ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণ, ইতিহাস বিকৃতি ও শেখ মুজিব

সালাহ্‌উদ্দীন আহমদ

প্রকাশিত : ১৬:০০, ২২ আগস্ট ২০১৯

উনিশশ’ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সমকালীন ইতিহাসের ঘটনা। আমরা অনেকেই যারা এখনও জীবিত আছি, তারা এর সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। কিন্তু বড়ই আশ্চর্য এবং পরিতাপের বিষয় যে, পনের আগস্ট ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যে গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র ও অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি এবং পাকিস্তানের সমর্থক ছিল তারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করতে শুরু করল। বলা যেতে পারে, এই প্রক্রিয়া গত ২০-২১ বছর ধরে চলে আসছে। এর ফলে আমাদের নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বন্ধে নানারকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

তাই এই সময়ে যখন আওয়ামী লীগ- যার নেতৃত্বে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল গত নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর পর পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে- এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ এবং সঠিক ইতিহাস রচনা করার সময় এসেছে। এই মহান দায়িত্ব কেবল পেশাদার ইতিহাসবিদদের পক্ষে এককভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। দেশের সচেতন ও বিবেকবান নাগরিকদের বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী তাদের সকলের সহযোগিতায় এই ইতিহাস রচনার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওরাল হিস্ট্রি (oral history) গবেষণা পদ্ধতি বিশেষভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। ইতিহাস অনুসন্ধানের জন্য (oral history)  বা মৌখিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন পদ্ধতি।

ইতিহাসের গবেষকরা যেসব উৎসের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা করে থাকেন সেগুলো হলো প্রধানত লিখিত দলিল, পুস্তক-পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকা, চিঠিপত্র, ডায়রি ইত্যাদি। মৌখিক ইতিহাস বা ওরাল হিস্ট্রি এসব থেকে ভিন্ন এই অর্থে যে, এটি মৌখিক তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। একজন ব্যক্তি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি যেসব মানুষকে জেনেছেন বা যেসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন বা যেসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সেসব বিষয়ে তথ্য প্রদান করেন। তবে এ ধরনের মৌখিক তথ্য লিখিত দলিলের বিকল্প নয়, এগুলো হলো তার পরিপূরক।

সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যার উদ্দেশ্য হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ব্যাপক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন ঘটনাসমূহের সাক্ষী, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, নিপীড়ন ও অত্যাচার স্বচক্ষে দেখেছেন বা সেগুলোর শিকার হয়েছেন। তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনুসন্ধানকারীদের দ্বারা টেপরেকর্ডারের সাহায্যে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারলে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বহুবিধ মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ঠিক এই কাজটি হাতে নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক সাক্ষাৎকার গ্রহণের ফলে যেসব তথ্য সংগৃহীত হচ্ছে সেগুলি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে কেন্দ্রের সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হবে। এগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণের কাজে অত্যন্ত সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির সর্বকালের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। বাঙালির এই মহান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

পাকিস্তান আমলে আমাদের এই অঞ্চলটাকে পূর্বপাকিস্তান বলা হতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকসামরিক শাসকগোষ্ঠীর ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে এই অঞ্চলকে ‘বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করতে শুরু করলেন। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তাকে তিনি জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে এ দেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এক ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

বস্তুত আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ফসল। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো হঠাৎ করে শুরু হয়নি। এটি ছিল এই বাংলাদেশের মানুষের ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের দীর্ঘকালের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। এই আন্দোলনটা ছিল প্রকৃত অর্থে জাতীয়তাবাদী বা ন্যাশনালিস্ট আন্দোলন। আধুনিক জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশনালিজম ভূভিত্তিক চেতনা থেকে উদ্ভূত। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগণের আত্মপরিচয় এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভয়-ভাবনা সম্বন্ধে সম্মিলিত চেতনা বা ‘কালেকটিভ কনশিয়াসনেস’ হলো জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি। এই জাতীয় চেতনা ধর্মভিত্তিক বা গোষ্ঠীভিত্তিক বা সম্প্রদায়ভিত্তিক চেতনা নয়। এটি হলো প্রধানত এবং মূলত অসাম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এই অর্থে যে, একটি ভূখণ্ডের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের আত্মপরিচয়; নিজেদের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান সম্পর্কে সম্মিলিত চেতনা থেকে এই জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্বে আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এই ধরনের সম্মিলিত চেতনার অভাব ছিল বলা যায়। যেমন এই অঞ্চলের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান বাঙালি হলেও তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় বাঙালির চেয়ে তাদের ধর্মীয় পরিচয় ‘মুসলমান’কে বেশি প্রাধান্য দিত। এর পেছনে নানাবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ ছিল যেগুলো এখানে বিশদভাবে আলোচনা করার অবকাশ নেই। প্রাক ১৯৪৭ সময়কালে বাঙালি মুসলমানরা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের সঙ্গে ধর্মীয় ঐক্যের ভিত্তিতে একাত্ম হয়ে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন করেছিল। তাদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে, যেহেতু ভারতের মুসলমানরা এক ইসলাম ধর্মাবলম্বী, সুতরাং তারা এক অখণ্ড এবং স্বতন্ত্র জাতি বা নেশন এবং এক স্বতন্ত্র সংস্কৃতি বা তমদ্দুনের উত্তরাধিকারী। সুতরাং এক স্বতন্ত্র আবাসভূমি বা হোমল্যান্ড অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে পারে।

কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই বাঙালি মুসলমানরা ক্রমশ বুঝতে শুরু করল যে, যে ভিত্তির ওপর পাকিস্তান নামক একটি কিম্ভুতকিমাকার রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল সেটি ছিল অলীক বা মীথ এবং অনৈতিকহাসিক। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বিশাল ভারত ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানরা কখনও এক বা হোমোজেনিয়াস (Homageneous) জাতি বা সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে ওঠেনি, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানরা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের চেয়ে ভাষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে একেবারে স্বতন্ত্র। বরং ভাষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে তারা বাঙালি হিন্দুদের অনেক কাছাকাছি। বাংলার হিন্দু ও মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা যে এক অভিন্ন জাতি একথা পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই বাঙালি মুসলমানরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছিল।

এ উপলব্ধিকে বলিষ্ঠ ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন মনীষী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার এই বিখ্যাত উক্তিতে : ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’ এ ঐতিহাসিক উক্তির মধ্যে নিহিত ছিল আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার মর্মবাণী। এই জাতিসত্তা ছিল অসাম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করল তখন থেকেই বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। এভাবে শুরু হয়ে গেল ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন।

ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হলো ভাষা শহীদদের রক্তে। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে যে নতুন ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা জাগ্রত হলো তার প্রতিফলন ঘটল আমাদের রাজনীতিতেও। তখন থেকেই এ দেশের রাজনীতি ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করল। মুসলিম লীগ ভেঙে গিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলো। পরে এটি আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব হলো বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাঙালিরা ধাপে ধাপে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে এগিয়ে গেল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি। এর ফলেই অর্জিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরেই বেশ কিছুসংখ্যক লোক ছিল যারা দেশের স্বাধীনতা চায়নি। তারা ছিল মনে-প্রাণে পাকিস্তানি এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাকিস্তানের অনুচর হিসেবে কাজ করতে দ্বিধা করেনি। তারা সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র লিপ্ত হলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি গোষ্ঠী- যারা পাকিস্তানি ভাবাপন্ন ছিল তারাও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। এমন কি এই ষড়যন্ত্রের জাল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ছিলেন এই ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান টার্গেট।

এই ষড়যন্ত্রের ফলেই ১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। এরপর বাংলাদেশের গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সে বছরেই নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধুর চারজন ঘনিষ্ঠ সহচর- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান- যাদের পনের আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর আটক করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যে হত্যাকারী সামরিকগোষ্ঠী পনের আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল সেই একই গোষ্ঠীর দ্বারা জেল হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। এই সকল হত্যাকাণ্ডের ফলে গোটা জাতি হতচকিত ও মুহ্যমান হয়ে পড়ে। এরপর সেনাবাহিনীর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রথম খোন্দকার মোশাতক আহমদ এবং পরে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের অধীনে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ছল-চাতুরীর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতির পদটিও দখল করে নেন। তখন থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পাকিস্তানের অনুকরণে সামরিকীকরণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

পাকিস্তানি ভাবাপন্ন বাংলাদেশের নতুন সামরিক শাসকরা সুপরিকল্পিতভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর হলো। তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তার আদর্শ। আমাদের স্বাধীন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের গোটা ইতিহাসকে বিকৃত করে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেওয়ার চক্রান্ত শুরু হলো। সামরিক শাসকগোষ্ঠীর দোসর একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক তো ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় লিখিত প্রবন্ধে সদর্পে ঘোষণা করে বসলেন : ‘শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাস থেকে বহিষ্কৃত।’ কেবল শেখ মুজিবকে নয়, শেখ মুজিবের আদর্শকে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হলো সামরিক সরকারের ছত্রছায়ায়।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিশেষ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব ও অন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং দেশের সাধারণ মানুষের অবদানকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে মেজর জিয়াউর রহমান প্রমুখ সামরিক বাহিনীর লোকদের কীর্তিকাহিনী মাত্রাতিরিক্তভাবে ফলাও করে বিভিন্ন গণমাধ্যম মারফত প্রচার করা হতে লাগল। বলা হতে লাগল যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের চেয়ে জিয়াউর রহমানের অবদান নাকি অনেক বেশি। জিয়ার আহবানেই নাকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং তিনিই হলেন স্বাধীনতার ঘোষক। বস্তুত জেনারেল জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কতকগুলো মনগড়া ধারণাকে ইতিহাস বলে প্রচার করে জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হলো। ভারতের বিরুদ্ধে জঘন্য ধরনের অপপ্রচার শুরু করা হলো। প্রকারান্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এবং ভারতের জনগণের নিকট থেকে বাংলাদেশ যে অভূতপূর্ব সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করেছিল সে কথা বেমালুম চেপে রেখে সামরিক শাসকরা প্রচার করতে লাগল যে, ভারতই হচ্ছে বাংলাদেশের সকল দুর্গতির জন্য দায়ী; শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ সরকার নাকি ছিল ‘ভারতের সাহায্যপুষ্ট পুতুল সরকার’ এবং ‘পাকিস্তান হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার পরপরই নয়া সামরিক শাসকচক্রের উদ্যোগে বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণের প্রক্রিয়া এইভাবে চলতে থাকে। এইভাবে সমকালীন ইতিহাস সমকালীন রাজনীতির খপ্পরে পড়ে বিকৃত হয়ে বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু ইতিহাসের চাকাকে তো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর খেয়াল-খুশিমতো উল্টিয়ে দেওয়া যায় না। দীর্ঘ একুশ বছর পর একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় এটা প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্মৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।

এই মুহূর্তে যেটা আশু প্রয়োজন সেটা হলো- বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক ইতিহাস সঙ্কলন ও রচনা করার জন্য নতুন আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন।

(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেওয়া)

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি