ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

মহীয়সী নারী ফজিলাতুন নেছার জীবনালেক্ষ্য

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

প্রকাশিত : ০৯:৩৪, ৯ আগস্ট ২০২০

১৯৯৭ সালের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে একজন সদস্য বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার নামে একটি হল নির্মাণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রস্তাব তুললে সারা হল নিবিড় নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত হয়। ধারণা করা হচ্ছিল সে হাউজের বিপুল সংখ্যক বিএনপি ও জামাত সমর্থক সদস্যরা তার প্রতিবাদ করবে যদিও উপাচার্যের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন অধ্যাপক ড. এ. কে. আজাদ চৌধুরী। কোন আলোচনা বা সংশোধনী ব্যতীত সে প্রস্তাবটি সমর্থিত ও গৃহীত হয়। ১৯৯৭ সালে গৃহীত এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে ২০০০ সালে শেষার্ধে এই হলের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয় এবং ১৮ সেপ্টেম্বর তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে হলের উদ্বোধন করেন।

সে হলের উদ্বোধন নিয়ে কোন ক্রোড়পত্র প্রকাশ হয়নি। তবে অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী স্ব উদ্যোগে বর্তমানে বিলুপ্ত বাংলার বাণী পত্রিকায় বেগম ফজিলাতুন নেছার অবদান বিবৃত করে একটি নিবন্ধ লিখেন। এই নিবন্ধ পড়ে জনৈক অধ্যাপিকা মন্তব্য করেন ‘অবদান ত প্রতিনিয়ত হাড়ি ঠেলা পর্যন্ত।’ আমি দুঃখ পাই এবং তা বাগ্ময় করার প্রয়াস চালিয়ে যাই। আজকের নিবন্ধটিও সে দুঃখ বেদনা থেকে উৎসারিত। আশা করি সেই জ্ঞান পাপী অধ্যাপিকা ও জ্ঞান অন্বেষায় লিপ্ত সকল মানুষ এই নিবন্ধ থেকে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার জন্ম ও বংশ পরিচয়, তার পারিবারিক জীবন, তার সংগ্রাম, ত্যাগ তিতিক্ষা, তার অনন্য গুনাবলী ও নেতৃত্বের স্ফুরণ; একজন মুজিবের গিন্নি ও অনেক মানুষের বোন, ভাবী ও নেত্রী হিসাবে ও একজন মুজিবকে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসাবে রূপান্তরে তার ভূমিকা সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবগত করতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম তার আদর্শে গড়ে উঠবেন। 

শেখ ফজিলাতুন নেছা শেখ জহুরুল হক ও হোসনে আরা বেগমের দ্বিতীয় ও শেষ সন্তান। তিনি ১৯৩০ সালের ৮ আগষ্ট টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারে জন্ম নেন। জন্মের ৩ বছরের মাথায় তিনি পিতাকে ও ৫ বছরের মাথায় মাকে হারান। তার ডাক নাম ছিল রেণু। অবস্থার প্রেক্ষিতে অতি ছোট বয়সেই শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবের সাথে তার বিয়ে দেয়া হয়। ফজিলাতুন নেছা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরিবারের সে সময়কার রীতি মোতাবেক তিনি গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়াশুনায় নিয়োজিত থাকেন। ছোট বেলা থেকে লেখাপড়া ও জ্ঞান অর্জনের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল; পরবর্তী জীবনেও প্রচুর দেশী-বিদেশী বইপত্র পড়াশুনা করেছেন ও স্বামী সান্নিধ্যে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রভূত জ্ঞানার্জন করেন। তার ছোট ছেলে রাসেলের নামকরণটা তিনি জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামেই করেছিলেন। অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মত নয়, বার্ট্রান্ড রাসেলের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অবগত হয়েই তিনি তা করেছিলেন। এখনকার দিনে এদেশের এম এ পাশরাও বার্ট্রান্ড রাসেল কেন, সার্জেন্ট জহুর ও আগরতলা মামলা সম্পর্কে কিছু জানে না।

শেখ মুজিব জীবনে প্রথম জেলে যান অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র হিসাবে। রেণুর তখনও এতসব বুঝার বয়স হয়নি। কিন্তু ১৯৪৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যখন তিনি দ্বিতীয়বারের জন্যে জেলে যান তখন রেণু গভীরভাবে বিচ্ছেদ বেদনা অনুভব করেন। তবে সেই যে শুরু, সেই শুরু থেকে জীবনের সুবর্ণ সময়ের অধিকাংশটা কেটেছে একা বাচ্চাদের নিয়ে। নিজ হাতেই তিনি যেমন জনসভার কাপড় নেতার হাতে তুলে দিয়েছেন, নিজ হাতে আবার জেলের কাপড়ও তুলে দিয়েছেন।

১৯৫৪ সালে বেগম মুজিব প্রথম ঢাকা আসেন এবং একত্রে স্বামীর সাথে বসবাস করতে থাকেন। তিনি হয়ে উঠেন ব্যস্ত মুজিবের কাজের সাথী, ক্লান্ত মুজিবের সেবা ও পরামর্শদাত্রী এবং ক্ষেত্রভেদে বন্ধু, দার্শনিক ও পথ নির্দেশক। ১৯৫৪ সালে মন্ত্রীত্ব পেয়ে মুজিব পরিবার রজনী চৌধুরী লেনের বাড়ী ছেড়ে ৩নং মিন্টু রোডের বাড়ীতে উঠেন। কিন্তু ২৯ মে পাকিস্তান সরকার মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিলে এবং শেখ মুজিব জেলে বন্দি হলে বেগম মুজিব পুলিশ হয়রানির শিকার হন। বাড়ী খুঁজতে তাকে রাস্তায় নামতে হল ও মামলার জন্যে উকিলের কাছে ছুটাছুটি করতে হল। একই সাথে শেখ হাসিনা, কামাল এর পড়াশুনা, শ্বশুর-শাশুড়ির পরিচর্যা, আত্মীয় স্বজন ও দলীয় কর্মীদের দেখভাল করার দায়িত্বও তার কাঁধে পড়ল। তিনি গোপনে গয়নাপত্র বিক্রি কিংবা পিতৃ সম্পত্তি বিক্রি করে উপরিউক্ত কাজগুলো সম্পাদন করতেন। একবার বিপদে পড়ে অতি প্রিয় রেডিওগ্রামটাও তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এসবই ছিল তার বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য্য ও আত্মবিশ্বাসের পরীক্ষা। পরবর্তী জীবনের প্রতিটি কাজে আত্মবিশ্বাস, স্বামীর প্রতি অনন্ত প্রেম ও সন্তানদের প্রতি অনন্য ভালবাসার সব পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হোন।

১৯৫৫ সালে শেখ মুজিব গণপরিষদ সদস্য হন, মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন, সরকারী বাড়ীতে চার সদস্যের পরিবারটি উঠে কিন্তু ঘর গোছাবার আগেই শেখ মুজিব মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। মন্ত্রীর বাড়ী ছেড়ে তিনি ব্যক্তিগত বাড়ীতে উঠলেন। তবে শেখ মুজিব টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হলে আবারও একটি বাড়ী পান। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তান সরকার সামরিক শাসন জারী করে রাজনীতি বন্ধ করলে মুজিব কারারুদ্ধ হোন এবং তার পরিবার আবার বাড়ী খুঁজতে শুরু করে। রাজরোষে পড়া পরিবারটিকে অতি কষ্টে সেগুন বাগিচার বাসায় উঠতে হলো। ১৯৬১ সালে শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পান এবং আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানীতে চাকুরী নেন। ১৯৬১ সালের ১লা অক্টোবর পরিবারটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ীতে উঠে আসে। এই বাড়ীতে একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা হলেও রেণুর জীবনে স্থিতিও নিশ্চয়তা কিন্তু ফিরে আসেনি। ১৯৬২ সালে মুজিব আবার গ্রেফতার হন। আবার ছাড়া পান। ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় তার এক বছরের সাজা হয়। এইসব মামলা পরিচালনা করা এবং নেতার কাছে খবরাখবর পৌঁছিয়ে দেয়া কিংবা নেতৃত্বের সংকট নিরসন ছাড়াও ফজিলাতুন নেছা পরিবারের বন্ধন অটুট রেখেছেন।

১৯৬৬ সালে বাঙালীর মুক্তি সনদ ৬ দফা প্রচন্ড গণজোয়ার ও গণ জাগরণ সৃষ্টি করে। নেতা মুজিব জেল-জুলুম, হামলা-মামলার সম্মুখীন হন। এই সময়ে দলের এক শ্রেণির কুচক্রী ৬ দফার বদলে ৮ দফার আন্দোলন করবেন বলে দলে বিভক্তি ও বিভাজনের সূচনা চেষ্টা করে। সেদিন দৃঢ় প্রত্যয়ী ফজিলাতুন নেছার হস্তক্ষেপে ৮ দফাওয়ালারা হেরে ও চুপসে যায় এবং ৬ দফা মূলতঃ ১ দফা তথা আমাদের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত হয়। সেদিন বেগম মুজিব দূরদর্শী, সাহসী এবং অনেকটা রুক্ষ ভূমিকা পালন না করলে বাংলার ইতিহাস ভিন্নতর হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, ৬ দফার দাবীতে ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৭ জুনের পেছনে তার অবদান অপরিসীম ছিল। সে দুঃসময়ে ৩২ নম্বর দিয়ে হাঁটতেও মানুষ ভয় পেত। একটা পাতা পড়লে তার আওয়াজ শোনা যেত। বিরান বাড়ীতে বসেও বাজার খরচের পয়সা জমিয়ে আন্দোলন সংগ্রামকে বাঁচিয়ে রাখেন। ১৯৬৬ সালের মে মাস থেকে শেখ মুজিব স্থায়ীভাবে জেলে চলে গেলেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে বিচারের সম্মুখীন হলেন। আত্মীয়-পরিজন, রাজনৈতিক সহযোগী, ছাত্র শ্রমিকরা এক পর্যায়ে ধরেই নিয়েছিলেন যে এ যাত্রায় শুধু শেখ মুজিব শেষ হবে না, তার পরিবার ধ্বংস হবে, তার রাজনীতি খতম হবে। নিঃসীম এই জমাট আঁধারে এক দৃঢ় প্রত্যয়ী নারী পথ হাতড়ে পথ চলতে শুরু করলেন। এ সময় এক মাত্র তরুণ ছাত্র নেতারা ছাড়া অন্যান্য বহু রাজনৈতিক নেতা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব তাদের সংশ্রব ত্যাগ করতে শুরু করলেন। ১৯৬৭ সালে স্বামীর অবর্তমানে শেখ হাসিনার বিয়ের ব্যবস্থা বেগম মুজিবই করেছিলেন।

১৯৬৮ সালের শেষে অবস্থার পরিবর্তন দেখা গেল। ১৯৬৯ সালের প্রথমেই ৬ দফার দাবীসহ ছাত্রদের ১১ দফা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করল। বেগম মুজিব ছাত্র নেতাদের সাথে আলোচনা এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রাপ্ত নেতা মুজিবের তথ্য ও নির্দেশে এ আন্দোলনের নেপথ্যে  রূপকারের ভূমিকা পালন করলেন। গণ-অর্ভূত্থানের কারণে শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে রাওয়াল পিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক ডাকা হোল। সেদিন আপোষ মীমাংসার টেবিলে নেতা মুজিব যোগ দিলে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন সৈকত দূরে সরে যেত কিংবা স্বাধীনতার স্বপ্নই হয়ত বাস্তবায়িত হতো না। বেগম মুজিবের দৃঢ়তা, অনমনীয়তা ও লক্ষ্যাভিমূখীতার কারণে সে দিন বঙ্গবন্ধু প্যারোলে নয় সম্পূর্ণ মুক্ত মানুষ হিসেবেই গোলটেবিলে গিয়েছিলেন। স্বামীর চূড়ান্ত লক্ষ্য, কর্মকৌশল ও কর্মপন্থা সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন বলেই তার অনুপস্থিতিতে সংকটে ও ক্রান্তিলগ্নে রেণু দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে নেতার আসনে চলে আসতে পেরেছিলেন। গোলটেবিলে যাবার আগেই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়।

সামরিক শাসনের বেড়াজালেই ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে যান। সেই সাধারণ নির্বাচনেও বেগম মুজিব বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। দলের ত্যাগী-যোগী নেতা-নেত্রীদের দুঃসময়ে দেখার সৌভাগ্য তার হয়েছিল বিধায় প্রার্থী নির্বাচনে তিনি সঠিক পরামর্শ দিতে পেরেছিলেন এবং দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনে জয়ী নেতা মুজিব ৬ দফার প্রশ্নে অনড় থাকতে প্রকাশ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শপথ পাঠ করান। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপ নিঃশেষ করার এক পর্যায়ে তিনি ৭ মার্চের ভাষণটি দেন। এই ভাষণের ব্যাপারে দলের তেমন কোন নেতা অবগত ছিলেন বলে মনে হয় না, তবে বেগম মুজিব অবগত ছিলেন।

এর আগে ও পরে ছাত্র যুবকরা বঙ্গবন্ধুকে কাছে না পেলেও বেগম মুজিবের মাধ্যমে সব খবরই নেতার কাছে আদান প্রদান যেত। ফলে নেতা সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারতেন। তাঁর অনেক জটিল ও কঠিন সিদ্ধান্তও বেগম মুজিব নিজেই দিয়ে দিতেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাতের একটি কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে রাতে তিনি স্বামীকে বললেন, ‘এতোদিন ধরে আলাপ আলোচনা করলে, ফলাফল কি হলো কিছুইত বলছো না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সাথে কোন সমঝোতা কর, তাহলে এদেশের জনগণ তোমার উপর ক্ষুব্ধ হবে, অপরদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী তাদের সুবিধামত সময়ে তোমাকে হত্যা করবে। জনগণ স্বাধীনতা চায়।’

কার্যতঃ জাতির সকল ক্রান্তি লগ্নে প্রেরণা ও শক্তিদায়িনী এই রমণী ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণাকেও প্রভাবান্বিত করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার কিছু পরেই নেতা বন্দী হোন; সেদিনও বেগম মুজিব সেই আগের মতই স্বামীর স্যুটকেস গুছিয়ে দেন, অসহায়তা ও অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে স্বামীর পথ তিনি আগলে ধরেননি কিংবা কারও কাছে করুণা ভিক্ষা করেননি। বঙ্গবন্ধু বন্দী হওয়ার তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭১ সালের ১১ মে পর্যন্ত তিনি ঢাকা শহরে পলাতক জীবন যাপন করেন। কিন্তু ১২ মে থেকে হানাদার বাহিনী স্বপরিবারে তাকে ধানমন্ডির তদানিন্তন ১৮ নং সড়কের ২৬ নং বাড়ীতে বন্দী করে রাখে। এই বাড়ী থেকে পালিয়ে জামাল মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। এ বাড়ী থেকে সংগোপনে বেগম মুজিব ও তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা কৌশলগত খবর ও নির্দেশ পাচার করতেন। যুদ্ধ পরিচালনার কাজে বিশেষতঃ মুজিব বাহিনীর সামগ্রিক কর্মকান্ডে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের জন্ম কিংবা শেখ লুৎফর রহমানের অসুস্থতা শাপে বর হয়ে মুজিব বাহিনী বা যুদ্ধের সাথে যোগাযোগটা প্রশস্ত করে। যোদ্ধারা কিংবা সংবাদ বাহকরা বরং হাসপাতালে অধিক স্বচ্ছন্দে খবরাখবর পাচার করতে পারতেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান পরাস্ত ও আত্মসমর্পণ করলেও বেগম মুজিব ১৭ ডিসেম্বর মুক্ত হোন। তিনি পাহারারত হাবিলদারকে নিরস্ত্র করেন ও পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে তা পা দিয়ে মাড়িয়ে দেন। তারপর নেতার পাশে থেকে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ী ও সংসার গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করলেন, পাশাপাশি বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও স্বামীকে সহযোগিতা করতে সচেষ্ট হলেন। বিশেষ করে লাঞ্ছিতা মা-বোনকে সহযোগিতা করা, তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে গিয়ে সান্তনা দেয়া, সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন তিনি। ধীরে ধীরে অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে তিনি সামাজিকভাবে মর্যাদা সম্পন্ন জীবন দান করেন।

তারপরও আগের মতই স্বামী সান্নিধ্য একটা বিরল ঘটনা ছিল। নেতা জনগণ নিয়েই ব্যস্ত, সমস্যার পাহাড় জমছে, নেতা নেত্রীদের লোভাতুর আচরণ তাকে ব্যথিত করছে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবার পর আবারও রেণুর নিঃসঙ্গতা বাড়ল। ষড়যন্ত্রের ডালপালা বাড়ছে দেখেও তাকে আগের মত তেমনটা প্রতিহত করতে পারলেন না। তারপর ধীর পায়ে এলো ১৫ আগষ্টের কালো রাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের কালো রাতেও সেই পতিব্রতা নারী তার স্বামীর জন্য খাবার রান্না করে নিজ হাতে সযত্নে খাইয়েছেন। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তার সন্তানদের হত্যা করেছে জেনেই তিনিসহ মরণে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন। নিভে গেল এমন এক জীবন যে জীবন শুধু স্বামী সন্তান নয়, জাতির জন্যেও উৎসর্গিত হলো। এরই মাঝে তিনি গৃহবধূর জীবন থেকে উত্থিত হয়েছিলেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও জাতির পিতার জীবনে।

বস্তুতঃ তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সুখ দুঃখের সাথী ছিলেন না, তার আদর্শের মশাল বর্তিকা সম্পূর্ণটাই বহন করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা দিয়ে, শক্তি দিয়ে এবং কখনও প্রত্যক্ষ আন্দোলনে হস্তক্ষেপ কিংবা নির্দেশ দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন ও যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়েছেন। আগেই বলেছি বাংলার জনগণের চাওয়া পাওয়া ও বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন বলেই তিনি নেতার উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতিতে নেতার কর্ম কৌশল ও কর্মপ্রক্রিয়া সহজেই বলে দিতে পারতেন। কার্যতঃ দেখা যাচ্ছে স্বামীকে তিনি সাহস, মনোবল, প্রেরণা ও শক্তি যোগানো ছাড়াও মাঝে মাঝে স্বাধীনতার অগ্র মশাল বহণ করেছেন। আজ বাংলার মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে, আত্ম-পরিচয়ের সুযোগ পেয়েছে, বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেয়েছে একটি দেশ ও একটি জাতি। ফজিলাতুন নেছার যদি বিপরীত ভূমিকা থাকত কিংবা ভঙ্গুর অবস্থান হত তা হলে কি শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হতেন, জাতির পিতা হতেন, দেশ স্বাধীন হোত কিংবা শেখ মুজিব অন্তিমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে ভূষিত হতেন?

বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের উপেক্ষিতা উর্মিলা ফজিলাতুন নেছা শিশু বয়সে বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঘরণী হয়ে আসেন। এই অবুঝ, অবলা, অনাথ মেয়েটিই কালে মহাকাব্যের মূল নায়ক মুজিবের প্রধান চালিকারূপে আবির্ভূত হন। নীরবে, নিভৃতে এই মহিলা স্বামী সেবা, সন্তান লালন, পিতৃতুল্য শ্বশুর-শাশুড়ী, দেবর-ননদ সবারই পরিচর্যা করেছেন। তদুপরি ফজিলাতুন নেছা মুজিব গৃহাভ্যন্তরে এমন একটি পরিবেশ উপহার দিয়েছিলেন যার ফলে নেতা মুজিব দুর্গমগিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার পাড়ি দিতে পেরেছিলেন; নিশ্চিন্তে তার সংগঠন ও জনগণের জন্যে নিজের মূল্যবান জীবনও বিসর্জন দিতে পেরেছিলেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও দক্ষতার অধিকারী এই মহিলা পরিণত বয়সে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ও তথ্যের আধার ছিলেন। স্বামীর সুষ্ঠু সিদ্ধান্তে মনস্তাত্তিক সহযোগিতা ছাড়াও তার দেয়া তথ্য নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তে সহায়ক হয়েছে।

আজ তিনি আমাদের নয়নের কাছে না থাকলেও নয়নের মাঝে ঠাঁই নিয়েছেন। তার পতিপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা, সহনশীলতা, একাগ্রতা, দূরদর্শিতা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, সাহসিকতা ও দেশপ্রেম তাকে বঙ্গবন্ধুর মতই অমরত্ব দান করেছে। তার স্বরে বলছি, একজন পুরুষ ও নারী স্বামী-স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়ে যখন সুখী সংসার গড়ে তোলেন তখন তাদের চিন্তা ও কর্মের দূরত্ব গুছে যায়; তাদের একজন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গপিতা হলে পর অপরজন নিঃসন্দেহে বঙ্গমাতা হয়ে যান। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব এ পরিচয়েই আমাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন জুড়ে আছেন ও থাকবেন। 

শেখ হাসিনার ভাষায়, “এ’কথা অনস্বীকার্য যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পত্নী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব এ’দেশের ইতিহাসে একজন অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সুখ দুঃখের সাথী ছিলেন না কিংবা বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা ও শক্তির উৎস ছিলেন না, তিনি প্রত্যক্ষ আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করে স্বাধীনতা আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়েছেন এবং স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে অনেক জটিল পরিস্থিতিতে তিনি স্বামীর পাশে থেকে সৎ পরামর্শ দিতেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতেন। বঙ্গবন্ধু তার সাথে অনেক শুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি সংগঠনের নেতা কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন ও প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন।”

“সারাটি জীবন তিনি শুধু ত্যাগই করে গেছেন। তাইতো বাংলার মানুষ পেয়েছে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ, পেয়েছে আত্ম-পরিচয়ের সুযোগ, বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেয়েছে একটি দেশ, আত্ম-পরিচয়ের সুযোগ পেয়েছে একটি জাতি। নির্দ্বিধায় বলা যায় শেখ মুজিবের জন্ম না হলে আমরা আজও পরাধীন থাকতাম। তবে তার দাম্পত্য জীবনে বেগম ফজিলাতুন নেছার মত এমন ধীর স্থির, প্রাজ্ঞ, সর্বংসহা, বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদর্শী ও স্বামী অন্তপ্রাণ নারীর অবির্ভাব না হলে শেখ মুজিব বঙ্গশার্দুল, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা কিংবা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী হতেন কিনা সন্দেহ।”

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন ত্যাগ-তিতিক্ষায় ভাস্বর ও সহিষ্ণুতায় অতুলনীয়, সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় অনন্য; নেতা মুজিবের defecto friend, philosopher and guide। কার্যত: তিনি যদি আত্ম সর্বস্ব হতেন, লোভাতুর বা সংসার সর্বস্ব হতেন, তাহলে শেখ মুজিবের সাধ্য ছিল না বছরের পর বছর কারাগারে থাকা, স্বাধীনতা সংগ্রামের দু:সাহসী পথে যাত্রা করা; তাতে নেতৃত্ব দান এবং সংগ্রামের যৌক্তিক পরিণতিতে উপনীত হওয়া। বেগম মুজিব চাইলে একজন সাধারণ ধনী গৃহবধু হতে পারতেন, তদানিন্তন পূর্বপাকিস্তানের গভর্ণরের স্ত্রী কিংবা অখন্ড পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রীর পত্নী হতে পারতেন। বেগম মুজিব যদি চাইতেন গাড়ীবাড়ী ও ছেলে মেয়েদের নিশ্চিত ও আয়েশী ভবিষ্যৎ; তাহলে শেখ মুজিব এত বড় মাপের নেতা হতেন কিনা সন্দেহ। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘একজন নারী ইচ্ছে করলে আমার জীবনটা পাল্টে দিতে পারতেন।’ সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস পাল্টে যেত।

লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সভাপতি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব পরিষদ।
(আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত)

এমএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি