ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই সংক্রামক রোগের বড় প্রতিষেধক

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:২১, ৭ জুন ২০২০

করোনা ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি। এ মুহূর্তে ভাইরাসটি প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বনের মাধ্যমে জীবানুমুক্ত থাকা। কেননা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সতর্কতাই সংক্রামক ব্যাধি করোনাসহ সব ধরনের জীবানুবাহী রোগ-ব্যাধি থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে। শুধু করোনা নয়, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও একই পরামর্শ।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী মহামারী রুপ নেয়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসটি অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্নতা থেকে সৃষ্ট। আর এই মহামারী থেকে বাচঁতে যে সকল নিয়মাবলী অনুসরণ করার কথা জানিয়েছেন গবেষকেরা তাদেরও মূল বানী হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। মূলত অপরিচ্ছন্ন জীবনব্যবস্থা, পরিবেশ, অস্বাস্থ্যকর খাবার আর জীবন যাপন ব্যবস্থার নোংড়ামো থেকেই এই ভাইরাসটি শক্তিশালী প্রাণঘাতী রুপে মানব সভ্যতাতে ধ্বংস করে যাচ্ছে ক্রমাগত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সঙ্কটের এই সময়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে নিজেকে ও আশেপাশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে। নভেল করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য ডব্লিউএইচওর ওয়েবসাইটের পাশাপাশি সোশাল মিডিয়ায় সচেতনতামূলক বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। 

ডব্লিউএইচওর নির্দেশনায় এই সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে সাবান ও পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুতে বলা হয়েছে। হাঁচি ও কাশি হলে অবশ্যই হাত বা টিস্যু দিয়ে মুখ ও নাক ঢেকে রাখতে হবে। এরপর টিস্যু ফেলে দিতে হবে এবং অবশ্যই হাত ধুতে হবে। যে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার পর হাত ধুতে হবে। কোনো প্রাণির যত্ন নিলে বা স্পর্শ করলে ও প্রাণিবর্জ্য ধরার পরও হাতে ধুতে হবে। ব্যবহার করা টিস্যু খোলা ঝুড়ি বা ডাস্টবিনে না ফেলে ঢাকনা রয়েছে এমন ঝুড়িতে ফেলতে হবে। নিজে সুরক্ষিত না থেকে বা হাতে গ্লাভস না পরে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির মুখ ও দেহ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কাজের জায়গাটি দিনে অন্তত একবার হলেও পরিষ্কার বা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পরিধেয়টি অবশ্যই প্রতিদিন বদল করতে হবে এবং ধুতে হবে।

মোট কথা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।

ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বুঝাতে ‘পবিত্রতা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আর এটি মুমিন মুসলমানের ঈমানের অঙ্গ। ইসলাম বরাবরই সবসময় পবিত্রতার সঙ্গে থাকার দিক নির্দেশনা দিয়ে আসছে। সব সময় পবিত্রতার সঙ্গে থাকার অর্থই হলো প্রথমে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্র থাকতে হলে প্রথমেই নিজের হাত-মুখ-মাথা এবং পা ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। ইসলাম এটিকে ওজু হিসেবে আখ্যায়িত করে। ওজুর মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের প্রতিটি ধারাবাহিক কাজের আলাদা আলাদা ফজিলতও ঘোষণা করা হয়েছে। 

আল্লাহ তা'আলা মাদিনার নিকটবর্তী কোবা এলাকার লোকজনের পরিষ্কার পরিচন্নতার প্রশংসা করে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ্ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আত-তাওবা, আয়াত: ১০৮)

মহান আল্লাহ তা'আলা আরো ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদের।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২২)

হাদিসেও বিভিন্ন উপায়ে পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং নানাবিধ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আবু মালেক আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।’ (মুসলিম, হাদিস নং: ২২৩)

ইসলামে ব্যক্তির পরিচ্ছন্নতা, গৃহের পরিচ্ছন্নতা ও পরিপার্শের পরিচ্ছন্নতা—কোনোটাই বাদ যায়নি। ব্যক্তির পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় অন্তত জুমাবারে গোসলের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমনকি হাদিসে এ ক্ষেত্রে ওয়াজিব বা অত্যাবশক বলা হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘জুমার দিন গোসল করা প্রতিটি সাবালক ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব।’ (বুখারি, হাদিস নং : ৪৭৯)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর জন্য প্রতিটি মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য হলো (অন্তত:) প্রতি সাত দিনের মাথায় তার মাথা ও শরীর ধৌত করা।’ (বুখারি, হাদিস নং: ৮৯৭; মুসলিম, হাদিস নং: ৮৪৯)

 

ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে—স্ত্রী সহবাসের পরক্ষণেই তাদের আবশ্যকীয় গোসল করতে হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তাহলে বিশেষভাবে (গোসল করে) পবিত্র হও। যদি তোমরা পীড়িত হও অথবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রস্রাব-পায়খানা  থেকে আগমন করে অথবা তোমরা স্ত্রী-সহবাস করো এবং পানি না পাও, তাহলে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো; তা দিয়ে তোমাদের মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় মাসাহ করো। আল্লাহ তোমাদের কোনো প্রকার কষ্ট দিতে চান না; বরং তিনি তোমাদের পবিত্র করতে চান ও তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৬)

শয়নের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (স) বিছানা ঝাড় দিতেন। জুতা, কাপড় ইত্যাদি পরিধানের পূর্বে তিনি ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে নিতেন। তিনি সুগন্ধি পছন্দ করতেন। সৌন্দর্যের প্রতীক ফুলও তাঁর খুব প্রিয় ছিল। তিনি রাতে ঘুম যাওয়ার পূর্বে এবং ঘুম থেকে জেগে মিসওয়াক করতেন। 

ঈমানদার লোকের বসত-বাড়ি ও ঘরের আঙিনা পরিচ্ছন্ন থাকে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি পবিত্রতাকে পছন্দ করেন, তিনি পরিচ্ছন্ন এবং তিনি পরিচ্ছন্নতাকে পছন্দ করেন।’ (তিরমিজি)

দৈহিক রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে হলে দেহকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ মানব দেহের প্রধান শত্রু।

ওপরের সব দিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও  পরিচ্ছন্নতার সর্বোচ্চ পন্থা। সত্যিই পুরো বিশ্বের সব ধর্ম প্রচারকরা  যা করতে পারেনি এক করোনাই তা করে দেখিয়েছে। 

 

ওপরের সব দিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও  পরিচ্ছন্নতার সর্বোচ্চ পন্থা। সত্যিই পুরো বিশ্বের সব ধর্ম প্রচারকরা  যা করতে পারেনি এক করোনাই তা করে দেখিয়েছে। করোনা আক্রান্তদের ডাক্তাররা আরো যেসব চিকিৎসা দিয়ে থাকেন তার মধ্যে একটি হলো দৈনিক আট থেকে দশ ঘণ্টা ঘুমানো। রাতে হালকা খাবার খাওয়া। এ দুটি বিষয়েও ইসলামের  নির্দেশনা রয়েছে। রাসুল (সা.) এশার নামাজের পর অযথা গল্পগুজব ও গভীর রাত পর্যন্ত সময় নষ্ট না করে দ্রুত ঘুমানোর তাগিদ দিতেন। (মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৪৮৭৯)

খাবার প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, মানুষ পেট থেকে অধিক নিকৃষ্ট কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে এমন কয়েক গ্রাস খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮০)

তাই পর্যাপ্ত ঘুম ও হালকা খাবার গ্রহণ শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যা আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগেই ইসলাম মানুষকে জানিয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আক্রান্ত দেশগুলোর অধিকাংশ মানুষ রাত্রি জাগরণ করে। আবার শরীরের পরিচ্ছন্নতার প্রতিও তাদের রয়েছে যথেষ্ট উদাসীনতা। ফ্রান্স-ইতালির মানুষের হাত-মুখ ধোয়ার অভ্যাস খুবই কম। সেসব দেশে সকালে মেট্রোরেলে সফরের সুযোগ যদি কারো হয় তাহলে দেখবেন মানুষ থুতু দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছে। বিশেষত মহিলারা সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধোয়া ছাড়াই অফিসে বের হয়ে পড়ে। খাবারের আগে-পরে হাত না ধোয়া,  টয়লেট শেষে পানি ব্যবহার না করে শুধু  টিস্যু ব্যবহার করা এবং গভীর রাত পর্যন্ত সজাগ থাকা এদের বদ স্বভাবে পরিণত হয়েছে। যার ফলে পৃথিবীতে কোনো ভাইরাস দেখা দিলে এরাই বেশি আক্রান্ত হয়।

শুধু করোনাই নয়, ডেঙ্গু থেকে শুরু করে সব ধরণের সংক্রামক রোগের বড় প্রতিষেধক হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। আর শুধু শরীর বা নিজের ঘর নয়, বাড়ির আসেপাশে, পাড়া-মহল্লা, যানবাহন, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই রাখতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তাহলেই কেবল করোনা, ডেঙ্গুর মত ভাইরাসকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে।

এসএ/


 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি