ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪

মৃত্যুর আগেই সম্পত্তি বিলিবণ্টনের যেসব নিয়ম রয়েছে বাংলাদেশে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:০৮, ১০ অক্টোবর ২০২২

বাংলাদেশে জীবদ্দশায় কেউ যদি সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে যেতে চান তার কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। এসব পদ্ধতিগুলোর নিয়মে কিছু জটিলতা ও শর্ত রয়েছে। সেসব কারণে অনেকেই মৃত্যুর আগে সম্পত্তি বিলিবণ্টন করেন না। অনেকে বিষয়গুলো জানেন না।

কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ তৈরি হয়। সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে যত মামলা রয়েছে তার ৬০ শতাংশই জমিজমা সংক্রান্ত।

উইল
পশ্চিমা বিশ্বে মৃত্যুর আগেই সম্পত্তি উইল করে যাওয়ার প্রচলন রয়েছে। কোন ব্যক্তি যে কাউকে যতটুকু ইচ্ছা সম্পত্তি উইল করে দিয়ে যেতে পারেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সম্পত্তি বিলিবণ্টনের ক্ষেত্রে সাধারণত ধর্মীয় আইন অনুসরণ করা হয়।

ঢাকার জজ কোর্টের আইনজীবী আবুল হাছানাত ইমরুল কাউছার বলছেন, মুসলিমদের মধ্যে উইল করার যে নিয়মটি রয়েছে সেটি প্রচলিত ভাষায় 'অছিয়ত' বলে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে পুরো সম্পত্তি উইল করা যায় না।

"একজন ব্যক্তি যদি মুসলিম হন, তার মোট সম্পত্তির তিনভাগের একভাগ পর্যন্ত যে কাউকে উইল করে দিয়ে যেতে পারবেন। ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার বাদবাকি সম্পত্তি অন্যান্য ওয়ারিশদের মধ্যে বিলিবণ্টন হবে, যেভাবে ধর্মীয় আইন অনুযায়ী বলা আছে সেভাবে। এক্ষেত্রে যার বা যাদের নামে এক তৃতীয়াংশ উইল করা আছে, তিনি যদি ওয়ারিশ হন তাহলে তিনিও ওই বাকি অংশের ভাগ পাবেন।"

উইল করার জন্য দুইজন সাক্ষী রাখতে হবে। এই উইল চাইলে পরে পরিবর্তন বা বাতিল করা সম্ভব। উইলটি রেজিস্ট্রি করে নিলে পরবর্তীতে জটিলতা কম হয়। উইল কার্যকর হয় মৃত্যুর পর।

বাংলাদেশে মোট সম্পত্তির তিনভাগের একভাগের বেশি উইল করা যায় না।

যিনি উইল করেছেন তার মৃত্যুর পর সম্পত্তি নিজের নামে নেবার জন্য উইলটি নিয়ে আদালতে আবেদন করতে হয়। আদালতের আদেশ পাওয়ার পর সেটি নামজারি করা সম্ভব হয়।

বাংলাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি আইন মোটামুটি একই রকম, তবে তাতে এক তৃতীয়াংশের কোন বিষয় নেই।

হেবা
মৃত্যুর আগে সম্পত্তি হস্তান্তরের একটি অন্যতম পদ্ধতি হচ্ছে তা দান করে যাওয়া, যা বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে 'হেবা' হিসেবে পরিচিত।

মি. কাউছার বলছেন, "হেবা করলে সে সম্পত্তি সাথে সাথে হস্তান্তর করতে হয় এবং যাকে দেয়া হল সে সাথে সাথে সেই সম্পদ ভোগ করতে পারে। একজন সুস্থ ব্যক্তি চাইলে তার পুরো সম্পত্তি একজনকে দান করতে পারে। যেমন ধরেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে একজনকে। আবার একের অধিক ব্যক্তিকেও দান করতে পারে। কোন প্রতিষ্ঠানকে দান করতে পারে।"

এক্ষেত্রে দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে রেজিস্ট্রি করে সম্পদ দান করতে হয় এবং সম্পত্তির দখল হস্তান্তর করে দিতে হয়।

যেকোনো ধর্মের ব্যক্তি সম্পদ দান করতে পারেন। কাগজে কলমে আনুষ্ঠানিকভাবে একবার দান সম্পন্ন হলে সেটি বদলানোর আর কোন উপায় নেই।

তবে সম্পত্তি গ্রহণ করার আগে যিনি সম্পত্তি দিচ্ছেন তার যদি মৃত্যু হয় তাহলে এই দান বাতিল হয়ে যাবে।

জটিলতা
বাংলাদেশে প্রায়শই জমিজমা নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে মামলা হয়ে থাকে।

ইমরুল কাউছার বলছেন, "দান ও উইলের ক্ষেত্রে পায়ই দেখা যায় উত্তরাধিকারীদের কেউ একজন এই বলে মামলা করে বসলো যে বাবার সই নকল করা হয়েছে অথবা সম্পত্তি দান করার সময় তিনি শারীরিক, মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন তাই স্বেচ্ছায় এটা করেননি।

"উত্তরাধিকারীদের সম্মতি থাকলে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু তাদের কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসলে তখন মামলা করতে হয়। আদালত সবকিছু দেখে শুনে যদি যার নামে উইল করা হয়েছে তার পক্ষে রায় দেয় তাহলে তখন সে সম্পত্তি পায়। এমন বিষয় প্রায়ই দেখা যায় যে এসব মামলা বছরের পর বছর ধরে চলে।"

সম্পদ দান করার সময় ব্যক্তিকে অবশ্যই সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে এমন নিয়ম আছে। বাংলাদেশে প্রায়শই অনেকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এটি করার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ আপত্তি জানাতে চাইলে এই সুযোগটি অনেকেই নিয়ে থাকে বলছিলেন তিনি।

বাংলাদেশে অনেকে জমি রেজিস্ট্রি, দান অথবা উইল করতে অস্বস্তি বোধ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বলছেন, "আমি বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছি যে আমার অবর্তমানে আমার মেয়েরা আদৌ সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে কি না। আমার ছেলেদের মধ্যে কিছু আচরণ দেখার পর এমনটা মনে হয়েছে। কিন্তু আমি তারপরও সাহস করি না যে হেবা করে দিয়ে যাবো। কারণ ছেলে মেয়েদের সম্পত্তি হেবা করে দিয়ে দিলাম আর তারপর আমাকেই যদি বাড়ি থেকে বের করে দেয়? তখন আমার কি হবে?"

ইমরুল কাউছার বলছেন, এই সমস্যার কিছুটা সমাধান হচ্ছে যদি নিজেকে ওই ব্যক্তি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, দান করা সম্পত্তির 'পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি'র ক্ষমতা দেবার ব্যবস্থা করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে যাকে দান করা হল তার সম্মতি অবশ্যই দরকার হবে এবং দান পরিবর্তন হবে না।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য কাজল দেবনাথ বলছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মূল জটিলতা তৈরি হয় কোন ছেলে সন্তান না থাকলে।

হিন্দু ধর্মে বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের কোন অধিকার নেই এবং হিন্দু নারীর যদি ছেলে সন্তান না থাকে তাহলে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করতে পারলেও উত্তরাধিকারী হবেন না।

তবে প্রচলিত নিয়মে রেজিস্ট্রি করে যে কাউকে সম্পত্তি লিখে দেয়া যায়। কাজল দেবনাথ বলছেন, একই কারণে সেটি করার ব্যাপারে বেশিরভাগ মানুষই দ্বিধা বোধ করেন।

এছাড়া বাংলাদেশে জমিজমা বিষয়ক যেকোনো কাজ খুব সময় সাপেক্ষ এবং জটিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক বাসিন্দা বলছেন, "আমরা চার বোন, কোন ভাই নেই। আব্বা ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত নিলো যে সব সম্পত্তি আমাদের নামে দিয়ে যাবে। তার মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিল যে সে যদি সেটা না করে তাহলে তার অবর্তমানে তার ভাইয়ের ছেলেরা সম্পত্তি দখল করে নেবে। হেবা করতে গিয়ে যে পরিমাণ দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, ফি দেবার জন্য ব্যাংক, বিষয়টি খুবই সময় সাপেক্ষ। তারপর বয়স্ক মানুষ এবং অসুস্থ। তার জন্য পুরো বিষয়টা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল।"

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসবি/ 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি