ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়

হুমায়ূন আহমেদ

প্রকাশিত : ১৫:২২, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৫:২৪, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ভুবনবিখ্যাত মানুষদের নিয়ে আমার কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি নেই।

ভুবনবিখ্যাতরা দূরের নক্ষত্রের মতো, তাদের কাছে কীভাবে যাব! তবে এক নক্ষত্রের সঙ্গে এক মিনিটের একটি স্মৃতি আছে। আতি তুচ্ছ মূল্যহীন স্মৃতি। মাঝে মাঝে মূল্যহীন স্মৃতিও ভালোবেসে আঁকড়ে থাকার মতো মূল্যবান হয়ে যায়। ভুবনবিখ্যাত এক নক্ষত্রের সঙ্গে এক মিনিটের স্মৃতিটা এ রকম-

বাংলাদেশে প্রথম একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠান। পদক প্রদান করবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অনুষ্ঠান হবে বঙ্গভবনে। কিমআশ্চর্যম! এত বড় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমি দাওয়াত পেয়ে গেছি। আমি কে? কেউ না। অতি অভাজন। ঢাকা ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রির সামান্য লেকচারার। দুটি বই বের হয়েছে। তাতে কী? আমার লেখকখ্যাতি বা পরিচিত নেই।

সরকারি আমন্ত্রণ পেয়ে আনন্দে উল্লসিত। মেরুন রঙের একটা হাফশার্ট ইস্ত্রি করিয়ে পরেছি। নিজেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ মানুষরা বঙ্গভবনে গাড়ি করে যাবেন, আমি গাড়ি পাব কোথায়? রিকশা করে বঙ্গভবনের গেট পর্যন্ত গেলাম। সেখান থেকে হেঁটে মূল ভবনে গেলাম। বেশ কয়েকবার আমাকে আমন্ত্রণপত্র দেখাতে হলো। আমি নিমন্ত্রিত অতিথি এটা মনে হয় কারোর বিশ্বাস হচ্ছিল না।

অনুষ্ঠান শেষ হলো। মাইকে ঘোষণা করা হলো অতিথিদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাশের ঘরে তার সঙ্গে চা খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।

পাশের ঘরে ঢুকে চোখ কপালে উঠে গেল। লম্বা টানা টেবিল। টেবিলভর্তি খাবার। চোখ আটকে গেল মিনি সমুচায়। একসঙ্গে দু’তিনটা মুখে দেওয়া যায় এমন সাইজ। আমি মনের আনন্দে আস্ত সমুচা মুখে ঢুকিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত কণ্ঠস্বরের হুঙ্কার শুনলাম- ‘এই তুকে কে রে?’ সাত মার্চের এই কণ্ঠস্বর ভোলার কোনো কারণ নেই। আমি চমকে উঠলাম। দেখি বঙ্গবন্ধু। আঙুল উঁচিয়ে আমাকে দেখাচ্ছেন। কী সর্বনাশ, আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। মুখের ভেতর সমুচা। না পারছি গিলতে, না পারছি উগরে ফেলে দিতে।

আরে, সত্যি তো তিনি আঙুল উঁচিয়ে আমার দিকেই আসছেন। আল্লাহপাক আমাকে রক্ষা করো। আমি তার প্রশ্নের কী জবাব দেব? এমন একজন মানুষের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কি পরিচয় আমার আছে?

পরম করুণাময় অভাজন লেখকের প্রার্থনা শুনলেন। এক বিদেশি কূটনীতিক বঙ্গবন্ধুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বসলাম। তারপর ৩টা সমুচা খেলাম। কাগজে মুড়ানো একটা স্যান্ডউইচ খেলাম। এক পিস কেক হাতে নিয়ে কামড় দিলাম। কী মনে করে যেন তাকালাম বঙ্গবন্ধুর দিকে। তিনি আবারও আমার দিকে তাকিয়েছেন। আমি আবারও কেক হাতে লাফ দিয়ে উঠলাম।

বঙ্গবন্ধুর ঠোঁটের কোনায় কি হাসির রেখা? তাই তো মনে হচ্ছে। তিনি হাতের ইশারায় আমাকে বসতে বললেন এবং বজ্রকণ্ঠে বললেন, ‘আরাম করে খা’।

এই আমার এক মিনিটের স্মৃতি। পাখি উড়ে চলে গেলে তার পালক ফেলে যায়। পালক তার শরীরের অংশ। মানুষ চলে গেলে তার শরীরের কোনো অংশ ফেলে যায় না। সে ফেলে রেখে যায় তার কথা। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কথাগুলো তানপুরা হয়ে যায়। তানপুরায় সামান্য কথাগুলোই অলৌকিক মহাসঙ্গীতের মতো বাজে।

জাতির গভীর শোকের দিনে আমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত এক আনন্দের স্মৃতি বললাম। আজ তাকে সবাই চোখের জলে স্মরণ করবে। তা-ই উচিত। আমার এই আনন্দস্মৃতিতেও অশ্রু মেশানো আছে।

বিস্মৃত যুগে দুর্লভ ক্ষণে বেঁচেছিল কেউ বুঝি
আমরা যাহার খোঁজ পাই নাই তাই সে পেয়েছে খুঁজি।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি