ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

‘সব পেশাকে সম্মানের চোখে দেখা হয় না’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:৫২, ৩১ মে ২০১৮ | আপডেট: ১১:২১, ১৩ জুন ২০১৮

সুধাংশু শেখর রায়

সুধাংশু শেখর রায়

সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দরকার নেই। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়মুখী নয়। বরং তারা ভোকেশনাল কোর্সে ভর্তি হয়ে নিজেরা যেমন কিছু করতে শিখে তেমনি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এভাবেই নিজের অভিমত তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সুধাংশু শেখর রায়। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অারও বলেন, বিদেশে শ্রমের মর্যাদা অাছে। যেকোনো কাজকে তারা সমান সম্মানের চোখে দেখে। কিন্তু অামাদের দেশে সব পেশাকে সমান সম্মানের চোখে দেখা হয় না। শারীরিক শ্রম নির্ভর লোকেরা সম্মান পায় না। তাই শ্রম নির্ভর পেশা নির্বাচনে অামাদের তরুণরা উৎসাহী নয়। তাই অামাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানোর আহ্বান জানান তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক অালী অাদনান

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অামাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ণ করবেন?

সুধাংশু শেখর রায়: অামাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে চলনসই বলা যায়। তবে প্রচুর সংস্কারের দাবি রাখে বলে অামি মনে করি। উচ্চ শিক্ষায় অামাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পাবলিক ও প্রাইভেট দু`ভাগে বিভক্ত। এছাড়াও নানা ধরণের কারীকুলাম অাছে। অর্থাৎ লেখাপড়ায় যে ঐক্য বা সমব্যবস্থা তা কিন্তু নেই। অামি মনে করি, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে একটা ছাতার নিচে নিয়ে অাসা দরকার। একই দেশে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একভাবে চলবে অাবার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অন্যভাবে চলবে তা তো কাম্য হতে পারে না। অাবার মূল্যায়ণ পদ্ধতিও ভিন্ন। তা অামি সমীচীন মনে করি না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিন্তু বাণিজ্যিক শিক্ষা থেকে বেরিয়ে অাসার কোনো সুযোগ অাজকের বাস্তবতায় অাছে কী?

সুধাংশু শেখর রায়: লেখাপড়া একদিকে জ্ঞান অর্জনের জায়গা অন্যদিকে দক্ষতা অর্জনের জায়গা। অাগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়াকে জ্ঞান অর্জনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু ইদানীং জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে কিছু টেকনেশিয়ান ধরণের লোক তৈরি করা হচ্ছে। অামি এটাকে সমর্থন করি না। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন করাকে অামরা উৎসাহী করতে পারি। কিন্তু শুধু চাকরির উদ্দেশ্যে যে লেখাপড়া সেখানে জ্ঞান অর্জনের কোনো সুযোগ রাখা হয়না। এটা ভালো দিক নয়।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার পরেও অামাদের তরুণরা বেকার থাকছে। এটা কী শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নাকি কর্মসংস্থানের অভাব?

সুধাংশু শেখর রায়: দু`টোই। অামাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি অাছে একথা অস্বীকার করার সুযোগ তো নেই। পাশাপাশি ছোট দেশ হিসেবে অামাদের যে ধরণের কর্মসংস্থান করার কথা তা একেবারেই অপ্রতুল। অামি মনে করি সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়তে হবে এমন কথা নেই। অামাদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে যে সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডীতে প্রবেশ করেন না। কিন্তু তারা ভোকেশনাল কোর্সে ভর্তি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কর্মসংস্থানে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। অাবার নিজেরাও কর্মসংস্থান তৈরি করে নিচ্ছে। কিন্তু অামাদের দেশের চিত্রটা ভিন্ন। এখানে একজন তরুণ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডী পার হয় তখন তার মধ্যে একটা দাবি তৈরি হয়, যে তাকে চাকরি দিতে হবে। বা তখন সে নিজেকে অফিসিয়াল চাকরির দাবিদার মনে করে। কিন্তু চাকরি দেওয়ার দায়ভার শুধু সরকারের না। একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নেওয়াটাও একজন তরুণের কর্তব্য। অভিভাবকদের উচিৎ তাদের সন্তানদের ছোট বেলা থেকে উৎসাহী করা যাতে তারা নিজেরা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎসাহী হয়। তাদের মধ্যে উদ্যোগী মনোভাব গড়ে তোলে। পাশাপাশি সরকারের উচিৎ শিক্ষা ব্যবস্থাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে বাস্তবমুখী ও জীবনমুখী করা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী?

সুধাংশু শেখর রায়: দেখুন, অামাদের দেশটা ছোট। জনসংখ্যা অাঠারো কোটি। এখানে কতো অার কর্মসংস্থান করা যায়। দেশটা যদি শিল্পন্নোত হতো, তাহলেও না হয় কথা ছিল। তবে এখন যে হারে শিল্পায়ন হচ্ছে তাতে বলতে হয় খুব দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার যদি উদ্যোগী হয় তাহলে কর্মসংস্থানের সমস্যা লাঘব করা সম্ভব হবে বলে অামি বিশ্বাস করি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অামাদের তরুণরা বিসিএসকে একমাত্র সফলতা মনে করছে। সবাই বিসিএস মুখী। এটা কীভাবে দেখছেন?

সুধাংশু শেখর রায়: না, কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। পাবিলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- ছাত্রীরা বিসিএস মুখী হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা বিসিএস মুখী নয়। এটার দায়ভার অামাদের। কারণ, ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে তরুণদের কেরানী বানানোর জন্য। ফলে অামাদের অনেক শিক্ষার্থী একদিকে যেমন উদ্যোক্তা হতে ভয় পায় বা উদ্যেক্তা হওয়ার পারিবেশিক অানুকূল্য পায় না, অন্যদিকে তেমনি শারীরিক শ্রম দিতে হয় এমন কাজগুলোকে অামরা গ্রহণ করতে মানসিক প্রস্তুতি অামাদের থাকে না। অাগেই বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডী পার হওয়ার পর তারা নিজেদের ভালো চাকরির দাবিদার মনে করে। এর ফলে একটা শ্রেণি বিসিএস মুখী। দ্বিতীয়, বিদেশে শ্রমের মর্যাদা অাছে। যেকোনো কাজকে তারা সমান সম্মানের চোখে দেখে। কিন্তু অামাদের দেশে সব পেশাকে সমান সম্মানের চোখে দেখা হয় না। শারীরিক শ্রম নির্ভর লোকেরা সম্মান পায় না। তাই শ্রম নির্ভর পেশা নির্বাচনে অামাদের তরুণরা উৎসাহী নয়। অামাদের এ মানসিকতায় পরিবর্তন অানা জরুরি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতি- নৈতিকতা ও মানবিকতার অভাব অাছে। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে কী বলবেন?

সুধাংশু শেখর রায়: একাডেমিক পড়াশোনা যেমন দরকার, তেমনি তার পাশাপাশি কো-কারীকুলাম পড়াশোনা ও কার্যক্রমে জড়িত থাকাও দরকার। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার্থীরা কো কারীকুলামে জড়িত অাছে এমনটা দেখা যায় না। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা মানুষকে মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী করে। অাগে গ্রামে গ্রামে নাটক মঞ্চস্থ হতো। কবিগানের অাসর বসতো। শিক্ষার্থীরা ছোট কাগজ ও পত্রিকা নিয়ে উৎসাহী ছিল। এখন এই চর্চাগুলো কমে গেছে। ছেলে মেয়েরা বই পড়ে না। বইয়ের পরিবর্তে তারা ফেসবুক মুখী। অাগে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা মানুষের মধ্যে ঐক্য বাড়াতো। মনুষ্যত্ববোধকে জাগিয়ে রাখত। অার এখন অনলাইন নির্ভরতা মানুষকে অাত্মকেন্দ্রীক করে ফেলছে। এখানে এসে নীতি নৈতিকতা হেরে যাচ্ছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নীতি নৈতিকতা হারিয়ে যাওয়ার জন্য কী অাপনি ইন্টারনেট অাসক্তিকে দায়ী করছেন?

সুধাংশু শেখর রায়: হ্যাঁ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে কাটানো মানুষগুলো নানা ধরণের হতাশায় অাক্রান্ত। এই হতাশা মানুষকে জীবনমুখী করে না। তখন নীতি- নৈতিকতা- মানবিকতা অর্থহীন হয়ে যায়। একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষের কাছে তো অাপনি ইতিবাচক কিছু অাশা করতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, মোবাইল নির্ভরতা বা ইন্টারনেট জগতের প্রতি অতি অাগ্রহ কাজের প্রতি মনোযোগ নষ্ট করে। চিন্তার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। সময় নষ্ট, চিন্তার এনার্জি নষ্ট। অামাদেরকে পরিবার, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ভূমিকা রাখে ভার্চুয়াল জগৎ। যদিও অনেকে বলে মোবাইল বা ইন্টারনেট অামাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে। কিন্তু প্রকৃত সত্য অামাদেরকে বিছিন্ন করতে বা ঐনিক্য করতে ভূমিকা রাখে মোবাইল ও ইন্টারনেট। অামি বলি, মোবাইল সংস্কৃতি অামাদের বিচ্ছিন্ন করেছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অাপনাকে ধন্যবাদ। 

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি