ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪

ভূস্বর্গীয় রূপে চলনবিল

আহ্সান হাবীব 

প্রকাশিত : ২১:২২, ৩ অক্টোবর ২০২১

চলনবিল

চলনবিল

চলনবিল। চারদিকে বিশাল জলরাশি। শরতের সাদা মেঘ, কাশফুল আর স্থির মিঠা পানি চলন বিলকে দিয়েছে ভুস্বর্গীয় রুপ। তাই পর্যটকদের কাছে আর্কষনীয় স্থান হিসেবে চলনবিলের কদর বেশি। সাদা মেঘের ভেলার সাথে হঠাৎ দমকা-হাওয়া। হাওয়ার সাথে দোল খায় চলনবিলের বুকে মিশে থাকা নৌকাগুলো, দোল খেয়ে ওঠে মাঝিদের জাল। 

ষড়্ঋতুর এই দেশে প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায় চলনবিলকে। যে কোনো ঋতুতে চলনবিলের মূল আকর্ষণ নৌকাভ্রমণ ও বিলের পারের মানুষের ব্যস্ততার গ্রামীণ জীবনযাপন। হরেক রকম বাহারি নৌকা চলে এই বিলে। মাঝিদের গলা ছেড়ে গান, পাখিদের মন মাতানো মিষ্টি ডাক, ক্লান্ত পথিকের শীতল বাতাসে গাছের নিচে বিশ্রাম, রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ, চারদিকে জলরাশ্মির মাঝে হঠাৎ একটি রাস্তা এগিয়ে যায় গ্রাম থেকে শহরের দিকে। পুরো রাস্তা ধরে যেদিকেই তাকাই শুধু থই থই পানি, মেঘে ঢাকা আকাশের সাথে বিলের পানি আর জেলের দলের এক গভীর আত্মিক সর্ম্পক যেন চলে আসছে যুগযুগান্তর ধরে। নৌকা বিহীন চলনবিল যেন কল্পনাকেও হার মানায়।

চলনবিলে নিরাপদে নৌকায় ভ্রমণ করার জন্য শরৎই শ্রেষ্ঠ সময়। শান্ত বিলে এসময় কোন ঢেউ না থাকায় আপনি খুব সহজেই ঘুরতে পারেন, দেখতে পারেন এই বাংলার রূপ।

নৌকা ভাড়া করে প্রয়োজনীয় লাইফ জ্যাকেট এবং নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিয়ে আপনি দল বেঁধে ঘুরেতে পারেন বিল পারে। বিলপাড়ের মানুষ খুব সাধারণ আর সাদা মাঠা জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ধান, পাট, আর মাছধরা নিয়েই কেটে যায় দিনের অর্ধেক সময়। ছেলে,যুবক,বৃদ্ধ সবাই এখানে ব্যস্ত। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা বিপর্যয়ের কারণে চলনবিলের রূপ ঠিক আগের মতো নেই বললেই চলে। তলদেশে পলি জমে  দিন দিন কমছে বিলে গভীরতা। হারাচ্ছে নানা প্রজাতির মাছ।

বিলের প্রাচুর্যতাঃ
বিশালতার দিকে থেকে চলনবিল দেশের অন্যতম বড় বিল। ১৯০৯ সালে চলনবিলের জরিপের এক প্রতিবেদনে আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। এর মাঝে মাত্র ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকে। অবাক করার তথ্য এটাই যে, মাত্র ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের জায়গার মাঝে রয়েছে ৩৯টি বিল। এই ৩৯টি বিলসহ মোট ৫০টির ও বেশি বড় বড় বিলের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে আজকের চলনবিল।

বিলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কচুগাড়ী বিল, চাতরার বিল, নিহলগাড়ি বিল, চেচুয়া বিল, টেঙ্গরগাড়ি বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরী বিল, কুমিরা বিল, বেরোল বিল, কাতল বিল, বাঘ মারা বিল, পাতিয়া বিল, আইড়মারি বিল ইত্যাদি।

চলনবিলের বৈচিত্রতাঃ
চলনবিলে রয়েছে ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তনের ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি খাল ও অসংখ্য পুকুর। এসব নদ-নদী ও খালগুলোর মধ্যে রয়েছে আত্রাই, করতোয়া, বড়াল, মরা বড়াল, তেলকুপি (মরা আত্রাই), নবী হাজির জোলা, হক সাহেবের খাল ইত্যাদি

এক সময় মাছেদের বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিলো চলনবিল। বিলের মাছ ট্রেনযোগে যেত বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। মাছের সে সমাহার এখন তেমনটি না থাকলে বহু প্রজাতির দেশি মাছের দেখা মিলবে বিলে। এর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, শিং, মাগুর, কই, শোল, গজার, টাকি, বাইম, পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, টাটকিনি, ভেদা ও চাঁদা। বিলের যেখানেই পানি আছে, সেখানেই চোখে পড়বে মাছ ধরার ধুম। সুতিজাল, ভেশাল, খাঁড়া জাল, দোয়ার, চাঁই, বড়শিসহ বিভিন্ন মাছ ধরার যন্ত্র নিয়ে মেতে আছেন সব বয়েসের মানুষ।
শরতের চলনবিলের রূপবিকাশে আরেকটি প্রধান আর্কষণ হচ্ছে জাতীয় ফুল শাপলা। এছাড়াও পদ্ম, কচুরিপানা ও বিলের নিচে থেকে গজিয়ে ওঠা ঘাস সৌন্দর্য বর্ধন করে থাকে। আর নানা রঙের বুনো ফুলের সাথে আছে সবুজ ধানের খেতে সাদা বক আর জলে পানকৌড়িদের ডুবসাঁতার খেলা। 

চলনবিল নামকরণ অতীত কথাঃ
চলনবিলের নাম করণের ইতিহাস আজও অজানা। বিশাল এই বিলকে কেন চলনবিল নামে ডাকা হয়, এর সঠিক উত্তর আজো কারো জানা নেই। তবে কথিত আছে, দুই হাজার বছর আগেও চলনবিল নামের কোন অস্তিত্ব ছিল না। এই অঞ্চল ছিল তখন সমুদ্রগর্ভে। কালের বিবর্তনে সমুদ্র সরে যায় দক্ষিণে। ব্রিটিশ গেজেটিয়ারে উল্লেখ রয়েছে, সমুদ্র সরে যাওয়ার পর তার স্মৃতি ধরে রেখেছে চলনবিল। অন্যান্য বিলের মতো এই বিল স্থির নয়। তাই হয়তো নদীর মতো তেমন কোন স্রোত ছিল বলেই এর নাম হয়েছিল চলনবিল।

‘ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ নামক বই থেকে জানা যায়, নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল শেরপুর মিলেই বিশাল আয়তনের চলনবিল। ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ স্থাপনের পর উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণ সহ তিন অংশে চলনবিল বিভক্ত হয়। বর্তমানে চলনবিল নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনার চাটমোহর, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জে অবস্থান করছে।

এছাড়াও নাটোরের গুরুদাসপুরে খুবজিপুরগ্রামে দেখা যাবে চলনবিল জাদুঘর। এখানে পাবেন চলনবিলের বিভিন্ন ঐতিহ্যময় জিনিসপত্র। শান্ত জলরাশির, নির্মল বাতাসে ভরপুর প্রকৃতি আর প্রাচীন নিদর্শন দেখতে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল থেকে। চলনবিলে আসার সময় ক্যাপ, সানগ্লাস, খাবার পানি নিয়ে আসতে ভুলবেন না কিন্তু।

চলনবিলে যাওয়ার উপায়ঃ
ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের মোড়ে আসবেন। এরপর সিরাজগঞ্জের মোড় থেকে কাছিকাটা অথবা নয়াবাজার নেমে পড়বেন (ভাড়া ৪০ টাকা)। সরাসরি ঢাকা থেকে রাজশাহীর গাড়িতেও আসতে পারেন। নাটোরের কাছিকাটা থেকে বাইপাস রাস্তা ধরে পাবনার চাটমোহর। কাছিকাটার বিলসা যেতে ভুলবেন না কিন্তু। দেশের অন্য যেকোনো স্থান থেকেই খুব সহজে বাসে আসা যাবে নাটোরে। কাছিকাটা নামলে সেখান থেকে ছোট-বড় নৌকায় চলনবিল ঘোরা যাবে। অন্যদিকে ব্যাটারিচালিত নৌকায় বিলের ধরে ঘুরে বেড়ানো যাবে।

বেচেঁ থাকুক চলনবিল, টিকে থাক জীববৈচিত্রঃ 
চলনবিলের সৌন্দর্য থেকে কবি জীবনান্দদাশের কবিতা মনে পড়ে যায়। বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর”।

নৌকা, নদী, জাল আর শ্রমের ঘামে বড় হওয়া বিলপাড়ের মানুষের সংগ্রামের জীবন চলে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। বাপ-দাদার পেশাকে এখনো অনেকে লালন করেন আদর আর ভালবাসা দিয়ে। প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা এসব মানুষের করণে বেচেঁ থাকে আমাদের গ্রামীন জীবন। বেচেঁ থাকে বাংলাদেশের মূল শিকর গ্রাম। 
কেআই//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি