ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

একটি শোষণমুক্ত বিশ্ব দেখতে চেয়েছিলেন কমরেড মুজফ্‌ফর

কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক

প্রকাশিত : ১৮:০৯, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১৮:০৯, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯

ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত কমরেড মুজফ্‌ফর আহমদ এর ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৮৮৯ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবার নাম মনসুর আলি এবং মায়ের নাম চুনাবিবি। চুনাবিবি তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। মনসুর আলি সন্দ্বীপের এক স্বল্প আয়ের মোক্তার ছিলেন। তার দাদা আর নানার নাম ছিল মুহম্মদ কায়েম ও রেশাদ আলী ঠাকুর।

পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় কৈশোরে মুজফ্‌ফর আহমদকে বাবার চাষাবাদের কাজে সাহায্য করতে হয়েছিল। তার পিতার পেশা মোক্তারি হলেও তার পরিবার ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক। মুজফ্ফর আহমদ শিক্ষা জীবন শুরু করেন বাংলা ভাষা শিক্ষার মধ্য দিয়ে। তিনি ১৮৯৭ সালে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৯৯ সালে তিনি হরিশপুর মিডল ইংলিশ স্কুলে (পরে কাগিল হাইস্কুল) ভর্তি হন। পিতার মোক্তারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্কুল থেকে তার নাম কেটে দেওয়া হয়।

ওই সময় মাদ্রাসা শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯০৫ সালে পিতার মৃত্যুর সময় তিনি নোয়াখালীর বামনী মাদ্রাসায় পড়ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মুজফ্‌ফর আহমদ কিছুদিন বরিশালে গৃহশিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি পুনরায় গ্রামে ফিরে আসেন এবং স্কুলে ভর্তি হন। বহির্মুখি মুজফ্‌ফর আহমদকে গৃহমুখী করার উদ্দেশ্যে পারিবারিক চাপ প্রয়োগে ১৯০৭ সালে তাকে বিয়ে করতে হয়। তার স্ত্রীর নাম হাফেজা খাতুন।

১৯১০ সালে তিনি কাগিল হাইস্কুল ছেড়ে নোয়াখালী জেলা স্কুলে চলে যান। ১৯১৩ সালে সেখান থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন তিনি। ১৯১৩ সালে পশ্চিম বঙ্গের হুগলি কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু সেখানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তিনি সে বছরই বঙ্গবাসী কলেজে চলে যান। এ কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন এবং সেখানেই তার লেখাপড়ার ইতি ঘটে। ১৯১৩ থেকেই তিনি কলকাতার অধিবাসী হন।

সন্দ্বীপের কার্গিল হাইস্কুলে পড়ার সময়ই মুজফ্‌ফর আহমদের সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হয়। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক সুলতান’ পত্রিকায় সন্দ্বীপের স্থানীয় খবর পাঠাতেন। ১৯১১ সালে কলকাতায় অবস্থানরত বিভিন্ন মুসলিম ছাত্রের উদ্যোগে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি গঠিত হয়। কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটে এ সাহিত্য সমিতির অফিস ছিল। ১৯১৮ সালে সমিতির উদ্যোগে বের হয় ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’। ১৯১৮ সালে সমিতির সব সময়ের কর্মী হিসেবে তিনি এর অফিসেই থাকা শুরু করেন। তিনি ছিলেন সমিতির সহকারী সম্পাদক। পত্রিকার কাজ পরিচালনার সময় চিঠিপত্রের মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তার পরিচয় হয়। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হলে নজরুলের সৈনিক জীবনের অবসান ঘটে এবং তিনি কলকাতায় মুজফ্‌ফর আহমদের সাথে সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতে শুরু করলেন।

সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বে মুজফ্‌ফর আহমদ কিছুদিন চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলা সরকারের ছাপাখানায় মাসিক ত্রিশ টাকা বেতনে তিনি চাকরি করেছিলেন। বাংলা সরকারের অনুবাদ বিভাগেও তিনি মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে একমাস উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করার কাজে চাকুরি করেন। একমাস তিনি প্রেসিডেন্সী বিভাগের স্কুলসমূহের ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজও করেন। কলেজে পড়ার সময় খিদিরপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করেন আর একমাস ছুটিতে তিনি কলকাতা সিটি কর্পোরেশনে কাজ করেন।

কৈশোরে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও ১৯১৬ সাল থেকে মুজফ্‌ফর আহমদ বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনা, সভা-সেমিনার-মিছিল যোগদান প্রভৃতি শুরু করেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতার অনুষ্ঠিত আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে বঙ্গীয় খেলাফত কমিটির সদস্য মনোনীত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

১৯২০ সালের শুরুতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে রাজনীতিই হবে তার জীবনের মূল পেশা। তিনি কাজী নজরুলের সাথে ঠিক করেন একটি ভিন্ন ধর্মী বাংলা দৈনিক বের করার। এ বিষয়ে তারা ফজলুল হক সাহেবের (পরবর্তীতে শেরে বাংলা) সাথে দেখা করেন। হক সাহেব তার নিজের টাকায় পত্রিকা বের করার প্রস্তাব করেন। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই মুজফ্‌ফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলামের যুগ্ম সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ নামক সান্ধ্য পত্রিকা বের করেন। তিনি রাজনীতি করতে যেয়ে অনেক জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন। মাঝে মাঝে আত্মগোপনে থাকতে হতো তাকে। এই জন্য তিনি নিজেকে ‘কাকা বাবু’ নামে পরিচয় দিতেন। সেই থেকে কলকাতা শহরে তিনি ‘কাকা বাবু’ নামেই পরিচিত হয়ে উঠলেন।

মুজফ্‌ফর আহমদের ছাত্রাবস্থায় বাংলায় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের শুরু হয়। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুধু হিন্দু আন্দোলন ছিল না, আসলে তা ছিল বর্ণ হিন্দুদের আন্দোলন। তার মতে, এক ধরনের রোমাঞ্চের জন্য শিক্ষিত যুবকেরা এতে অংশ নিলেও এর পিছনে ছিল একটা গভীর নৈরাশ্য। যদিও তিনি এই আন্দোলনের জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের শ্রদ্ধা করতেন।

অন্যদিকে মুসলীম লীগ ও কংগ্রেসকে তিনি ধনীক শ্রেণীর স্বার্থে ধনী শ্রেণীর রাজনৈতিক দল বলে মনে করতেন। কংগ্রেসের ঘোষণা পত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা থাকলেও এ দল ধীরে ধীরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী নেতাদের কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে অসাম্প্রদায়িক হলেও ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতেন। মূলত ভারতীয় উপ-মহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু সুবিধাভোগী শ্রেণীর একাধিপত্যকে রোধ করার জন্যই মুসলিম সুবিধাভোগী ও রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের জন্ম হয়।

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ‘জার’ শাসনের অবসান ঘটে এবং লেনিন-স্টালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক অভ্যুত্থান সফলতা লাভ করে। রাশিয়াতে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর ঢেউ খুব দ্রুত অন্য সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রুশ বিপ্লবের সাফল্য তাকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯২১ সাল থেকে তিনি মার্কসবাদ চর্চা ও মার্কসবাদী রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। তৎকালীন ভারতেও ব্যতিক্রম হয়নি।

১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তারিখে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ভারতের সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। গঠন করেছিলেন বাঙালি নেতা মানবেন্দ্র নাথ রায়। এর মাত্র একমাসের মধ্যে বঙ্গদেশেও সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। এই সংগঠনের পুরোধা ছিলেন মুজফ্‌ফর আহমদ। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে। তিনি ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন।

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি