ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

পুত্র আমাকে চোখে চোখে রাখে-বাবা আবার চলে যাবে না তো!

ডা. মো. খায়রুল ইসলাম

প্রকাশিত : ১৪:০৬, ২৪ জুন ২০২০

সরকারি হাসপাতালগুলোতে বরাবরই চিকিৎসকদের কাজের চাপ একটু বেশি থাকে। আর এই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ঢাকা মেডিকেলের নতুন ১০ তলা বিল্ডিংয়ে ভর্তি রোগীদের সেবাদানের জন্যে এক সপ্তাহে ডাক্তার প্রয়োজন হয় ৯২ জনের মতো। এ দলটিকে চারটা টিমে ভাগ করে ডিউটি দেয়া হয়। যেমন, মর্নিং ডিউটি থাকে ছয় ঘণ্টার। ইভনিং ডিউটি করতে হয় ছয় ঘণ্টা। রাতের ডিউটি খুব চ্যালেঞ্জিং, কারণ আমাদের ১২ ঘণ্টার টানা ডিউটি থাকে।

প্রত্যেকের সাত দিন ডিউটি, তারপর নির্দিষ্ট হোটেলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন। কোয়ারেন্টাইনে মূলত অপেক্ষা করতে হয় করোনার উপসর্গ ডাক্তারের মধ্যে দেখা দিচ্ছে কিনা, তিনি করোনা পজিটিভ কিনা তা বোঝার জন্যে। উপসর্গ দেখা না দিলে কোয়ারেন্টাইনের ১২ তম দিনে ডাক্তারের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ১৪ তম দিনে রিপোর্ট নেগেটিভ এলে ডাক্তার বাসায় ফিরে যেতে পারবেন। বাসায় ফিরে দিন গুণতে হয়-কবে আবার ডিউটির জন্যে ডাক পড়বে।

প্রথম দফায় কাজের অভিজ্ঞতা

করোনা ডিউটি করার অভিজ্ঞতা একবারেই আলাদা। অন্যসময়ে ডিউটি করেছি। মুমূর্ষু রোগী দেখেছি। কাজ করতে গিয়ে মন সবসময় ভালো থাকত। এখন রোগী দেখার নিয়ম সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগে যেমন রোগীকে ধরা যেত, তার কাছে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেত। কিন্তু এখন তাদের দেখতে হচ্ছে ‘নন-টাচ টেকনিকে’। আমাদের দেশের মানুষ ডাক্তারের কাছ থেকে এ পদ্ধতিতে সেবা পেতে এখনো অভ্যস্ত নয়। তারা ভাবে, ডাক্তার কেন আমাকে সময় নিয়ে দেখলেন না, কথা বললেন না! এই বিষয়গুলো নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়।

আরেকটা কষ্টদায়ক বিষয় হলো, আমাদের ডিউটি ড্রেস। প্রত্যেক চিকিৎসকই এই কষ্ট মাথা পেতে নিয়েছেন। যেমন, এন-৯৫ মাস্ক। এ মাস্ক বেশিক্ষণ পরে থাকা যায় না। একঘণ্টা পর দেখা যায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে বা বুকব্যথা, মাথাব্যথা করছে। মুখের অংশটা খুব চেপে থাকে। নাকমুখে ব্যথা হয়। মাস্কের রিবনটা এত শক্ত যে, কারো কান কেটে যায় বা ফুলে যায়। এর মধ্য দিয়ে খুব ফিল্টার করে বাতাস ভেতরে প্রবেশ করে। এমতাবস্থায় আপনি যদি আগের মতো দ্রুতগতিতে কাজ করতে চান আপনি অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাবেন।

আগে টানা ১৮ ঘণ্টা কাজ করেছি, কোনো সমস্যা হয় নি। কিন্তু এখন টানা দুই-তিন ঘণ্টা পরই এ সমস্যাগুলো প্রকট আকারে শুরু হয়। কখনো কখনো মনে হয় পিপিই থেকে কখন মুক্তি পাব! কারণ পুরোটা সময়ে পিপিই পরে থাকতে হয়। টয়লেটে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। ওয়াশরুম যদি ব্যবহার করেন ড্রেসের পুরো সেট নতুন করে পরতে হয়।

আমার প্রথম ডিউটি ছিল রমজান মাসে। ডিউটি শেষে দেখলাম পায়ে একটা ফোঁড়া হয়েছে। যার জন্যে শরীর খারাপ লাগছিল বেশ। প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবনে কিছুদিনের মাথায় তা সেরে গেল। ডিউটি পেলাম নাইট শিফটের। সে-দিন ছিল শবে কদরের রাত। হাসপাতালে না থাকলে আমার কোয়ান্টাম পরিবারের সাথে একাত্ম হয়ে নৈশায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু সেদিনের ডিউটির অভিজ্ঞতা ছিল সবমিলিয়ে অবর্ণনীয়।

রমজান মাসে আল্লাহর রহমত ছিল বলেই আমার কোনো সমস্যা হয় নি। যখন খুব ক্লান্ত লাগত তখন গুরুজীর কণ্ঠে সিরাতের অডিও শুনতাম। ডিউটির বিরতিতে মেডিটেশন করতাম।

এ-সময়ে আমার একান্ত ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো-সংকটময় পরিস্থিতিতে রোগীদের সাথে পরিবারের মহিলা সদস্য (মা-বোন-খালা) হাসপাতালে আসেন বেশি। পুরুষরা সাধারণত সাথে থাকেন না। একদিন ইভনিং ডিউটি করছি। ইফতারের পর পর এক রোগী এলেন। তার সাথে স্ত্রী আর তার মেয়ে এসেছে। রোগীর শ্বাসকষ্ট। কী করবে? ইসিজি রুমে তাকে নিয়ে গেলাম। ইসিজি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে করতে রোগীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। অক্সিজেন দিতে হবে। অক্সিজেনের ব্যবস্থা রয়েছে ওয়ার্ডের ভেতরে, আমার রোগী তখনো ওয়ার্ডের বাইরে। ওয়ার্ড বয় ইফতার করতে গেছে। তাকে না পেয়ে আমি নিজেই সিলিন্ডার টেনে রোগীকে অক্সিজেন দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি সিলিন্ডারে অক্সিজেন নেই!

এখন রোগীকে ওয়ার্ডে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। রোগীর ওজন প্রায় ৮০ কেজির মতো হবে। কীভাবে নেব? ইসিজি টেবিলটাতেও চাকা লাগানো নেই। অবশেষে তার স্ত্রী, মেয়ে আর আমি মিলে কোনোমতে টেবিলটা ধাক্কা দিয়ে রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে গেলাম। ওখানে তাকে অক্সিজেন দেয়া হলো। কিন্তু ততক্ষণে রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় নি। করোনা ডিউটিকালে প্রথম মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হলো আমার। এখনো মনে হলে খারাপ লাগে।

১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন যেমন কাটল

কোয়ারেন্টাইনের সময়টা হোটেলে একা থাকতে হয়েছে। অবশ্য কোয়ান্টামের সদস্য হিসেবে কোয়ান্টায়নে দীর্ঘসময় মৌন থেকে মেডিটেশন ও আত্ম-পর্যালোচনা করার অভ্যাস যেহেতু আমার আছে, তাই একাকী কাটানো সময়টা অন্য সহকর্মীদের তুলনায় ভালো কেটেছে। কোয়ারেন্টাইনের সময়টায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল ঢাকার একটি হোটেলে।

হোটেলে আমার রুটিন ছিল-সকালবেলা যেদিন ঘুম থেকে আগে উঠতাম নামাজ পড়ে মেডিটেশন করতাম। হোটেলে নিয়ম ছিল, রুমের বাইরে ডিসপোজেবল বক্সে খাবার রেখে একজন হোটেলের স্টাফ দরজা নক করে যাবে। আমি নাশতা শেষে বাইরে বক্স রেখে দিলে এসে নিয়ে যাবে। আমাকে থাকতে হয়েছে একা একটা রুমে। কারো সাথে সরাসরি যোগাযোগ হয় নি। ফোন বা ভিডিও কলের মাধ্যমে যা যোগাযোগ। সকাল সাড়ে ৮টা বা ৯টার দিকে নাশতা করতাম। 

এরপর একটা লম্বা সময় ফোনে কথা বলতে হতো। কখনো রোগীরা ফোন দিতেন। কখনো হাসপাতাল থেকে ফোন আসত। আবার কখনো পরিচিত কেউ ফোন করতেন। এত মানুষের ভরসাস্থল যে হতে পারব সেটা কখনো ভাবি নি। বেলা ১২টার দিকে করতাম কোয়ান্টাম ইয়োগা। এরপর গোসল সেরে একই নিয়মে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতাম। নামাজ পড়তাম। এসময়ে অনলাইনে চিকিৎসকদের নিয়ে ক্লাস হতো। বিভিন্ন অধ্যাপকরা ক্লাস নিতেন। সেগুলো ফলো করতাম।

কোয়ারেন্টাইনের সময়টা মনে হতো বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপে আমি একা। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কয়েক রকম ড্রাই ফ্রুট যেমন খেজুর, বাদাম এবং দুধ ও টি ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ বাইরে যাওয়া নিষেধ। বিকেলে নিজের চা নিজে বানাতাম। আমার হোটেলের আশেপাশে আবাসিক এলাকা। জানালা দিয়ে লোকজন দেখতে পেতাম। দেখে ভালো লাগলেও মাঝেমধ্যে পীড়াদায়ক অনুভূতি কাজ করত যে, এত মানুষ রাস্তায় স্বাধীনভাবে হাঁটছে, ঘুরছে আর আমি পরিবার থেকে দূরে একা বসে আছি!

আমার অন্যান্য সহকর্মীদের রুমের জানালা খোলা যেত না। রাস্তাঘাট কিছু দেখা যায় না। একেবারে বন্দি জীবন ছিল তাদের। গুরুজী একবার তার আলোচনায় বলেছিলেন, ফাইভ স্টার হোটেলগুলো হচ্ছে বন্দি কারাগার। হোটেলে বসে আছি। সবকিছুই আছে কিন্তু কোথাও স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না-কোয়ারেন্টাইনের সময়টা আসলেই সে-রকম। হোটেলের খাবারদাবার ভালো। যে খাবার এক প্লেট নিমিষেই খেয়ে ফেলা যায় সেখানে দেখা যেত খাবারের একাংশ প্লেটেই থেকে যেত।

সবচেয়ে বেশি আবেগতাড়িত হয়ে পড়তাম বাসায় কথা বলার সময়। আমার দুই ছেলে। বড় ছেলের বয়স প্রায় পাঁচ বছর, ছোট ছেলের বয়স তিন বছর। তারা কেউ ফোনে কথা বলবে না। ভিডিও কল দিলে এক পলক দেখে দৌড়ে চলে যেত।

আমার যৌথ পরিবার। মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান, ছোট ভাইকে নিয়ে একসাথে থাকি। এই ডিউটি করা ও কোয়ারেন্টাইনে থাকা নিয়ে পরিবার থেকে প্রথমদিকে নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। বড় ছেলে এখন রীতিমতো ভয়ই পায়-কখন আমি চলে যাব। কবে ফিরব তা নিয়ে তার ভেতর অনেক প্রশ্ন। বাসায় ফেরার পর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত সে আমার সাথে থাকে। চোখে চোখে রাখে-বাবা আবার চলে যাবে না তো!

তবে মানুষ হিসেবে এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষের জন্যে কিছু করতে হবে-সে ভাবনা থেকেই কাজ করছি। আর আমি যে পেশায় আছি সেখানে কাজ করার সুযোগ আরো বেশি। আমি যতটা কাজ করতে পারব তা হয়তো অন্যদের দিয়ে করিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু তাতে তৃপ্ত হতে পারি না।

কোয়ারেন্টাইনের সময়ে উপলব্ধি হলো, আমাদের দেশের মানুষ কিছু ব্যাপারে এখনো বেশ অসচেতন। উদাহরণ দেই। আমি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি করোনা রোগী মাস্ক ছাড়া বসে আছে। গল্পগুজব করছে। কথা দিয়ে যখন কাজ হলো না, এক পর্যায়ে ধমক দিয়েই তাকে মাস্ক পরতে বাধ্য করতে হলো।

ডিউটির প্রথমদিনের আরেকটি অভিজ্ঞতা বলি-একজন সংকটাপন্ন রোগী দেখতে যাব ওয়ার্ডে। একজনকে দেখতে গিয়ে আমি আট জন রোগী দেখলাম। তার মধ্যে চার জনের অবস্থা গুরুতর ছিল না। সব ঠিকই আছে। সমস্যা হলো, তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাই শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য অসুবিধা হচ্ছে। মূলত আতঙ্কিত হওয়ার কারণে তারা শারীরিকভাবে দুর্বল বোধ করছেন। তাই রোগীদের সবাইকে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে পরামর্শ দেই।

প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষে ২১ দিন পর আমি বাড়ি ফিরেছি। বর্তমানে পরিবারের সাথে আছি। আগামী শুক্রবার (১৯ জুন ২০২০) থেকে হাসপাতালে আবার কাজ শুরু করব ইনশাল্লাহ! পরম করুণাময় যেন সকল কোভিড যোদ্ধাদের সহায়ক হোন-সবার কাছে সেই দোয়া চাই।

লেখক: মেডিকেল অফিসার, কার্ডিওলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি