ঢাকা, শনিবার   ০৪ মে ২০২৪

নিজের কাজ ভালোভাবে করাই প্রকৃত দেশপ্রেম

প্রকাশিত : ১২:৪৫, ১০ এপ্রিল ২০১৯

দেশপ্রেম একটি মহৎ গুণ। এটি হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়। সংস্কৃতিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী’ অর্থাৎ জননী জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও মহীয়ান। জ্ঞানীরা বলেছেন, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। অর্থাৎ যার দেশপ্রেম নেই তার ঈমানও পরিপূর্ণতা পায় না। আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স) দেশকে খুব ভালবাসতেন।

কুরাইশদের অত্যাচারে তিনি যখন জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি বার বার মক্কার দিকে, কাবার দিকে ফিরে বলছিলেন, তোমাকে আমি বড় ভালবাসি। আপন গোত্রের লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যেতাম না। কথায় নয়, কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে। এই মুহূর্তের করণীয় কাজটুকু সবচেয়ে সুন্দরভাবে করতে হবে। এজন্যে কোয়ান্টামের একটি বাণী নিজের কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করাই প্রকৃত দেশপ্রেম।

দেশপ্রেমের প্রকাশ-

আমরা অনেকে তরুণেরা আফসোস করে বলি, ইশ আমি যদি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে পারতাম। কী হলে কী করতাম এই নিয়ে আক্ষেপ করি কিন্তু বাস্তবে নিজের করণীয়টুকু সুন্দরভাবে পালন করি না। একজন মানুষকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ দায়িত্ব পালন করতে হয়। নিজের কাজটুকু সৎভাবে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে করাই হলো দেশপ্রেম। যিনি প্রবাসী তিনি তার অর্পিত দায়িত্ব ও কাজ নৈতিকতা প্রদর্শন করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারেন। একজন প্রবাসী ট্যাক্সিক্যাব চালক যাত্রীর ফেলে যাওয়া মূল্যবান ডলার যখন ফেরত দেন, তখন আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল হয়।

একজন শিক্ষাথীর জন্যে সর্বোচ্চ দেশপ্রেম হচ্ছে জ্ঞানার্জনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া এবং এ লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রম করা। আসলে যে ছেলে/মেয়েটি স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে লাল-সবুজে মুড়ে ছবি পোস্ট দেয়, দেশপ্রেমের স্ট্যাটাস দেয়, তার সেই স্ট্যাটাস দেশের কল্যাণার্থে কতটুকু কাজে লাগে জানি না। কিন্তু যে মমতা দিয়ে লেখাপড়া করছে, জ্ঞানার্জন করছে, নিজেকে আলোকিত মানুষরূপে গড়ে তুলছেন, তিনি সত্যিকার অর্থেই দেশের কল্যাণেই কাজ করছেন।
একজন শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও তথ্যে সমৃদ্ধ করা, লক্ষ্য সুস্পষ্ট করে দেয়া, লক্ষ্য অর্জনে মেধার বিকাশ ঘটানো, মূল্যবোধ জাগ্রত করা। একজন শিক্ষক যদি ক্লাসে পাঠদানের চেয়ে টিউশনি করানো বেশি অগ্রাধিকার দেন তাহলে তার দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটল না।
যিনি রাস্তা নির্মাণ করছেন তার দায়িত্ব হলো কত ভালো উপকরণ দিয়ে টেকসই রাস্তা নির্মাণ করা যাতে অল্পদিনে রাস্তায় ফাটল না ধরে। আপনি যদি গাড়ি চালান, কীভাবে নিয়ম ফাঁকি দেয়া যায় তা নয় বরং আপনাকে নিয়ম মেনে গাড়ি চালাতে হবে এটাও কিন্তু দেশপ্রেম।
একজন সরকারি চাকরিজীবি হচ্ছেন জনগণের সেবক। তার চিন্তা থাকবে কোনো রকম হয়রানি পেরেশানি ছাড়াই ফাইল ছেড়ে দেয়া বা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা। যে চাকরিজীবি কর্মস্থলে সময়মতো যান এবং পুরো কর্মঘণ্টা আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন সেটিই তার দেশপ্রেম। একজন টেকনিশিয়ান যে কাজটি পাঁচ মিনিটে করে দিতে পারেন সেটি পাঁচ দিন ফেলে না রেখে যদি পাঁচ দিনেই করে দিতে পারেন তাহলে সেটিও তার দেশপ্রেমের নমুনা।
আপনি গৃহিণী হলে আন্তরিকতা নিয়ে যদি সন্তানদের লালন-পালন করেন, পরিবারের সবার স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখে খাদ্যাভ্যাসের ব্যবস্থা করেন তবে তা-ও আপনার দেশপ্রেমের নমুনা। ঘরের কাজকেও অবহেলা না করা। স্ত্রী মনোযোগ ও মমতার কারণে স্বামী তার সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ঘরে ফিরে প্রশান্তি পাবেন এবং পরদিন নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে পারবেন। তেমনি ছেলে-মেয়েরা মা-বাবার কথা শুনলে তাদের দোয়া থাকবে আপনার জীবনে এবং অগ্রজদের অভিজ্ঞতা থেকে আপনি শিখতে পারবেন যা আপনার সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করবে।

যে চিকিৎসক আন্তরিকভাবে সেবা দেন, রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন, যে চিকিৎসক রোগীকে বাড়তি টেস্ট করতে দেয় না এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ছাড়া বাড়তি ওষুধ লেখেন না তাহলে এটিও তার দেশপ্রেম। জাতীয় অধ্যাপক শিশুবন্ধু ডা. এম আর খান তার সহকর্মীদের বলছিলেন “তোমাদের সেবার মান এমন হতে হবে যেন রোগী মারা গেলেও তার আত্মীয়স্বজনরা বলতে বলতে যায় হায়াত নেই তাই মারা গেছে। ডাক্তার সাহেব চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন নি।

এ প্রসঙ্গে আমেরিকার কিংবদন্তী বর্ণবাদ বিরোধী কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘তুমি যদি ঝাড়ুদার হও, এমন সুন্দরভাবে ঝাড়ু দেবে যেভাবে মাইকেল এঞ্জেলো ছবি আকতেন, বিটোভেন সুর সৃষ্টি করতেন, শেক্সপিয়ার কবিতা লিখতেন। যাতে স্বর্গমর্ত্যের অধিবাসীরা এসে বলবে, এখানে একজন মহান ঝাড়ুদার থাকেন যিনি খুব সুন্দরভাবে কাজ করতেন।

আপনি যদি কর্মপ্রেমী না হন তাহলে আপনাকে দেশপ্রেমিক বলা যাবে না। কারণ একজন মানুষের মূল পরিচয় তার কাজ। স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে আন্তরিকভাবে লাগাতার কাজ করে যাওয়াই হলো একজন মানুষের সঠিক জীবনদৃষ্টি। আসলে কাজই জীবনকে সার্থক করে, বিকশিত ও আলোকিত করে। যা এক সময় রূপ নেয় দেশপ্রেমে।
স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা থাকবে কাজ করতে করতে আমরা যেন পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারি। নারী জাগরণের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের ছিল কর্মময় মৃত্যু। নারী বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লিখতে লিখতে তিনি লেখার টেবিলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন।
নিজেকে সবসময় কর্মী হিসেবে ভাবতে হবে। একবার আহনাফ বিন কায়েস কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে একবার খলিফা ওমর (রা) সাথে সাক্ষাৎ করতে গেছেন। মসজিদে খলিফাকে না পেয়ে তারা ওমর (রা) এর খোঁজে বের হলেন। শহর-প্রান্তে এসে তারা দেখলেন যে, খলিফা কোমরে কাপড় গুজে ছোটাছুটি করছেন। তাদেরকে দেখতে পেয়েই ওমর ডাকলেন, আহনাফ! দৌড়ে এসো। বায়তুল মালের একটি উট ছুটে পালিয়েছে। ওটাকে ধরতে হবে। জানো তো, কত এতিমের অংশ রয়েছে এই উটটিতে। সাথে থাকা একজন প্রভাবশালী বলে উঠলেন, তার জন্যে খোদ আমীরুল মুমেনীন দৌড়াদৌড়ি করছেন কেন? একজন চাকর বা গোলাম পাঠালেই তো হতো? স্মিত হেসে খলিফা ওমর (রা) জবাব দিলেন, আমার চেয়ে বড় গোলাম আর কে আছে?


দেশের সম্পদ রক্ষার বিষয়ে সচেতনতাও দেশপ্রেমের অংশ। দেশের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির যেন কোনো অপচয় না হয় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা কল ছেড়ে দাঁত ব্রাশ করতে থাকি এটি ঠিক নয়। রান্নার কাজে যে গ্যাস ব্যবহার করা হয় তা আমরা অনেকেই কাপড় শুকানোর কাজে ব্যয় করি। অনেকে একটি দেয়াশলাই এর কাঠির খরচ কমাতে ২৪ ঘণ্টা গ্যাস জালিয়ে রাখছি।
অনেকে যত্র তত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখি। বাদামের খোসা, কলার খোসা নির্দিষ্ট স্থানে ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। আমরা যদি ময়লা আর্বজনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার অঙ্গীকার করি তাহলে দেশের পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যগত অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারব।

এই দেশে আপনার জন্ম। এখানকার আলো-বাতাস আবহাওয়া মাটি খাদ্যে বেড়ে উঠেছেন আপনি। আমাদের মতো এত উদার মানবিক দেশ কোথায় আছে? আসলে দেশ নিয়ে কখনো নেতিবাচক কথা বলা উচিত নয়। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক গুরুজী বলেছেন, আমাদের এই দেশ স্রষ্টা নিজ হাতে বানিয়েছেন। একটি বীজ পড়লে যত্ন নিতে হয় না, এমনিতেই গাছ হয়ে বেড়ে ওঠে। সদ্যপ্রকাশিত একটি জরিপে বলা হয়েছে, আশাবাদী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে দ্বিতীয় এবং এদেশের ৬৬% মানুষ নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট। তাই আপনিও আশাবাদী হোন, এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে।

টিআর/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি