে পারেনি।

পরবর্তীতে টিপু সুলতানের পরিবারের একটি বড় অংশকে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হয় আর যাদের সন্দেহ করা হয়নি তাদের ভেলোরে রেখে দেওয়া হয়। এখানে যারা নিহত ও মারা যায় তাদেরকে দুর্গ থেকে দুই কিমি দূরের এই টিপু সুলতান গ্রান্ড মসজিদ এর প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। এভাবেই হত্যা, রক্ত আর বিভক্তর ক্ষত নিয়ে টিপু সুলতানের বংশধরেরা ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভেলোরের এই সমাধিস্থল দেখতে আসে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, অসুস্থ মীর হোসেন ভাই তাড়া দিচ্ছিলেন ফেরার জন্য। আমরাও পা বাড়ালাম গন্তব্যে পানে।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি