ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪

আওয়ামী রাজনীতিতে ‘অটোইমিউন ফেনোমেনন’

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত : ১৮:৪৭, ২২ জানুয়ারি ২০২২

এ কথা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ঢাকার তৎকালীন রোসকোর্সে দিনে-দুপুরে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ শুধুমাত্র যে পৃথিবীর মানচিত্রটিকে নতুনভাবে এঁকে দিয়েছিল তাই নয়, এটি ছিল আরো নানা কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর পৃথিবীতে বৃহত্তম এবং পৃথিবীর ইতিহাসেই অন্যতম বৃহৎ আত্মসমর্পণ। তৎকালীন মার্কিন জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর জন্য এটি ছিল বড় ধরনের একটি ধাক্কা। কারণ, পৃথিবীর চতুর্থ শক্তিধর তৎকালীন পাক সেনাবাহিনীর বাংলাদেশের কাদা-মাটি-জলে নাকানি-চুবানি খাওয়াটা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। সপ্তম নৌবহরের মতন বিরাট সমরসজ্জা সত্ত্বেও চিরমিত্র পাকিস্তানের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোয় মার্কিন অপারগতা তৎকালীন বৈশ্বিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছিল। 

তাছাড়া পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চলমান ওয়াশিংটন-পিকিং ‘পিংপং ডিপ্লোমেসিও’ এতে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ে। তবে সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পাকিস্তান সৃষ্টির যে মূল কনসেপ্ট, অর্থাৎ ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’, তাকে ‘নাল অ্যান্ড ভয়েড’ করে দিয়েছিল। 

বহু জাতি আর ধর্ম-বর্ণের সমন্বয়ে যে ভারতবর্ষ, রাতারাতি বলা হলো সে দেশে দু’টি জাতির বাস, একটি হিন্দু আর অন্যটি মুসলমান। আর এই অদ্ভুতুড়ে দ্বিজাতিত্তত্বের ভিত্তিতেই ৪৭-এ ভারত ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান। শুরু থেকেই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একের পর এক ব্যর্থতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ধুঁকতে থাকা পাকিস্তানের ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ হয় একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। অন্যদিকে জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশের লাফিয়ে-লাফিয়ে এগুতে থাকা প্রমাণ করে দেয়, ধর্ম নয় বরং সংস্কৃতি, ভাষা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাই একটি রাষ্ট্রের ঐক্য ও বিকাশের নিয়ামক। 

বাহাত্তরে যে সদ্য স্বাধীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল মাইনাস বারো শতাংশ, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের আগে আগে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল সাত শতাংশে। এ সময় বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২৯০ ডলারের ঘরে, যা একাত্তরে পাকিস্তানের মাথাপিছু গড় আয়ের চেয়ে প্রায় ২০০ ডলার বেশি ছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনে বাংলাদেশ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় লিস্ট ডেভলপড দেশের মর্যাদা পায়। আজ বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যে গ্র্যাজুয়েশনে আমরা এত উল্লোসিত, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তা ১৯৮৫ সালেই অর্জিত হতো, এমনটাই বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যে।

পঁচাত্তরের পর থেকে পাকিস্তানী ভাবধারার একের পর এক শাসকের হাত ধরে বাংলাদেশের যে ক্রমাগত পিছন দিকে ছুটে চলা, তার লাগামটা টেনে ধরেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকাপাকিভাবে ২০০৯-এ ক্ষমতায় আসার পর থেকে। আজকের বাংলাদেশ যেকোনো বিবেচনাতেই বিশ্ববাসীর জন্য রোল মডেল, তা সে উন্নয়নের বেলাতেই হোক, কিংবা কোভিড প্যান্ডেমিক মোকাবেলায়ই হোক। 

বাংলাদেশকে আবারো ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার পাকিস্তানী চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে দফায়-দফায়, একের পর এক। তাই বলে হাল ছাড়েনি তারা কখনই। সরাসরি আঘাত করে সুবিধা করতে না পেরে তারা বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগকে এখন আঘাত করছে ভেতর থেকে। আওয়ামী লীগে যে আজ অনেক ইনফিলট্রেটর তা বলাই বাহুল্য এবং এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সচেতনতাও লক্ষ্যনীয়। 

সভানেত্রী থেকে শুরু করে দলের সব পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন, পদক্ষেপও নিয়েছেন। রসরাজ ইস্যুকে কেন্দ্র করে নাসিরনগরে দাঙ্গা বাধানোর হোতারা যখন আওয়ামী লীগের টিকেটে স্থানীয় সরকারে নির্বাচনমুখী হয়েছে, তখন তা ঠেকানো গেছে সাফল্যের সাথেই। মুখোশ উন্মোচিত হওয়ায় দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন একাধিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও। আবার অনেক ‘কাউয়া’ যে ক্ষেত্র বিশেষে পার পেয়ে যায়নি, তাও বলা যাবে না। তবে মোটা দাগে যা বলা যায়, তা হলো এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সচেতন আছেন।

এসব বিষয় নিয়ে লেখা তাই এই লেখার প্রেক্ষাপট নয়। ইদানিং নতুন একটা ফেনোমেনন চোখে পড়ছে, যা নিয়ে লেখার একটা তাগিদ অনুভব করছিলাম বেশ কদিন ধরেই। মানবদেহে এক ধরনের রোগ আছে যার নাম ‘অটোইমিউনিটি’। যেমন আমরা যারা লিভার বিশেষজ্ঞ তারা অটোইমিউন হেপাটাইটিসের সাথে পরিচিত। এ ধরনের রোগে শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজ শরীরকেই শত্রু ভেবে ভুল করে বসে। নিজের হাতেই ক্ষতি হয় নিজের শরীরের। যেমন অটোইমিউন হেপাটাইটিসে নষ্ট হয় রোগীর নিজের লিভার তার নিজের ইমিউন সিস্টেম দিয়ে। আমার কেন যেন ইদানিং মনে হচ্ছে পাকিস্তানী ওই অশুভ চক্রটি এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে অটোইমিউনিটির সৃষ্টি করছে। ফলে আওয়ামী লীগাররা অনেক ক্ষেত্রে শত্রু-মিত্র চিনতে বড় ধরনের ভুল করে বসছেন।

সাম্প্রতিক দু’একটি ঘটনা দিয়েই উদাহরণ দেই। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর প্রশংসা করল, তারাই কদিন আগে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অযৌক্তিক অজুহাতে র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাতজন কর্মকর্তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নিষেধাজ্ঞার খবরটি প্রচারিত হওয়ার পরপরই এ নিয়ে নানা রকম প্রচার-প্রচারনায় সরগরম হয়ে উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। আর এতে আমার হিসাবে অগ্রণী ছিলেন আওয়ামী ঘরানার মানুষগুলোই। তাদেরই দেখেছি র্যাব কর্মকর্তাদের সমালোচনায় বেশি উচ্চকিত হতে। অথচ র্যাবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মার্কিন সরকার কিংবা বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত যখন আমাদের মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর সাথে বিদায়ী সাক্ষাতে জানান, মার্কিন এই পদক্ষেপটি শুধুমাত্র সতর্ক করার জন্য কিন্তু শাস্তি দেয়ার জন্য নয় এবং তিনি দেশে ফিরে তার প্রশাসনকে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে পরামর্শ দিবেন, তখন তারা ‘স্পিকটি নট’।

একইভাবে বিএনপির মহাসচিব যখন দাবি করেন, তার রাজাকার পিতা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিংবা যখন তারা মানুষকে শেরেবাংলা নগরের আলোচিত কবরটির ব্যাপারে বিভ্রান্ত করতে চান, তখন তাদের কথায় আওয়ামী ঘরানার কাউকে আমি নাচতে দেখিনি। অথচ মির্জা ফখরুল সাহেব যে মুহূর্তে ঘোষণা করলেন, আমাদের একজন মাননীয় সাংসদ এক সময় ছাত্রদলে সক্রিয় ছিলেন, তার কথা মাটিতে পড়তে দেরি হলেও তা বিশ্বাস করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হতে দেরি হয়নি আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বসীদের।

অটোইউমিনিটি শরীরের সবচেয়ে খারাপ রোগগুলোর অন্যতম। অন্যান্য রোগ যেমন তেমন, এ রোগ সারানো খুব কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন পরে হাইডোজ স্টেরয়েডের আর সাথে কখনো কখনো ইমিউন সাপ্রেশনের। আওয়ামী লীগের মধ্যে ইদানিং যে অটোইমিউন ফেনোমেনন, তা নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত। অ্যান্টি-ভাইরাল দিয়ে লিভার থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যায় হেপাটাইটিস বি বা সি’র মত কঠিন ভাইরাসও। কিন্তু অটোইমিউন হেপাটাইটিস সারাতে মাথার ঘাম অনেক সময়ই ঝড়াতে হয় অনেক। ‘কাউয়া, তাড়ানো অনেক সহজ, কিন্তু নিজেই যখন নিজের বিরুদ্ধে, তা সারানোটা অনেক সময়ই অনেক কঠিন।   

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এনএস//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি