ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

‘মুষড়ে পড়লে চলবে না, নারীকে শক্ত হতে হবে’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৩৯, ৮ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ২০:২৫, ৮ মার্চ ২০১৮

নাজমুন আরা সুলতানা

নাজমুন আরা সুলতানা

ময়মনসিংহের মেয়ে নাজমুন আরা সুলতানা। বাবার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ল (আইন) পাস করে ময়মনসিংহের জজ কোর্টেই ওকালতি শুরু করেন। একসময় নিজেই স্বপ্ন দেখলেন বিচারক হবেন। বিধি বাম। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বলবত থাকা এক আইনের কারণে ‘নারী বিচারক’ হতে পারছিলেন না এই বিদুষী নারী। কিন্তু যার লক্ষ্য থাকে অটুট তাকে কে আটকিয়ে রাখে?

নাজমুনের বিচারক হওয়ার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসে খোদ রাষ্ট্র। নারীদের অগ্রসরে বাঁধা হবে এমন আইন বাতিল করে ১৯৭৪ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। আবেদন করেন নাজমুন আরা সুলতানা। লিখিত এবং ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে শেষ পর্যন্ত সাব-জজ হয়েই স্বপ্ন পূরণ করেন তিনি। সবশেষ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চের প্রধান হয়েই কর্মজীবনের ইতি টানেন গত বছর ২০১৭ সালের ৭ জুলাই।

৮ মার্চ ‘বিশ্ব নারী দিবস’ উপলক্ষ্যে ইটিভি অনলাইনকে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে দেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোলায়মান হোসেন শাওন। তিনি বলেন, নারীদের অগ্রগতি আশানুরুপ হয়নি। কর্মক্ষেত্রে নারীদের বোল্ড থাকতে হবে, অল্পতেই মুষড়ে পড়লে চলবে না। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-

ইটিভি অনলাইনঃ শুরুতেই আপনার সংগ্রামী জীবনের শুরুর অধ্যায়টা জানতে চাইব। আপনার সামনে যেসব প্রতিবন্ধকতা এসেছিল তা কীভাবে মোকাবেলা করেছেন?

নাজমুন আরা সুলতানাঃ প্রতিবন্ধকতা তো প্রথম দিকে কিছু এসেছেই। কিন্তু তা এমনও ছিল না যে, আমি তা মোকাবেলা করতে পারিনি। সবগুলোই আমি মোকাবেলা করেছি। আমার মা খুব সাপোর্টিভ ছিলেন। আমার বাবা আমাদেরকে ছোট রেখেই মারা গিয়েছেন। আমরা পাঁচ ভাই-বোন ছিলাম। তারপরে মা’ই আমাদেরকে বড় করেছেন।

মায়ের খুব সহযোগিতা ছিল। মায়ের খুব সমর্থন ছিল, অনুপ্রেরণা ছিল। এর জন্য আমি পেরেছি।

ইটিভি অনলাইনঃ আপনি যে সময় কর্মজীবন শুরু করেছেন সে সময় তো চ্যালেঞ্জিং ছিল। সার্বিক অবস্থা কেমন ছিল?

নাজমুন আরা সুলতানাঃ কিছু প্রতিবন্ধকতা তো ছিলই। সার্বিক অবস্থাও প্রতিকূলে ছিল। আমি ময়মনসিংহে লেখাপড়া করেছি। ময়মনসিংহ মফস্বল শহরে তখন ল পড়াই তো অনেক নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হত। অনেকেই মাকে প্রশ্ন করতেন যে, মেয়েকে কেন ল পড়ালেন? আরও কত কিছু তো আছে!

তবে আমার মা কখনই এসব কথায় আমল দেননি। উলটো আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছেন এই বলে যে, ‘তুমি পড়ো যেটা তোমার পড়ার ইচ্ছা।’

ল’ পড়ার পেছনে আমার একটা ব্যক্তিগত আকাঙক্ষাও কাজ করেছে। আমার বাবার ইচ্ছা ছিল তার সন্তানদের মধ্যে থেকে কেউ একজন ব্যারিস্টার হবে। তো আব্বা তো মারাই গিয়েছিলেন। আমরা সবাই ছোট ছোট ছিলাম। আমার বড় বোন মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন। তখনও রেজাল্ট হয়নি। আমার মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না আমাদের কাউকে বিদেশে পাঠিয়ে ব্যারিস্টারি পড়াবেন।

তো আমি যখন ডিগ্রী বিএসসি পাস করলাম তখন মনে হয়েছিল যে, আমি ল পড়লে হয়তো আব্বার ইচ্ছা খানিকতা পূরণ করতে পারব। এই কারণেই আমি ল ভর্তি হলাম। আম্মাও খুব অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

ইটিভি অনলাইনঃ আইনজীবী থেকে বিচারিক ধারায় কীভাবে আসলেন? আপনার সময়ে নারী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হত না। এরপরেও আপনি কীভাবে বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন?

নাজমুন আরা সুলতানাঃ আমি ল’ পাস করার পরে ময়মনসিংহ জজ কোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করি। সেখানে আমি আড়াই বছর প্র্যাকটিস করি।

আমি যখন ল পাস করে আইনজীবী হিসেবে কাজ করা শুরু করলাম তখনো আমরা মেয়েরা কিন্তু বিচারক হওয়ার জন্য যোগ্যই ছিলাম না। অর্থ্যাত আমরা মেয়েরা তখন বিচারক হতে আবেদন করতে পারত না। যদিও তখন আমার মনে একটা ইচ্ছা হয়েছিল যে, আমি বিচারক হব কিন্তু দেখলাম যে, না! আমরা নারীরা বিচারক হতে পারব না।

কিন্তু আল্লাহর রহমত আমি যোগদান করার কিছুদিন পরেই বাংলাদেশ সরকার নারীদের অংশগ্রহণ করার অনুমতি দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। অর্থ্যাত মেয়েরা যে বিচারক পদে আবেদন করতে পারবে না সেই ব্যবস্থা তুলে নেয় সরকার।

তখন পত্রিকায় নারীরা আবেদন করতে পারবে মর্মে বিজ্ঞপ্তিও দেয় সরকার। আমি তখন আবেদন করলাম। পরীক্ষা দিলাম। ফলাফলও ভাল হল। এরপর নিয়োগপত্র পেলাম। নিয়োগের পর আমার প্রথম কর্মস্থল ছিল খুলনা।

ইটিভি অনলাইনঃ কর্মক্ষেত্রে একজন নারী হিসেবে কেমন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?

নাজমুন আরা সুলতানাঃ শুরুতে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে। অনেক ধরণের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছি। তবে আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম যে এমনটা হবে। আর আমি জানতাম খুব দ্রুত এগুলো শেষও হয়ে যাবে। আর তাই হয়েছে।

আমি প্রতিবারই যখন নতুন কোন কর্মস্থলে গিয়েছি সেখানে আইনজীবীদের মধ্যে অবজ্ঞা দেখেছি, জনগণের মাঝেও দেখেছি। তবে খুব দ্রুত সে মানসিকতার দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে কয়েকদিনের মধ্যে দেখেছি অবস্থা পালটে গেছে। সবার আস্থা এসেছে।

ইটিভি অনলাইনঃ এধরনের প্রতিবন্ধকার পিছনের মূল কারণ কী ছিল বলে মনে করেন?

নাজমুন আরা সুলতানাঃ সেসময়ে অনেকের ধারণা ছিল এমন যে, মেয়েরা আবার কী বিচারক হবে? মেয়ে হয়ে কী বিচারই বা করব আমি! তবে কয়েকদিনের মধ্যে আমার কাজে তাদের আস্থা ফিরে এসেছে। তারা খুবই সন্তুষ্ট ছিল এবং প্রতিবার আমি যখন কোন কর্মস্থল থেকে বদলি হতাম তখন তাদের সেই আবেগ অনুভব করতাম আমি।

ইটিভি অনলাইনঃ বাংলাদেশে নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এখন কেমন বলে আপনি মনে করেন? নারীরা কী এখনও পিছিয়ে আছে?

নাজমুন আরা সুলতানাঃ নারীদের অগ্রগতি এখনও আশানুরুপ অর্জিত হয়নি। তবে সার্বিকভাবে আমি বলব না যে, নারীরা পিছিয়ে আছে। কারণ এখন নারীদের অনেক বড় একটা অংশ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ‘সফল’ বলতে আমরা যা বুঝি তেমন অনেক নারী আছেন যারা উল্লেখযোগ্য স্থানে অবস্থান করছেন। সেই অর্থে বলতে গেলে নারীরা এখন আগের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে আছে।

ইটিভি অনলাইনঃ যাদেরকে আমরা সফল বলছি বা নেতৃত্বস্থানীয় আসনে দেখছি নারীদের অবস্থান এবং অবস্থা উন্নয়নে তাদের কী ভূমিকা হতে পারে?

নাজমুন আরা সুলতানাঃ তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনেকের তুলনায় একটু দুর্বল অর্থনৈতিক পরিবেশ অথবা অনেক বেশি প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থেকে আমরা যারা উঠে এসেছি, সফল হয়েছি; আমাদেরকেই তো এখন তরুণ নারী প্রজন্মের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে, তাই না? এজন্য আমি বলব যে, আমরা যারা নারীরা এগিয়ে আসতে পেরেছি আমরা যেন সবসময় এমন একটি মানসিকতা পোষণ করি যেন যারা পিছিয়ে আছে তাদেরকে সামনে আনতে আমাদের যদি কিছু করার থাকে তা থেকে যেন আমরা পিছিয়ে না থাকি।  

ইটিভি অনলাইনঃ বর্তমান সময়ের নারীদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী হবে?

নাজমুন আরা সুলতানাঃ জীবনে কে কী হবে কোন পথে যাবে এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। একজন তার নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী নিজের পথ বেছে নেবেন। তবে বোল্ড থাকতে হবে, খুব সাহসী হতে হবে। মুষড়ে পরলে চলবে না; ভেঙ্গে পরলে চলবে না। যার যেটা লক্ষ্য সে বিষয়ে দৃঢ থাকতে হবে।

কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে, বাধা-বিপত্তি আসতে পারে। সেগুলে এড়াতে হবে। সেসময় শক্ত থাকতে হবে।

নারীরা কখনও নিজেদেরকে অধঃস্তন মনে করবেন না। বরং আমি মনে করি নারীরা অনেক্ষ বিশেষ ক্ষেত্রেই পুরুষদের থেকে এগিয়ে থাকে।

দেখেন, নারীরা সন্তান জন্মদান করেন। সেই সন্তান লালন পালন করে নারীরা। তারপরেও নারীকে যদি একটা অবস্থানে বসিয়ে দেওয়া হয়ে তাহলে তিনি কী পুরুষের চেয়ে খারাপ করবেন? উনি তো একজন পুরুষের চেয়ে খারাপ করবেন না।

একুশে টিভি অনলাইন : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

নাজমুন আরা সুলতানা : সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছ। আর একুশে পরিবারের প্রতি শুভ কামনা।

/এআর /


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি