ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

নতুন গাড়ির চেয়ে বেশি জরুরি বিআরটিসির সংস্কার

মেহেদী হাসান আলবাকার

প্রকাশিত : ১৭:১২, ২৬ মার্চ ২০২০

ঋণ ও দায়দেনায় ডুবে থাকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন-বিআরটিসিকে সত্যিকার অর্থেই লাভজনক করতে প্রতিষ্ঠানটির বড় ধরণের সংস্কার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা।
 
তারা বলছেন, মেরামত, রক্ষানাবেক্ষণ, চালকসহ প্রতিটি বিভাগকে দক্ষ জনবল দিয়ে নতুন করে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি বন্ধ করতে হবে সব ধরণের দুর্নীতি-অপচয়। না হলে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ ও লোকসানের বোঝা এক সময় অসহনিয় পর্যায়ে চলে যাবে। 

বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউর তথ্য বলছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ঋণসহ সব মিলিয়ে দায়- দেনা ছিল ৭৪৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। পাশাপাশি পরিচলানাও লোকসান করেছে। ফলে গেল দশ বছরে কখনোই লাভের মুখ দেখেনি বিআরটিসি।  

বিআরটিসির গেল দশ বছরের লোকসানের চিত্র

অর্থবছর লোকসান  (কোটি টাকায়)
২০০৯-১০  ২৪.৬০
২০১০-১১   ৬২.০৬
২০১১-১২    ৭৪.৬৬
২০১২-১৩  ৫৩.৫৫
২০১৩-১৪  ৫৬.৩২
২০১৪-১৫  ৬৭.৮৩
২০১৫-১৬  ৭৯.২৯
২০১৬-১৭  ১০১.০৪
২০১৭-১৮    ৯৫.৫২
২০১৮-১৯  ৫৯.৯১

১৯৬১ সালে অধ্যাদেশে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিআটিসি। সেখানা জনগনকে উন্নততর পরিবহন সেবা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ফলে দীর্ঘ্যমেয়াদি ঋণ ও দায় দেনার পরিবর্তে বর্তমান সম্পদ কতোটা ভালভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং জনগনকে কতটুকো ভাল সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে সেটিকেই বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছে বিআরটিসি। 

বিআটিসির মহাব্যবস্থাপক মোঃ আমজাদ হোসেন বলেন, ‘১৯৬১ সাল থেকে আজ অব্দি যে ঋণ ও দেনার বোঝা আমাদের ঘাড়ে চেপেছে তা থেকে আমরা সহসাই মুক্তি পাবোনা। এ নিয়ে ভাবার বদলে জনগনকে ভাল সেবা দেয়া এবং পরিচালনায় যাতে লোকসান না হয়, বেতনভাতার জন্য যাতে সরকারের কাছে হাত না পাততে হয় সেটিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’
  
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমরা ১৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা পরিচলন মুনাফা করেছি, যেখানে এর আগের তিন অর্থবছরে পরিচলন  লোকসানই ছিল ৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যোগ করেন তিনি। 

পরিচলন মুনাফা করতে পারলে সেটিও বিআরটিসির জন্য শুভ সংবাদ, তবে এই মুনাফা কতোটা টেকসই হবে তা নিয়েই সন্দেহ প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিনের।
 
তিনি বলেন, সম্প্রতি বিআরটিসির বহরে এগারশো সম্পূর্ন নতুন বাস-ট্রাক যুক্ত হয়েছে। এ গাড়িগুলো এখনো মেরামতের কোন প্রয়োজন পড়ছে না,  জ্বালানিও লাগছে তুলনামুলকভাবে কম। ফলে আপনারা পরিচলন মুনাফা দেখছেন। 

কিন্তু বিআরটিসির মেনটেইন্সে, স্টোর, চালক কোন খাতেই পর্যপ্ত জনবল নেই। ওয়ার্কশপ গুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, পর্যপ্ত স্পেয়ার পার্সও অনেক সময় থাকেনা। ফলে নতুন গাড়িগুলো দু-এক বছর পরই নষ্ট হতে শুরু করবে। 

নিজস্ব জনবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে গোটা বিআটিসিকে নতুন করে ঢেলে না সাজালে এটা কখনোই সত্যিকার অর্থে লাভজনক হতে পারবে না, লোকসানের বোঝা প্রতিষ্ঠানটিকে তথা সরকারকে দশকের পর দশক বয়ে বেড়াতে হবে বলেই আশঙ্কা ড. এস এম সালেহ উদ্দিনের।

বিআরটিসির ২১টি বাস ডিপোতে এখন বাস আছে ১ হাজার ৮১৮টি যার মধ্যে ৬০০টি একদম নতুন, সব মিলিয়ে রাস্তায় চলছে এখন ১ হাজার ২৭৩টি। পুরাতন বাসের মধ্যে ৩০২টি মেরামতের অযোগ্য আর ২৪৩টি আছে ভাড়ি মেরামতের অপেক্ষায়। 
আর দুটি ট্রাক ডিপোতে মোট ট্রাক আছে ৫৯৯টি যার মধ্যে ৫০০টি সম্পূর্ন নতুন। সব মিলিয়ে সচল ট্রাক এখন ৫৭০টি। ৪ টি আছে ভারি মেরামতে।  বাকি ২৫টি মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। 

গত এক দশকে বিআরটিসিতে সরকার বিনিয়োগ করেছে ১ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের বাস ও ট্রাক মিলিয়ে কেনা হয়েছে ২ হাজার ৫৮টি যানবাহান। 

২০১০ সালে চীন থেকে ১১৩ কোটি টাকায় ২৭৫ টি বাস কেনা হয়। পরের বছর কোরিয়া থেকে ২৮১ কোটি টাকায় কেনা হয় ২৫৫টি বাস। চীনা বাসগুলো ছিল খুবই নিম্নমানের এবং কোরিয়ান বাসের যন্ত্রংশ ছিল অপ্রতুল, ফলে খুব অল্প সময়েই সেগুলো নষ্ট হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন বিআরটিসির কর্মকর্তারা। সম্প্রতি ২৩৭ কোটি টাকায় ভারত থেকে ৫০০ ট্রাক এবং ৬৩৪ কোটি টাকায় ৬০০ বাস কেনা হয়েছে। এ গাড়িগুলোই এখন সরকারি এই পরিবহন সংস্থার প্রধান ভরসা। 

তবে সাম্প্রতিক মুনাফা শুধুমাত্র নতুন গাড়ির কারনে, এমনটা মানতে নারাজ সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোঃ এহছানে এলাহী। তিনি বলেন, গেল সেপ্টেম্বরে যোগ দেয়ার পর থেকেই অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা অনেকটাই দূর করেছি। গাড়ির টাকা ঠিক মতো জমা হচ্ছিলনা। ঠিক মতো মেরাতমও হচ্ছিলানা। এসব অনিয়ম এখন আর নেই। পাশাপাশি নতুন নতুন গাড়ির সাথে সাথে আমরা নতুন কিছু ভাল রুটও যুক্ত করেছি। 

এর আগে বিআরটিসির প্রতিটি ডিপোতেই কর্মচারিদের বেতন বকেয়া ছিল। কোন কোন ডিপোতে ১৪ মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া হয়ে পড়েছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে সে সময় চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভুঁইয়াকে বিদায় নিতে হয়েছিল। 

তাবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে চলতি বেতনের সাথে এ পর্যন্ত সাড়ে তিন মাসের বকেয়া শোধ করা হয়েছে বলে জানান বর্তমান চেয়ারম্যান  এহছানে এলাহী। বাকিটা আগামী ছয় মাসের মধ্যে শোধ হয়ে যাবে বলে আশা তারা। 

সংস্থাটির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সাথে কথা বলে জানান যায়, চালকের অভাবে অনেক গাড়িই এখন ভাড়ায় চলছে, যারা ভাড়া নিচ্ছেন তারা ঠিকমতো ভাড়া পরিশোধ করলেও নিয়মিত রক্ষানাবেক্ষনের কাজটি করছেন না। বেসরকারি গাড়িগুলো রক্ষনাবেক্ষনের মাধ্যমে ২০ বছর পর্যন্ত সচল থাকলেও বিআরটিসির অধিকাংশ গাড়িই ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে। রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে ডিপোতে পড়ে থাকে। একটা সময় পরে মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়লে উচ্ছিষ্ট হিসাবে বিক্রি করে দেয়া হয়। 

অথচ বিআটিসিই একমাত্র পরিবহন সংস্থা যার গাজিপুর ও তেজগাওয়ে দুটি পূরনাঙ্গ মেরামত কারখানার পাশাপাশি প্রতিটি ডিপোতেও গাড়ি মেরামতের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলে ঘাটতি রয়েছে। অনেক সময় অস্থায়ী ভিত্তিতে বাইরে থেকে মেকানিক এনে কাজ সাড়া হয়। পার্সও কেনা হয় বাজার থেকে যা অনেক সময়ই মান সম্মত হয় না। 

মেরামতের ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের ঘাটতি এবং পার্টস কেনাকাটায় অনিময় সম্পূর্ন দূর করা সম্ভব হয়নি এটা মানছেন বর্তমান চেয়ারম্যান এহছান এলাহীও। এজন্য সম্প্রতি ৮৬টি করিগরি পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে, নতুন চালক নিয়োগের প্রক্রিয়াও চুড়ান্ত পর্যায়ে। পাশাপাশি মানসম্মত স্পোয়ার পার্স নিশ্চিত করতে ডিপোর বদলে কেন্দ্রীয়ভাবে কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

এদিকে গেল সেপ্টেম্বরে বিআরটিসি আইন-২০১৯ এর খসড়া চুড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রী সভা। যেখানে ৫১ শতাংশ শেয়ার সরকারের হাতে রেখে বাকি শেয়ার অন্যকোন সংস্থা বা বেসরকরি খাতে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এটি কার্যকর হলে কর্পোরেশ থেকে কোম্পানিতে পরিনত হবে বিআরটিসি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার সবসময়ই জনপ্রিয় পুজিবাজারে। 

কিন্তু এখন পুজিাবাজারে তালিকাভুক্ত হলে বিআরটিসি হবে জেড গ্রুপের শেয়ার। তাই এখনি প্রতিষ্ঠানটিকে পুজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা সঠিক হবে না বলে জানান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ।
 
সরকারি ব্যবস্থাপনায় এটি কোন দিন সত্যিকার অর্থে লাভজনক হবে এমন আশাও কম। তাই গাড়ি লিজের বলে গোটা ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের। 

তিনি আরও বলেন, বিআরটিসি আসলে লোকসান হওয়ার মতো প্রতিষ্ঠান না, এটাকে লাভজনক করে পুজিবাজারে আনতে পারলে প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারী সবারই লাভ হবে। 

পাশাপাশি সরকারি সংস্থা হওয়ায় সব সময় নিরধারিত ভাড়াই নিয়ে থাকে বিআরটিসি। তাই সাধারণ মানুষের কাছে এ পরিবহন সংস্থার জনপ্রিয়তাও বেশি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির বছরের পর বছর লোকসানই বড় উদ্বেগের বিষয়। 

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যান সমিতি বলছেন, বিআরটিসির গাড়ির জন্য কোন রুট পার্মিট প্রয়োজন হয় না। নিজস্ব ডিপো থাকার কারণে কোন ভাড়াও গুনতে হয় না। আছে নিজস্ব মেরামত কারখানাও। শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনা ঠিক হলেই এ প্রতিষ্ঠান লাভজন না হওয়ার কোন কারণ নেই। 

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জামেল হক চৌধুরী বলেন, এ সংস্থাকে টেকইসভাবে মুনাফায় নিতে হলে সবচেয়ে জরুরি ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায়। নগদ টাকার পরিবর্তে কার্ডের মাধ্যে ভাড়া আদায় হলে ফাকির কোন সুযোগ থাকবে না লোকসানও আর হবে না।

কিন্তু এধরণের পরিকল্পনা এখনি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বিআরটিসি।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি